ব্যাংক সংখ্যা কমানোর পরিকল্পনা: চ্যালেঞ্জ ও আশঙ্কা
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪সে কারণে কতটি ব্যাংক তার অস্তিত্ব বিলোপ করে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সবল হবার যাত্রায় অংশ নিতে বাধ্য হবে, তা এখনই নিশ্চিত নয়৷
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মো. নাছের ব্যাংক খাতে সংস্কারের রেডম্যাপ প্রকাশ করেন ৪ ফেব্রুয়ারি৷ সেখানে ১৭টি কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরা হয়৷ যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হলো: দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা, খেলাপি ঋণ কমানো, খেলাপি ঋণ ও জালিয়াতি বন্ধ করা, ব্যাংকে যোগ্য পরিচালক নিয়োগে ব্যবস্থা করা, উপযুক্ত স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ৷
এসবের মূল টার্গেট হলো খেলাপি ঋণ কমিয়ে যৌক্তিক মাত্রায় নিয়ে আসা এবং ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা৷
বাংলাদেশ ব্যাংক এসব লক্ষ্য পূরণের সময়সীমা ঠিক করেছে ২০২৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত৷
দুর্বল ব্যাংক সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে
ব্যাংক সংস্কারের ঘোষণা দেওয়ার আগেই ২০২৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ) ফ্রেমওয়ার্ক' নামে একটি সার্কুলার দেয়৷ দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সংকট কাটিয়ে সক্ষম করার জন্য ওই ফ্রেমওয়ার্ক করা হয়৷ তাতে বলা হয়, যারা দুর্বলতা কাটাতে পারবে না তাদের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক৷
সার্কুলারে বলা হয়, ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ থেকে পিসিএ ফ্রেমওয়ার্ক কার্যকর করা হবে৷
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, মার্জ করা হবে ২০২৫ সালের মার্চের পরে, তার আগে নয়৷ তার আগে কোনো দুর্বল ব্যাংক সবল হয়ে গেলে তারা আর মার্জিংয়ের নীতিতে পড়বে না৷ এই সময়ে সবল হতে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের নীতি সহায়তা দেবে বলেও জানান ঐ কর্মকর্তা৷ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘খুব দ্রুত বাংলাদেশ ব্যাংক একীভূত করার নীতি আরো স্পষ্ট করবে৷ যারা দুর্বল তাদের পূর্ণাঙ্গ অ্যাসেস করা হবে৷''
‘কাজটি অনেক চ্যালেঞ্জিং'
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘যদি সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক মার্জ করতে হয় তাহলে দ্রুতই দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে হবে৷ নতুন যে পরিচালনা পর্ষদকে দায়িত্ব দেয়া হবে তাদের কাজ হবে ব্যাংকের দায় দেনা হিসাব এবং ব্যাংক দুর্বল হওয়ার জন্য কারা দায়ী তা চিহ্নিত করা৷ এরপর কাজ হলো সবল ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা করা৷ কারণ সবল ব্যাংককে বললেই তো সে দুর্বল ব্যাংককে নেবে না৷ একটি দুর্বল ব্যাংককে মার্জ করার জন্য সরকার কত টাকা দেবে তা নির্ধারণ করা৷ এই সময়ে ব্যাংকের লোন দেয়াসহ স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হবে৷ এটা অনেক চ্যালেঞ্জিং কাজ৷''
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘গ্রাহকরা কোনো ক্ষতির মুখে পড়বেন কিনা তা নির্ভর করবে সরকারের বেলআউট পলিসির ওপর৷ সরকার যদি শতভাগ গ্যাপ পূরণ করে দেয় তাহলে গ্রাহকদের ক্ষতি হবে না৷ আর কিছু লোক তো চাকরি হারাবেনই৷ কারণ দুইটি ব্যাংক এক হলে, এক ব্যাংকের তো একই এলাকায় দুইটি শাখা থাকবে না৷ এখন তো দুইটি ব্যাংকেরই শাখা আছে৷ তবে তিন বছর পর্যন্ত ছাঁটাই করা হবে না বলা হচ্ছে৷''
