বিপর্যয়ের আগেই আঁচ করতে হয়
২৭ মে ২০২২এক সময় পশ্চিমবঙ্গের হাওয়া অফিস নিয়ে মুখে মুখে রসিকতা ঘুরতো৷ বলা হতো, হাওয়া অফিস যা বলবে, ফল হবে ঠিক তার উল্টো৷ তারা যদি বলে ঝড় হবে, তাহলে ধরেই নেওয়া যায়, রোদ ঝলমলে দিন উপহার পাওয়া যাবে৷ ঝকঝকে রোদ উঠবে বললে সঙ্গে ছাতা রাখা বাঞ্ছনীয়৷
সে দিন গেছে৷ হাওয়া অফিসে আধুনিক যন্ত্রপাতি এসেছে৷ হাওয়া মোরগ বাতাস চিনতে শিখেছে৷ আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস এখন মোটের উপর মিলে যায়৷ শুধু তা-ই নয়, হাওয়া অফিসের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে আধুনিক হয়েছে রাজ্য এবং দেশের বিপর্যয় ম্যানেজমেন্ট দল৷ সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়ে পূর্বাভাস থাকলে ঘটনার আগেই তারা ঘোষিত অঞ্চলে পৌঁছে যায়, সাধাররণ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেয়৷ ফলে একসময় ওড়িশার সুপার সাইক্লোন, এমনকী, দেড় দশক আগের আমফানের চেয়ে এখন বড়সড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রাণহানি কম হয়৷ কিন্তু মৃত্যু এড়ানো যায় কী?
বড়সড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়, সাধারণ ঝড়-বৃষ্টিতেও পশ্চিমবঙ্গে প্রাণহানি ঘটে৷ গ্রামেগঞ্জেও নয়, খোদ শহরে৷ যা রোধ করা বিপর্যয় ম্যানেজমেন্ট দলের কর্ম নয়, হাওয়া অফিসেরও নয়৷ এর দায় প্রশাসনের৷
একটি হালের উদাহরণ দেওয়া যাক৷ ২০২১ সালের মে এবং সেপ্টেম্বর মাসে নিম্নচাপের বৃষ্টিতে আচমকাই বাণভাসী হয় কলকাতা এবং শহরতলি৷ একসঙ্গে অনেকটা বৃষ্টিপাত খুব কম সময়ে হলে নিকাশিনালা উপচে এমন বন্যা খুব অস্বাভাবিক নয়৷ একইসঙ্গে গঙ্গায় জলস্তর উপরে থাকলে শহরের জল বাইরে যেতে পারে না৷ এসমস্যা নতুন নয়, সেই ব্রিটিশ আমলের৷ গত কয়েকদশকে কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থার ভালোই উন্নতি হয়েছে৷ কিন্তু নাগাড়ে বৃষ্টি হলে জল জমবেই৷ সেই জমা জলে বিদ্যুৎসৃষ্ট হয়ে চার মাসের মধ্যে অন্তত বিশজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷ তার মধ্যে বাচ্চা-বুড়ো সকলে আছে৷
এমন নয় যে, গ্রামেগঞ্জে আচমকা এমন ঘটে গেছে৷ খোদ কলকাতা শহরের ফ্ল্যাটে এ ঘটনা ঘটেছে৷ কেন ঘটেছে? কারণ, এখনো কলকাতা শহরে বিদ্যুতের তার খোলা পড়ে থাকে৷ জল জমলে সেই তার অদৃশ্য হয়ে যায়৷ জলে বিদ্যুৎ সঞ্চারিত হয়৷ এবং বেঘোরে প্রাণ যায় মানুষের৷
ইউরোপ থেকে আসা এক বন্ধুকে এই ঘটনার কথা বলায় বুঝতেই সময় নিয়েছিল বেশ কয়েকমিনিট৷ একুশ শতকে ভারতের অন্যতম নামজাদা শহরে এমন যে সম্ভব, সে কল্পনাও করতে পারেনি৷
