কলকাতায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত ১৩, দায় নেবে কে?
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ভয়াবহ বৃষ্টি যে হবে, তা অজানা ছিল না। অজানা ছিল না, ওই বিপুল পরিমাণ বৃষ্টির জল সহজে বার করা কঠিন। তবু প্রশাসনের যতটা সতর্ক হওয়া দরকার ছিল, তার ছিটেফোটা দেখা গেল না। বলি হলো ১৩টি প্রাণ। যার মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ুয়া আছে। ১৫ বছরের বালক আছে। আস্ত একটি পরিবার আছে। সামান্য অর্থের ক্ষতিপূরণ দিয়ে দায় এড়াতে চাইছে প্রশাসন।
নিকাশি ব্যবস্থার হাল
গত এক সপ্তাহ ধরে বিপুল বৃষ্টিপাত হয়েছে কলকাতায়। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের কারণেই ওই বৃষ্টিপাত হয়েছে। শনি এবং রোববার ফের বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা। এরই মধ্যে বিপুল বর্ষায় কলকাতা সহ গোটা পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলমগ্ন। একে ঠিক বন্যা বলা যায় না। বৃষ্টির জলে নিকাশি নালাগুলি ভরে যাওয়ার কারণেই বিভিন্ন শহরে জল জমে আছে। জল জমে আছে কলকাতার একাধিক এলাকায়। প্রথম প্রশ্ন, কেন দুই-তিনদিন সময় লাগল জল বার করতে। শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে পাম্পিং স্টেশন তৈরি করে তাহলে লাভ কী হলো?
এ প্রশ্নের দুই-তিনরকম উত্তর আছে বিশেষজ্ঞদের কাছে। কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থার ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেছেন সায়ন্তন দাস। তার বক্তব্য, কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থা লন্ডনের ধাঁচে তৈরি। ইংরেজরা ভেবেছিলেন, লন্ডন এবং কলকাতায় সমান বৃষ্টিপাত হয়। সেই মতো শহরের ভূগর্ভস্থ নিকাশি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ইংরেজরা যা বোঝেননি তা হলো, লন্ডনে সারা বছর যা বৃষ্টি হয়, কলকাতায় তা তিনমাসে হয়। সে কারণেই সেই তখন থেকে কলকাতায় জল জমার সমস্যা শুরু। এতদিন হয়ে গেছে, কোনো সরকারই তার সমাধান করতে পারেনি।
একেবারেই কি পারেনি? বাম আমলে এবং বর্তমান সময়ে কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক পাম্পিং স্টেশন তৈরি করা হয়েছে। বৃষ্টি হলে যাতে পাম্পের সাহায্যে জল সরাসরি খালে ফেলা যায়। অভিযোগ, পাম্প এবং খালগুলির রক্ষণাবেক্ষণ ঠিক মতো হয় না। তাই দরকারের সময়ে তা ঠিকমতো ব্যবহার করা যায় না। খালের জলও উপচে পড়ে। নিকাশি ব্যবস্থাও সময়মতো পরিষ্কার করা হয় না বলে অভিযোগ আছে।
বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঘটনা
সমস্যা শুধু জল জমা নয়। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বিদ্যুৎ পাঠানোর জন্য যে ল্যাম্পপোস্ট তৈরি করা হয়েছে তার অধিকাংশই অসুরক্ষিত। বৃষ্টির জমা জলে তাই বিদ্যুৎ ছড়িয়ে পড়ছে। গত কয়েকদিনে এর ফলে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। কলকাতার নগরায়ন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন স্বপন মুখোপাধ্যায়। ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, সেই বাম আমল থেকে আলোচনা হচ্ছে যে, শহরের রাস্তায় খোলা বিদ্যুতের লাইন আর রাখা হবে না। তা ভূগর্ভস্থ লাইনের সাহায্যে বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হবে। তৃণমূল আমলেও সেই একই কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। যার বলি হতে হলো অন্তত ১৩ জনকে।
শাক দিয়ে মাছ ঢাকা
বরাবরের মতো এবারেও সরকার শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছে। মৃতদের পরিবারগুলিকে দুই লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে। দমদমে ষষ্ঠ শ্রেণির দুই ছাত্রী বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছে। তাদের একজনের পরিবার দুই লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী এবং দমদমের সাংসদের কাছে তারা প্রশ্ন করেছেন, দুই লাখ টাকা কি তাদের মেয়েকে ফিরিয়ে দিতে পারবে? মৃত ছাত্রীর মা বলেছেন, সব বিক্রি করে দিয়ে সরকারকে চার লাখ টাকা দিতে তিনি রাজি আছেন। শুধু তার মেয়েকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক।
রাজনীতির বিতর্ক
স্বাভাবিক ভাবেই বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেছেন, বিরোধীরা মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করার চেষ্টা করছেন। তার কথায়, ''বিরোধীরা চেঁচামেচি করে আসর গরম করার চেষ্টা করছেন। এ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই।'' ব্রাত্য বসুর ইঙ্গিত স্পষ্ট। তিনি মৃতদের পরিবারের সঙ্গে বিরোধী রাজনীতির যোগ আছে বলে অভিযোগ তুলছেন।
কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী আবার গোটা বিষয়টির জন্য রাজ্য সরকারের দিকে আঙুল তুলেছেন। তার বক্তব্য, ''মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভবানীপুরে গিয়ে সব ভোট তাকে দিতে বলছেন। নইলে না কি উন্নয়ন হবে না। বাস্তবে উন্নয়নের চেহারা আমরা দেখতে পাচ্ছি। সাধারণ পরিকাঠামোর দূরাবস্থা সকলেই দেখতে পাচ্ছেন।''
একই অভিযোগ করেছেন সিপিএম নেতা রবিন দেব। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ''বৃষ্টি হলে জল জমতে পারে, এ কথা সকলেই জানেন। কেন সরকার আগে থেকে ব্যবস্থা নেয় না! কেন সময় মতো বিদ্যুতের তারের সংস্কার করা হয় না।''
অনেকের প্রশ্ন, জল বিদ্যুৎ ছড়িয়ে পড়তে পারে, এ কথা বুঝেও কেন সময় মতো বিভিন্ন এলাকার বিদ্যুৎসংযোগ বন্ধ করা হয়নি? তা করা হলে ১৩ জনের প্রাণ বাঁচতো।
মালদা থেকে দমদম, খড়দা থেকে টিটাগড়-- সর্বত্রই বিদ্যুৎসৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। প্রশাসন কি এবারেও কোনো ব্যবস্থা নেবে না? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেওয়ার হলে আগেই নিত। আমফানের পরেও বিদ্যুৎসৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল। প্রশাসন তখনো বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছিল। এবারেও এড়িয়ে যাচ্ছে।