বৈধ পথে অভিবাসন শান্তির, সম্মানের
৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১একজন বাংলাদেশির গল্প শোনাই আপনাদের৷ ধরুন তার নাম তরুণ৷ সুইজারল্যান্ডে গিয়ে পরিচয় হয় তরুণদার সঙ্গে৷ ওনার বাড়ি নারায়ণগঞ্জে৷ দেশ ছেড়েছেন আজ থেকে ২২ বছর আগে৷ চার বছর আগে বৈধ কাগজপত্র হয়েছে তার৷ কিন্তু এই সময়ে বাবা-মা মারা গেছেন, মারা গেছেন বড় এক ভাই৷ অথচ বৈধ কাগজ না থাকায় দেশে ফেরা হয়ে ওঠেনি তার৷ ২২ বছর আগে ভারতের এক দালালের মাধ্যমে নরওয়েতে এসেছিলেন জানুয়ারি মাসে৷ ১২ লাখ টাকায় ভারতের পাসপোর্ট-ভিসাসহ সব কিছুর ব্যবস্থা করেছিল দালালটি৷ তাদের দলে ছিল ৭ জন৷ তিনি এইচএসসি পাস করে পড়ালেখায় মন বসাতে পারেননি৷ তাই ইউরোপে আসার স্বপ্ন দেখেছিলেন৷ বাবা-র কাছ থেকে অনেকটা ‘ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল’ করে টাকা আদায় করেছিলেন৷ তার দলে বাকিরা বেশ শিক্ষিত৷ কেউ অনার্স পাস করেছে, কেউবা ডিগ্রি৷ এর মধ্যে ভারতের ছেলে রতনের সঙ্গে তার ভাব হয়ে যায়৷ তারা একই ফ্লাইটে পাশাপাশি বসে প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে নরওয়েতে পৌঁছান৷
দালাল আগেই বলে দিয়েছিল, নরওয়ে পৌঁছেই পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে দিতে৷ তাই করেছিলেন৷ ফলে ইমিগ্রেশনে গেলে পুলিশ ধরে জেলে নিয়ে যায়৷ দালাল লোকটি বলে দিয়েছিল মুখ দিয়ে একটাও শব্দ করা যাবে না৷ অর্থাৎ, পুলিশ যাতে বুঝতে না পারে কোন দেশি৷ বিভিন্ন দোভাষী এনেও তরুণদার মুখ থেকে একটা শব্দ উদ্ধার করতে পারলো না তারা৷ কিন্তু রতনের মুখ ফস্কে ইংরেজি ভাষা বের হয়ে গেল৷ এরপর তাদের আলাদা রাখা হলো৷ তখন থেকে রতনের আর খবর জানেন না তিনি৷ প্রায় বছর খানেক সেখানকার জেলে রেখে একসময় তাকে একটা বিশেষ কাগজ ধরিয়ে দেশে পাঠানোর সব ব্যবস্থা পাকা করা হয়৷ কিন্তু তিনি দেশে ফিরতে রাজি ছিলেন না৷ সড়কপথে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যান ডেনমার্ক৷ এরপর নানা দেশ ঘুরে ১৮ বছর পর পর্তুগালে গিয়ে অবশেষে বৈধ কাগজপত্র করতে পারেন৷ এর তিনবছর পর সুইজারল্যান্ডে এসে থিতু হন৷ বর্তমানে একটা হোটেলে কাজ করছেন৷
তিনি যখন আমাদের কাছে এই গল্প করছিলেন, তখন কখনো তার মুখে আনন্দ কখনো বা বিষাদ খেলা করছিল, চোখের কোণে কখনো ঝিলিক দিচ্ছিল জল৷ বলছিলেন বিস্তারিত বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে, আর আমাদের হাতে এত সময়ও ছিল না৷ বললেন, তার জীবনে যেসব ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে, যে কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, তা সিনেমাকে হার মানায়৷ তবে এ কথা স্বীকার করলেন, এভাবে না এসে যদি বৈধ পথে আসতেন, তাহলে বাবা-মাকে অন্তত শেষ দেখাটা দেখতে পেতেন৷ এতদিন দেশে না গিয়ে থাকতে হতো না৷
এটা গেল মাত্র একজন বাংলাদেশির কথা৷ এমন কত শত বাংলাদেশি পুরো ইউরোপ জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন একটি দেশে আশ্রয়ের আশায়৷ বসনিয়ার কথা আপনারা সবাই জানেন৷ এইসব অভিবাসন-প্রত্যাশী কিন্তু বেশ শিক্ষিত৷ ১৫ থেকে ১৮ লাখ টাকা খরচ করে দালাল ধরে ইউরোপ পাড়ি দিয়েছেন৷ অথচ চাইলেই এর চেয়ে কম টাকায় ভাষা শিখে কোনো একটি বিশেষ কাজে প্রশিক্ষণ নিয়ে বৈধ পথে ইউরোপের কোনো দেশে আসা সম্ভব ছিল তাদের পক্ষে৷ হয়ত বলবেন ভাষা শেখাটা সহজ নয়৷ তাহলে আমি বলবো, এখন তারা যে পরিস্থিতিতে আছেন সেটা কি সহজ! আর ইটালিতে ঘুরতে গিয়ে আমি দেখেছি অনেক স্বল্প শিক্ষিত বাংলাদেশিরা কয়েক বছরেই চমৎকার সেদেশের ভাষায় কথা বলেন৷ অর্থাৎ, আপনি যে কাজটা এখানে আসার পর করতে বাধ্য, সেটা আগে থেকে করলে ঝঞ্ঝাটমুক্তভাবে সম্মানের সাথে থাকার সুযোগ পাবেন৷