শুধু-ই কি তা-ই? এখনো শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা থাকে৷ রাস্তায় জল জমলে বোঝাও যায় না, মৃত্যু ফাঁদ অপেক্ষা করছে৷ ম্যানহোলে পড়েও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে৷ এই দুর্ঘটনাগুলি এড়ানোর জন্য বিরাট বিপর্যয় প্রতিরোধ দল প্রয়োজন হয় না৷ সারা বছর প্রশাসনকে একটু সতর্ক থাকতে হয়৷ বিদ্যুতের তার ঠিক আছে কি না, ম্যানহোলের ঢাকনা লাগানো আছে কি না, এসব খেয়াল রাখা খুব কঠিন কাজ নয়৷ কিন্তু কে না জানে, রাজনীতি ছেড়ে প্রশাসনের এতকিছু দেখার সময় থাকে না৷ ফলে মৃত্যু ঘটতেই থাকে৷
এবার যাওয়া যাক উপকূলের দিকে৷ বঙ্গোপসাগর লাগোয়া অঞ্চল এবং সুন্দরবন ইদানীং ঝড়ঝাপটার এপিসেন্টার হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ প্রাকৃতিক দুর্যোগকে রোখা মানুষের কাজ নয়৷ কিন্তু দুর্যোগের সময় মানুষকে নিরাপদে রাখা সরকারের কাজ৷ গত কয়েকবছরে সে কাজ বেশ ভালোভাবেই হয়েছে৷ উপকূলবর্তী অঞ্চল এবং সুন্দরবনে প্রচুর ফ্লাডসেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে৷ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে মানুষের মৃত্যু এখন আগের চেয়ে অনেক কম হয়৷ কিন্তু সমস্যা শুরু হয় দুর্যোগ কেটে যাওয়ার পরে৷ সুন্দরবনের গ্রামগুলির মানুষ জানেন, জলতলের নীচে থাকা স্থলভূমিতে একবার নোনা জল ঢুকে গেলে বছরের পর বছর জমি অ-চাষযোগ্য হয়ে যায়৷ মাটির বাড়িতে জল ঢুকে গেলে দেওয়াল নরম হয়ে ভেঙে পড়ে৷ নতুন করে বাড়ি তুলতে সময় লেগে যায় অনেক বছর৷
এই বিপর্যয়গুলি কি আটকানো যায় না? প্রকৃতির খেয়াল রোখা না গেলেও কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে, কিছু অগ্রিম ব্যবস্থা নিলে এই বিপর্যয় খানিকটা হলেও রোখা যায়৷ সুন্দরবন কি জানে না সে কথা? আলবাৎ জানে৷ জানে সরকারও৷ তাই প্রতি বছর সুন্দরবনে বাঁধ তৈরির জন্য কোটি কোটি টাকা ধার্য করে সরকার৷ সে টাকা সুন্দরবনে পৌঁছানোর পর ঠিকাদারের হাতে যায়৷ মাঝে কিছু রহস্যজনক ঘটনা ঘটে বলে শোনা যায়৷ এবং শেষপর্যন্ত খানিকটা বাঁধ তৈরি হয়, বাকিটা পড়ে থাকে আগের মতোই৷ প্রকৃতি যেহেতু বাঁধ দেখে বিপর্যয় ঘটায় না, তাই গোটা এলাকাই প্লাবিত হয়৷ মানুষের সমস্যা সমস্যাই থেকে যায়৷
আরো আশ্চর্য বিষয় আছে৷ কংক্রিটের বাঁধের ভিতর দিয়ে পাইপ ঢুকিয়ে ভেড়িতে জল আনার ব্যবস্থা করেন অনেকে৷ বিপর্যয় যখন আসে, তখন সেই বেআইনি পাইপের জায়গা দিয়েই বাঁধে ভাঙন ধরে৷ সরকার, প্রশাসন সকলেই এসব কথা জানে, কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হয় না৷
ছোট ছোট এই বিষয়গুলি খেয়াল রাখলে বিপর্যয় মোকাবিলা আরো সহজ হতো৷ কিন্তু তার জন্য যে সততা প্রয়োজন, ভবিষ্যৎ তা দেখতে পাবে বলে কোনো অভিযোগ নেই!
গতবছর সেপ্টেম্বরের ছবিঘরটি দেখুন...