ভারতে শিক্ষকদের আন্দোলন, প্রশ্ন
১৭ নভেম্বর ২০১৮পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক শিক্ষকরা ন্যায্য বেতনের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন৷ গত ২৯ ও ৩০ অক্টোবর কলকাতার শহীদ মিনারে বড় আকারের সমাবেশ করে প্রাথমিক শিক্ষকদের একটি সংগঠন৷ সেই সমাবেশে হাজির ছিলেন রাজ্যের বিরোধী দলের শীর্ষ নেতারা৷ এই সমাবেশের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দিয়েছে রাজ্য সরকার৷ এই সমাবেশের উল্লেখ না করলেও কাজের দিনে মিটিং-মিছিল করা নিয়ে যে হুঁশিয়ারি শিক্ষামন্ত্রী দিয়েছেন, তা ২৯ ও ৩০ অক্টোবরের সভা সম্পর্কে বলেই অনেকে মনে করেছেন৷
ওই সমাবেশের পর তৃণমূল প্রাথমিক শিক্ষকদের সংগঠনের সঙ্গে এক বৈঠকে পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সমাবেশ করতে হলে ছুটির দিনে করুন৷ ক্লাসের সময় নয়৷'' শুধু অনুরোধেই বিরত থাকেননি শিক্ষামন্ত্রী৷ তিনি বলেছেন, ‘‘স্কুলে অনুপস্থিত থেকেও পরে হাজিরা খাতায় সই করে দেবেন, ক্লাস কামাই করবেন, এসব মেনে নেওয়া হবে না৷ জেলা পরিদর্শক ও প্রশাসনকে এ বিষয়ে নজর রাখতে বলা হয়েছে৷ নির্দেশ অমান্য হলে শিক্ষকদের বেতন কেটে নেওয়া হবে৷''
শিক্ষামন্ত্রীর এই বক্তব্যের নেপথ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে বলে অনেকে মনে করছেন৷ বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির প্রাক্তন সভাপতি ও অল বেঙ্গল স্টেট এডুকেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক কার্তিক মান্না বলেন, ‘‘এ সব বাজে কথা৷ এই বাহানা করে আন্দোলন বন্ধ করার চেষ্টা৷ এর সঙ্গে বাস্তবের কোনো সম্পর্ক নেই৷ ছুটির দিনে আন্দোলন হয় না৷ প্রশাসনিক দপ্তর বা মন্ত্রীর অফিস, সবই তখন বন্ধ থাকে৷ তাই ছুটির দিন আন্দোলন করার পরামর্শ দেওয়া যায় না৷ শিক্ষকেরা ছুটি নিয়েই আন্দোলনে যোগ দেন৷ তাঁরা স্কুল কামাই করেন, অথচ হাজিরা খাতায় সই করে দেন, এটা হয় না৷''
যে শিক্ষক সংগঠনের সমাবেশ নিয়ে এত কথা উঠছে, তার নাম ‘উস্থি ইউনাইটেড প্রাইমারি টিচার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন'৷ এই সংগঠনের রাজ্য সম্পাদিকা পৃথা বিশ্বাস বলেন, ‘‘আমাদের সভার দিন দুটি সোম ও মঙ্গলবার হলেও তা পুজোর ছুটির মধ্যেই পড়েছিল৷ তখনই আমাদের সমাবেশ হয়েছিল৷ কোনো শিক্ষক স্কুল কামাই করে সমাবেশে আসেননি৷''
ওই সমাবেশে উপস্থিত হয়েছিলেন বিধানসভায় বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী৷ তিনি তাঁদের দাবি তুলে ধরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠিও লিখেছেন৷ সুজন চক্রবর্তী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সোম ও মঙ্গল হলেও পুজোর ছুটি ছিল৷ উনি যা বলেছেন, সেটা ওঁর দলই মানে না৷ যারা বিধানসভা ভাঙচুর করে, যারা চালু শিল্প নষ্ট করে, যারা প্রতিদিন একটা করে শিল্প বন্ধ করে দেয়, তাদের কাছ থেকে এসব জ্ঞানের কথা শোনার মানে হয় না৷''
পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষকদের কর্মসংস্কৃতি নিয়ে অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়৷ তাঁরা প্রায়ই ক্লাসের সময়ে মিটিং-মিছিলে যোগ দেন৷ ক্লাসের পঠনপাঠনে তাঁদের আন্তরিকতা নেই বলেও অভিযোগ করেন অনেকে৷ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে এই পরম্পরা৷ কিন্তু, কেন শিক্ষকদের প্রায়ই মিছিল বা সমাবেশ করতে হয়? পৃথা বিশ্বাস বলেন, ‘‘বেতন কাঠামোর সে অর্থে কোনো পরিবর্তন হয়নি৷ যোগ্যতামান অর্জন করেও আমাদের ন্যায্য বেতন দেওয়া হচ্ছে না৷ শিক্ষার অন্যান্য ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় হারে বেতন কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছে৷ শুধুমাত্র প্রাথমিক শিক্ষকদের ক্ষেত্রেই এই কাঠামো প্রায় আর্ধেক৷''