এই যেমন ধরুন জার্মানিতে গত বছর অভিবাসনের যে নতুন আইন করা হয়েছে, তাতে কত সুবিধা আছে৷ এদেশে ৮ কোটি মানুষের মধ্যে দুই কোটি ৮০ লাখ মানুষ ষাটোর্ধ্ব৷ ফলে এখানে তরুণ জনশক্তির অভাব রয়েছে৷ জার্মানিতে ১০ লাখের বেশি দক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়েছে৷ এই ঘাটতি পূরণে নতুন অভিবাসন আইন করা হয়, যা ২০২০ সালের ১ মার্চ থেকে কার্যকর হয়েছে৷
নতুন আইনে যা আছে
১. নতুন আইনে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ডিগ্রিধারীদের পাশাপাশি কারিগরি প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের জন্যও আবেদনের সুযোগ আছে৷ তবে এই প্রশিক্ষণের মেয়াদ কমপক্ষে দুই বছরের হতে হবে এবং এই ডিগ্রি জার্মান ডিগ্রির সমান বলে অনুমোদিত হতে হবে৷
২. সার্টিফিকেট ঠিক আছে কিনা তা জার্মান শ্রম মন্ত্রণালয়ের ইনফরমেশন পোর্টালে গিয়ে যাচাই করে দেখা যাবে৷ কীভাবে যাচাই করা যাবে তার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে ‘মেক ইট ইন জার্মানি’ ওয়েবসাইটে৷
৪. ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে বসবাসকারীরাও জার্মানিতে চাকরির আবেদন করতে পারবেন৷
৫. কারিগরিশিক্ষার যে লেভেল ঠিক করা হয়েছে, তার চেয়ে কম যোগ্যরা চাকরির আবেদন করতে না পারলেও অভিবাসনের চেষ্টা করতে পারবেন৷ তবে শর্ত হচ্ছে, জার্মানির কোনো চাকরিদাতার কাছ থেকে তাদের চাকরির প্রস্তাব পেতে হবে৷ সেক্ষেত্রে চাকরিদাতাকে আবেদনকারীর জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং দুই বছরের মধ্যে তিনি যেন পেশাদার পর্যায়ের সার্টিফিকেট পেতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে৷
৬. যারা চাকরির সুযোগ পাবেন, তাদের চার বছর কিংবা চাকরির মেয়াদ পর্যন্ত ভিসা দেওয়া হবে৷ চার বছর পর তারা স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতির জন্য আবেদন করতে পারবেন৷
৭. জার্মান ভাষায় বি২ লেভেল পর্যন্ত দক্ষতা ও নিজের খরচ বহনের সামর্থ্য থাকলে জার্মানিতে এসে চাকরি খোঁজার অনুমতিও পাওয়া যাবে৷
৮. ৪৫ বছরের বেশি বয়সি আবেদনকারীদের মাসে কমপক্ষে ৩,৬৮৫ ইউরো আয় করতে হবে৷
৯. জার্মানিতে যেসব খাতে দক্ষ জনশক্তির অভাব প্রকট, যেমন চিকিৎসা, তথ্যপ্রযুক্তি, নার্সিং, সেসব ক্ষেত্রে আইন একটু শিথিল করা হয়েছে৷ অর্থাৎ, আবেদনকারীর যদি অন্তত পাঁচবছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলে জার্মান কর্তৃপক্ষের দ্বারা সার্টিফিকেট যাচাইয়ের যে শর্ত, তার আর প্রয়োজন পড়বে না৷
১০. যারা চাকরি পাবেন, তারা স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানদের জার্মানি নিয়ে আসতে পারবেন৷ অবশ্য সেক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের খরচ চালানোর সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে হবে৷
জার্মানিতে প্রায় সাত বছর থাকার পর এটা সহজেই বুঝতে পারি বৈধভাবে বিদেশে থাকাটা কত সম্মানের৷ বৈধভাবে অর্থ উপার্জন করছি, জার্মান সরকারকে ট্যাক্স দিচ্ছি, ফলে দুই বছরের মধ্যে পারমানেন্ট রেসিডেন্ট কার্ড পেয়ে গেছি৷ বি-২ পর্যায়ে ভাষা শেখা শেষ৷ এখন চাইলেই নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারি৷ তাই রাস্তায় যখন দু-একজন বাংলাদেশিকে দেখি বোতল কুড়াতে, তখন সত্যিই কষ্ট লাগে৷ নিজেদের সর্বস্ব বিক্রি করে সুন্দর জীবনের আশায় ইউরোপ পাড়ি দিয়ে এ কেমন জীবন কাটাচ্ছেন তারা!