‘বিদ্যুৎ-পানির দাম বাড়ছে, আয় তো বাড়ছে না’
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০একটি বেসরকারি ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার রুবিনা আক্তার খানম ডয়চে ভেলের কাছে জানতে চান, ‘‘বছরে বেতন বাড়ে সামান্য কয় টাকা, খরচ বাড়ে চারদিক দিয়ে৷ তাহলে আমরা চলবো কিভাবে?’’ যারা এসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তারা সাধারণ মানুষের খবর রাখেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তিনি৷
গত কয়েকমাস ধরে পেঁয়াজ-রসুনসহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নিয়ে চরম অস্বস্তিতে রয়েছেন সাধারণ মানুষ৷ এর সঙ্গে এবার যুক্ত হলো বিদ্যুৎ ও পানির দাম৷ বিশেষ করে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে চাপে পড়বেন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন৷
অধ্যাপক এম শামসুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিদ্যুৎ এমন পণ্য যেটার মূল্য বাড়লে সঙ্গে আরো অনেক কিছুই বাড়ে৷ পুরো জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়৷ এতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে৷ আসলে এই সেক্টরে সরকার যে ৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়, সেটা এখন আর দিতে চাচ্ছে না৷ এখন এই মূল্য বৃদ্ধির ফলে এই সেক্টর থেকে সরকার তিন হাজার কোটি টাকা তুলে নেবে৷ এতে সরকারের সার্বিক আয় খুব একটা বাড়বে বলে মনে হয় না৷ কারণ, মানুষের তো আয় বাড়ছে না৷ তাহলে সে কী করবে? খরচ কমিয়ে দেবে৷ কেনা-কাটা কমিয়ে দেবে৷ তাতে সরকার ট্যাক্স, ভ্যাট কম পাবে৷ দিন শেষে মানুষ কষ্টে থাকবে, সরকারের খুব একটা আর্থিক লাভ হবে না৷ শুধু অযোগ্য দুর্নীতিবাজরা লাভবান হবে৷’’
পহেলা মার্চ থেকে বিদ্যুৎ ও পানির দাম বৃদ্ধি কার্যকর হবে৷ ফলে চাহিদা অনুসারে সরবরাহ না মিললেও এপ্রিল থেকে গ্রাহককে পানি ও বিদ্যুতের জন্য অতিরিক্ত টাকা গুনতে হবে৷ বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি সারা দেশের জন্য প্রয্যেজ্য হলেও পানির দাম বৃদ্ধি কার্যকর হবে শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরীর গ্রাহকদের জন্য৷ সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিটের (কিলোওয়াট/ঘণ্টা) জন্য গড়ে ৩৬ পয়সা করে বেশি দিতে হবে৷ ঢাকা ওয়াসার প্রতি হাজার লিটার পানিতে আবাসিকে বেড়েছে ২৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ ও বাণিজ্যিক ৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ৷ চট্টগ্রাম ওয়াসার আবাসিক প্রতি হাজার লিটার পানিতে ২৫ শতাংশ এবং বাণিজ্যিকে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ দাম বেড়েছে৷ দাম বৃদ্ধির সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের উপর৷
রুবিনা আক্তার খানমের প্রশ্ন, ‘‘এভাবে প্রতি বছর বিদ্যুৎ-পানির দাম বাড়লে মানুষ কিভাবে চলবে?'' কিভাবে খরচ ম্যানেজ করবেন? এই প্রশ্নের জবাবে রুবিনা খানম বলেন, ‘‘আমাদের দৈনন্দিন যে চাহিদা আছে, সেটা কমাতে হবে৷ এছাড়া তো কোনো উপায় নেই৷ কারণ, যে আয় তার মধ্যেই তো চলতে হবে৷ টাকা তো আর ইচ্ছে করলেই বাড়াতে পারবো না৷’’
কারওয়ান বাজারের চায়ের দোকানি শাহজাহান আলী বলেন, ‘‘যারা চাকরি করেন, তাদের তো মাস শেষে একটা আয় আছে৷ কিন্তু আমরা যারা ছোট দোকানি, তাদের সমস্যা তো আরো বেশি৷ চা-বিস্কুট বেঁচে কয় টাকা আয় হয়? মানুষের পকেটে টাকা না থাকলে তা-ও খেতে চায় না৷ আমাদের আয়ও কমে যায়৷ দুই সন্তান আর স্ত্রী-কে নিয়ে কোনোভাবে বেঁচে আছি৷ এখন মনে হচ্ছে, এসব বাদ দিয়ে গ্রামে চলে যেতে হবে৷’’
শাহজাহানের চায়ের দোকানে তখন বসে কথা বলছিলেন রিক্সা চালক রফিকুল ইসলাম৷ পঞ্চাশোর্ধ এই রিক্সাচালক বলছিলেন, ‘‘সারাদিন রিক্সা চালিয়ে মালিকের জমা বাদে ৫শ' টাকা ঘরে নেওয়া কঠিন৷ গত এক সপ্তাহে চালের দাম কেজিতে ৩/৪ টাকা বেড়েছে৷ পেঁয়াজ খাওয়া তো ছেড়েই দিয়েছি৷ এখনো পেঁয়াজের দাম একশ' টাকার বেশি৷ এবার বিদ্যুৎ-পানির দাম বাড়লে আমরা কিভাবে বাঁচবো? আমাদের দুঃখগুলো কি দেখার কেউ নেই? আরেক রিক্সাচালক মো. খোরশেদও বলছিলেন তার কষ্টের কথা, ‘‘স্যার, সত্যি চলতে কষ্ট হয়৷ বউ-বাচ্চাদের গ্রামে রেখেছি, সব মিলিয়ে মাসে ৬-৭ হাজার টাকার বেশি পাঠাতে পারি না৷ মেয়েটার স্কুলের বেতনও চেয়েচিন্তে দিতে হয়৷ ওরা মাছ খায় সপ্তাহে একদিন৷ আসলেই আমাদের বাঁচা কঠিন৷’’
মিরপুরের শেওড়াপাড়ার শামীম সরণীর মুদি দোকানি আসলাম শেখ বলছিলেন, ‘‘এখন কিছু মানুষ দাম বাড়ানোর জন্য সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকে৷ বিদ্যুতের দামের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক না থাকলেও অনেক কিছুর দামই বেড়ে যাবে৷ বাস ভাড়া, বাসা ভাড়া, এমনকি রিক্সা ভাড়াও বেড়ে যাবে৷ তাহলে সাধারণ মানুষ চলবে কিভাবে? আমাদের দোকানে বিক্রিও কমে যাবে৷ কারণ, মানুষের আয় তো বাড়ছে না৷ তারা বাসার কেনাকাটা কমিয়ে দেবে৷ খাওয়া কমিয়ে দেবে? তা না হলে চলবে কিভাবে? এভাবেই বাঁচতে হবে সাধারণ মানুষকে৷’’