তার কথা, ‘‘মার্জিং ভালো উদ্যোগ৷ এটা করতে পারলে অনেক ভালো হবে৷ কিন্তু এরজন্য সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন৷ শুরুতেই তো তিন বছর সময় নেয়া হচ্ছে৷ শেষ পর্যন্ত কী হয় দেখা যাক৷''
‘মার্জ হলে কিছু লোক চাকরি হারাবেন'
যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. নুরুল আমিন বলেন, ‘‘মার্জিং একটা ভালো উদ্যোগ৷ এটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং সফল৷ কিন্তু এই ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি কী হবে, সেটাই বড় প্রশ্ন৷''
তবে তিনি মনে করেন বাস্তবায়ন পর্যায়ে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে৷ ‘‘যেমন মার্জ করার জন্য সবল ও দুর্বলকে রাজি করানো, কোনো ধরনের স্বজনপ্রীতি থাকবে কিনা, রাজনৈতিক বিবেচনায় করা হবে কিনা ইত্যাদি৷ একটি ব্যাংকের সঙ্গে আরেকটি ব্যাংককে মার্জ করতে বললেই তো হবে না৷ এটা সমঝোতার মাধ্যমে হতে হবে৷ তাই বাংলাদেশ ব্যাংককে নীতিমালা স্পষ্ট করতে হবে৷ ডায়ালগ করতে হবে,'' বলেন আমিন৷
যমুনা ব্যাংকের সাবেক এই এমডি বলেন, ‘‘মার্জ হলে কিছু লোক চাকরি হারাবেন৷ তবে তিন বছরে তাদের চাকরিচ্যুত করা হবে না৷ পলিসি স্পষ্ট হতে হবে৷ যাদের বিদায় করা হবে তাদের কী উপায়ে বিদায় দেয়া হবে তা আলোচনা করে ঠিক করতে হবে৷''
আর গ্রাহকদের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘‘তাদের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই৷ কারণ প্রথমত বাংলাদেশে কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না৷ নজির নেই৷ আর গ্রাহকদের ব্যাপারটাও মার্জিং পলিসিতে থাকে৷''
গ্রাহকেরা কী বলছেন?
একটি ব্যাংকের গ্রাহক আতিকুর রহমান আকাশ বলেন, ‘‘সঠিক নীতিমালার ভিত্তিতে করলে আমার মনে হয় ভালোই হবে৷ তবে আমার আশঙ্কা, দুর্বল ব্যাংককে কাঁধে নিতে যেয়ে সবল ব্যাংকটি আবার দুর্বল হয়ে না যায়৷''
আরেক গ্রাহক শেখ আব্দুস সাত্তার লিমন বলেন, ‘‘মূল কথা হলো এটা কতটা স্বচ্ছতার সঙ্গে করা হবে৷ দেখা যাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় সবল ব্যাংককে দুর্বলের তালিকায় ফেলা হবে৷ আবার দুর্বল ব্যাংককে সবলের তালিকায় রাখা হবে৷ তাহলে তো গ্রাহকরা লাভবান হবে না, তারা ভুল তথ্য পাবে৷ তবে দুর্বল ব্যাংক এখন গ্রাহকরা চেনে৷ সেখানে এমনিতেই তারা টাকা রাখা কমিয়ে দিয়েছে৷''
বাংলাদেশে এখন মোট বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা ৬১টি৷ মোট খেলাপি ঋণের ৬৩ শতাংশই আছে ১০টি ব্যাংকে৷ আর মূলধন ঘাটতিতে আছে ১৪টি ব্যাংক৷ তাদের মোট মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা৷ এর বাইরে পাঁচটি ইসলামি ধরার ব্যাংককে মূলধন ঘাটতি কাটাতে নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক৷
জানা গেছে, ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৪০টি ব্যাংক মোটামুটিভাবে ভালো করছে৷ বাকিগুলোর অবস্থা খারাপ৷
বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ব্যাংকগুলোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯.৯৩ শতাংশ৷ তবে দুর্দশাগ্রস্ত ও পুনঃতফসিল কিংবা অবলোপনের পরও আদায় না হওয়া ঋণের পরিমাণ চার লাখ কোটি টাকার বেশি, মোট ঋণের যা ২৬ শতাংশ৷