যাদবপুর কেন অন্যরকম
১২ জুলাই ২০১৮এবছর প্রায় ১৭ হাজার আবেদন জমা পড়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের ৬টি বিষয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য৷ হঠাৎই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতি এক বৈঠক ডেকে জানিয়ে দেয়, এবার থেকে শুধুই প্রবেশিকা পরীক্ষা নয়, ৫০ শতাংশ যোগ্যতামান নির্দিষ্ট হবে বোর্ডের পরীক্ষায় পাওয়া নম্বরের ভিত্তিতে৷ রাজ্য শিক্ষা দপ্তর সেরকমই চাইছে৷ এরপরই শুরু হয় ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিবাদ৷ তাঁদের বক্তব্য ছিল, এর ফলে একে তো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনের অধিকার খর্ব হচ্ছে, পাশাপাশি পিছনের দরজা দিয়ে অযোগ্য ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি করার রাস্তাও খুলে দেওয়া হচ্ছে৷ প্রতিবাদে শুরু হয় অবস্থান-বিক্ষোভ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাসকে ঘেরাও৷ ঘটনা পরম্পরা জটিল থেকে জটিলতর হতে শুরু করে৷ ৯ জুন প্রবেশিকা পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল, ১৫ জুন কর্মসমিতির বৈঠকে সেই পরীক্ষার বিরুদ্ধে মত দেন অধিকাংশ সদস্য৷ রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেলের পরামর্শ মেনে আলোচনার পর প্রবেশিকা পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় পূর্ব নির্ধারিত তারিখেই৷ ৪ জুলাই ফের সেই পরীক্ষা বাতিল ঘোষণা করে নতুন নিয়মে ভর্তির দিনক্ষণ ঘোষণা করা হয়৷ ১০ জুলাই আবারও সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করে প্রবেশিকা পরীক্ষাই বহাল রাখা হয়৷ কর্মসমিতির আগের বৈঠকে অধ্যাপকদের যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ প্রবেশিকার বিরুদ্ধে মত দিয়েছিলেন, তাঁরাই এবার সায় জানান, কিন্তু ভেতরে ক্ষোভ পুষে রেখে৷ সিদ্ধান্ত বদলের কারণ হিসেবে তাঁরা ছাত্র-ছাত্রীদের একগুঁয়ে মনোভাব এবং বাইরের রাজনৈতিক চাপকে দায়ী করেন৷
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এখন থেকে যাদবপুর কলা বিভাগের ৬টি বিষয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষার দায়িত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও থাকবেন৷ আগে যেমন দুটি সেট প্রশ্নপত্র তৈরি হতো, যার একটি করতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের বিশিষ্ট অধ্যাপক-শিক্ষাবিদরা, সেরকম কি তা হলে আর হবে না? খাতা দেখার ক্ষেত্রেও কি বাইরের কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হবে না? সেই বিষয়টি এখনও পরিষ্কার নয়৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার জানাচ্ছেন, এই পরীক্ষার ‘আউটসোর্সিং' হবে না৷ বাইরের কোনও প্রতিষ্ঠান এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকবে না৷ বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরাও এখন থেকে এর সঙ্গে যুক্ত থাকবেন৷ কিন্তু তাঁদের সঙ্গে বাইরের কোনও অধ্যাপকও থাকবেন কিনা, সেটা এখনও যথেষ্ট স্পষ্ট নয়৷ এদিকে প্রবেশিকা বিতর্কের আপাতত নিষ্পত্তি ঘটলেও ক্ষুব্ধ উপাচার্য সুরঞ্জন দাস পদত্যাগ করার কথা ভাবছেন বলে খবর৷ কেন তিনি দায়িত্ব ছাড়তে চাইছেন, সেটা নিয়েও বিভ্রান্তি আছে৷
প্রশ্ন উঠছে, কেন যাদবপুরের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রবেশিকা পরীক্ষা চালু রাখার পক্ষে? তাঁদের বক্তব্যও যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য, যা অনেকটাই শিক্ষা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মুক্ত ধ্যান-ধারণার প্রতিধ্বনি ঘটাচ্ছে৷ তাঁরা বলছেন, একজন ছাত্র বা ছাত্রী কী পড়বে, তার কী পড়া উচিত, সেটা তার পরীক্ষায় পাওয়া নম্বরের ভিত্তিতে ঠিক করা উচিত নয়৷ কারণ, এমন হতেই পারে যে, সে পরীক্ষায় ভালো ফল না করলেও ওই নির্দিষ্ট বিষয়ে তাঁর স্বাভাবিক প্রবণতা এবং দক্ষতা আছে, যা কেবল প্রবেশিকা পরীক্ষা বা ইন্টারভিউয়ের মধ্যে দিয়েই বোঝা যায়৷ কাজেই যাঁরা বলছেন যে, প্রবেশিকা পরীক্ষা স্রেফ নিজেদের পছন্দের লোকজনকে ভর্তি করার কৌশল, তাঁরা ঠিক বলছেন না৷ এটা বরং যথার্থ পদ্ধতি, যেখানে পরীক্ষার মার্কশিটের বাইরে থাকা প্রতিভাকে শনাক্ত করা, তাকে বিকশিত করার সুযোগ দেওয়া যাবে৷ শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য যা হওয়া উচিত৷যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগের প্রাক্তনী, বর্তমানে দিল্লির অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং দেশের অন্যতম নামী অনুবাদক অরুণাভ সিনহা ডয়চে ভেলেকে ঠিক সেই কথাই বললেন৷ নিজের দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছেন, কৃতবিদ্য মানুষদের অনেকেরই পরীক্ষার ফল অত ভালো ছিল না৷ কিন্তু নিজেদের বিষয়ে, নিজেদের কাজে তাঁরা অসামান্য দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন৷ তাঁরাই নতুন জিনিস ভাবতে পেরেছেন, অন্যকে ভাবতে উৎসাহিত করেছেন৷ অরুণাভর মতে, শিক্ষাক্ষেত্রে এই মুক্ত ভাবনার পরিসর থাকা অত্যন্ত জরুরি৷ কারণ, প্রতিভা বা স্বাভাবিক দক্ষতা সবসময় পরীক্ষার মার্কশিটে প্রতিফলিত হয় না!