শিক্ষক সংগঠনগুলির মধ্যে অবশ্য বেতন বৃদ্ধির দাবি নিয়ে পরস্পরবিরোধ রয়েছে৷ পৃথা যা মনে করছেন, তার সঙ্গে পুরোপুরি একমত নয় শাসকদলের শিক্ষক সংগঠন৷ পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কৃষ্ণেন্দু বিষই বলেন, ‘‘দাবি তোলার অধিকার সকলেরই আছে৷ কিন্তু অন্যায় দাবি করা উচিত নয়৷ কেন্দ্রীয় সরকারের স্কেল অনুযায়ী বেতন দেওয়া সম্ভব নয়, রাজ্য সরকারের সীমাবদ্ধতার কথাও বুঝতে হবে৷ তার থেকে বড় কথা, বেতন কমিশন কাজ করছে৷ তারা শিক্ষকদের বেতনের বিষয়টিও খতিয়ে দেখছে৷ আশা করি, ইতিবাচক কিছু হবে৷'' তাঁর মতে, ‘‘স্কুল চলাকালীন শিক্ষকদের সভা-সমাবেশ করা ঠিক নয়৷ এতে পঠনপাঠনের ক্ষতি হয়৷ ছাত্রদের স্বার্থে পড়াশোনার সময় আন্দোলন করা অনুচিত৷ শিক্ষামন্ত্রী যা বলছেন, তা ভেবেচিন্তেই বলছেন, এটা বলার অধিকার তাঁর আছে৷ দল থেকে আমাদের পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া আছে, শনিবার স্কুল ছুটির পর সভা করা যেতে পারে৷''
সংশ্লিষ্টদের মতে, শিক্ষকদের মনে অনেকদিন ধরেই নানা বিক্ষোভ জমা হয়েছে৷ তা সে ডিএ বৃদ্ধি হোক বা স্পোর্টসের অনুদান হোক, সব ক্ষেত্রেই শিক্ষকেরা বঞ্চিত৷ তবে পৃথা বিশ্বাস বলেন, ‘‘আমরা রাজনীতির মধ্যে নেই৷ প্রায়ই যে মিছিল বা সভা করি, এমনটা নয়৷ এটা আমাদের শুধু বেতনের ব্যাপার নয়, সম্মানেরও ব্যাপার৷''
শিক্ষামন্ত্রীর বেতন কেটে নেওয়ার বার্তা শুনে কার্তিক মান্না বলেন, ‘‘ছুটি নিয়ে আন্দোলনে গেলে বেতন কাটার প্রশ্ন আসে না৷ তাহলে পরিষ্কার করেই বলুন যে, আন্দোলন করতে দেবো না৷ সে কারণেই বেতন কাটার প্রশ্ন আসছে৷ আসলে এটা যে জবরদস্তি আন্দোলন বন্ধ করার চেষ্টা, সেটা বোঝা যাচ্ছে৷''
আগামী ২৫ নভেম্বর কনভেনশনের ডাক দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি৷ দিনটি রবিবার৷ সরকারপন্থি শিক্ষকেরা শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশ অনুসরণ করছেন৷ এটিকে আগের জমায়েতের পালটা হিসেবেই দেখা হচ্ছে৷ তাহলে কি শুধু রবিবারই আন্দোলনের কর্মসূচি নিতে হবে? সুজন চক্রবর্তী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পাগলের মতো কথা বলছে৷ দাদাগিরি ও চোখ রাঙানোই একমাত্র কাজ তৃণমূলের৷ স্কুলের চৌকাঠ যারা মাড়ায়নি, তারা স্কুল-কলেজের শিক্ষা নিয়ে মাতব্বরি করবে, শিক্ষকদের হুমকি দেবে, এটাই আমাদের রাজ্যে দস্তুর৷''
বাম নেতার ক্ষোভ, ‘‘ভারতের মধ্যে সবচেয়ে কম বেতন পান পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষকেরা৷ সে ফুলটাইম হোক বা পার্টটাইম, প্যারাটিচার হোক বা চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক, এসএসকে হোক বা শিক্ষাবন্ধু — যে সরকার টাকা দেয় না, কর্মচারী- মাস্টারমশাইদের টাকা লুঠ করে মেলা-খেলা করে, তাদের এই হুমকি মেনে নেওয়া যায় না৷''
শিক্ষকরা যে দীর্ঘদিন ধরেই ক্লাসের সময়েই মিটিং মিছিল করেন, এটা অসংখ্য অভিভাবকের অভিজ্ঞতা৷ বারাসতের সঞ্জয় বিশ্বাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা আজকের কাল্ট নয়, বহুযুগ আগের৷ ছুটির দিন বাড়িতে থাকবেন শিক্ষকরা৷ স্কুলের দিন মিছিল করবেন৷ বাম আমল থেকেই এটা ছিল৷ শিক্ষামন্ত্রীর কথায় ভুল নেই, তবে হঠাৎ কী উদ্দেশ্যে তিনি এটা বললেন, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়৷ তবে পরিস্থিতি দ্রুত বদলাবে বলে মনে হয় না৷''
পায়েল সামন্তের এই লেখাটা আপনার কেমন লাগলো? জানান নীচের ঘরে৷