‘বিটিভি বন্ধ করে দেয়াই ভালো’
১৫ এপ্রিল ২০১৩সম্প্রতি বাংলাদেশের ‘কালের কণ্ঠ' পত্রিকায় একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে৷ সেখানে এটিএন নিউজের নিউজ অ্যান্ড কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স-এর এডিটর প্রভাষ আমিন দেখিয়েছেন বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)--কে কী কী কারণে আর টেনে নেয়ার মানে হয়না৷ যুক্তিগুলো অকাট্য৷ বিটিভির খবর অনেকদিন আগেই বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে৷ সরকারের প্রতি অতিরিক্ত আনুগত্যের কারণে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা সেখানে অবাস্তব চাওয়া৷ সরকার আসে সরকার যায়, কিন্তু বিটিভি বদলায়না৷ একটা সময় পর্যন্ত খবর বর্জন করলেও অন্যান্য অনুষ্ঠানের কারণে দেশের মানুষ বিটিভি আগ্রহ নিয়েই দেখতেন৷ অসাধারণ সব নাটক হতো৷ সঙ্গীতানুষ্ঠান, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, ইংলিশ মুভি – এসবের আকর্ষণও ছিল দুর্দম্য৷ তাই খবর নিয়ে শত বিদ্রূপ চললেও বিটিভির দর্শক ছিল৷ কিন্তু বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো আসতে শুরু করার পর থেকে কোথায় প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য অনুষ্ঠানের মান ভালো করা হবে, তা নয়, যত দিন গেছে ততই গণবিচ্ছিন্ন হতে হতে বিটিভির দুর্দশা এখন চরমে৷
প্রভাষ আমিন অবস্থার ভয়াবহতা উপলব্ধি করেছেন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান মারা যাওয়ার পর৷ প্রয়াত রাষ্ট্রপতির মরদেহ সিঙ্গাপুরের হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসার পর বিটিভি দুটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে দুটি বেসরকারি টেলিভিশনের মাধ্যমে৷ অথচ সেই ১৯৬৪ সালে যাত্রা শুরুর দিন থেকে সব রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের সরাসরি সম্প্রচার মানেই ছিল বিটিভি৷ সব গেলেও এতদিন এইটুকু ধরে রাখা হয়েছিল৷ কখনো কখনো দেশ-বিদেশের খেলা এবং অন্যান্য কিছু অনুষ্ঠান দেখিয়ে উপযোগিতার একটা জায়গা অন্তত ধরে রেখেছিল৷ রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর অনুষ্ঠানে যেন শেষ অহঙ্কারটুকুও বেসরকারি চ্যানেলের হাতে তুলে দিলো বিটিভি! প্রভাষ আমিনের প্রশ্ন – তাই যদি হবে তাহলে বিটিভির আর কী দরকার?
কালের কণ্ঠে প্রকাশিত ‘বিটিভি বন্ধ হলে ক্ষতি কী ?'- শিরোনামের লেখাটি নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টেও শেয়ার করেছিলেন প্রভাষ৷ পক্ষে-বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া এসেছে বেশ৷ পক্ষেই বেশি৷ সরকার প্রচারের জন্য রাষ্ট্রীয় মাধ্যমকে ব্যবহার করতেই পারে, কিন্তু সেই মাধ্যমের যদি কোনো গ্রহণযোগ্যতাই না থাকে, তাহলে তো সেটা চালিয়ে যাওয়ায় সরকারের লাভ নেই, জনগণেরও ক্ষতি – এ অবস্থায় বিটিভি বন্ধ করে দিলে ক্ষতি কী? দীর্ঘদিন দৈনিক সংবাদপত্রেও কাজ করা প্রভাষ আমিনের এই যুক্তি অনেকেই মেনে নিয়েছেন৷ তবে কারো কারো প্রশ্ন ছিল, ‘‘বন্ধ করে দিলে অনেকে চাকরি হারাবেন৷ তাঁদের কী হবে?'' এ সাক্ষাৎকারে প্রভাষ এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন সাংবাদিকতার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে, সব দিক বিবেচনা করে৷ বাংলাদেশে সাম্প্রতিক অতীতে দু দুটি চ্যানেল বন্ধ হয়েছে৷ সেই দুটো প্রতিষ্ঠানের কেউ বেকার নেই দাবি করে প্রভাষ বলেন, ‘‘বাংলাদেশে কাজ জানা লোকের কাজের অভাব হয়না৷ তা ছাড়া টিভি চ্যানেলগুলোতে এখনো যোগ্য লোকের অনেক চাহিদা৷''
কিন্তু বিটিভিতে কি খুব একটা যোগ্য লোক আছে? প্রশ্নটি ওঠে অনুষ্ঠানের মানের কারণে৷ যোগ্য লোক যদি থাকবেই তাহলে যেখানে ‘যদি কিছু মনে না করেন', ‘শুভেচ্ছা', ‘জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা'র মতো জনপ্রিয় অনুষ্ঠান, ‘সংশপ্তক', ‘কোথাও কেউ নেই', ‘বহুব্রীহি' ‘নক্ষত্রের রাত', ‘ঢাকায় থাকি'-র মতো ধারাবাহিক নাটক এবং ‘ডালাস', ‘নাইট রাইডার', ‘ম্যাকগাইভার', ‘দ্য বিল কসবি শো', ‘ দ্য এক্স-ফাইলস', ‘থান্ডার ক্যাটস'-এর মতো লোকপ্রিয় ইংরেজি মুভি ছিল, এখন ‘ইত্যাদি' ছাড়া আর কোনো অনুষ্ঠানই কেন সেখানে দর্শক টানতে পারেনা? সব অনুষ্ঠানের পেছনে যে বিটিভির কর্মীদের দক্ষতা খুব জরুরি তা-ও তো নয়৷ তাই এ প্রশ্নের উত্তরে প্রভাষ কিছুটা দ্বিধান্বিত৷ বিটিভির অনেকে এখন বেসরকারি চ্যানেলে দায়িত্বশীল পদে দক্ষতার ছাপ রাখছেন – এই বাস্তবতা তাঁকে বিটিভির কর্মীদের প্রতি আস্থাশীলই হতে বলছে৷ কিন্তু বিটিভির কাজে তার কোনো প্রমাণই না পেয়ে সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে তিনি জানিয়েছেন, তাঁর ধারণা, বিটিভির সবাই স্রেফ ‘করতে হয়' বলেই চাকরি করছেন, কাজে কোনো আন্তরিকতা নেই তাঁদের৷
দর্শক দেখছে না, যাঁদের সব অনুষ্ঠান দেখার উপযোগী করে পরিবেশন করাটা দায়িত্ব তাঁরা আন্তরিকভাবে সেই দায়িত্ব পালন করছেনও না – অবস্থা যদি এমনই হয়, তাহলে বিটিভি খোলা রেখে কী লাভ? বন্ধ করার ভাবনা দূরে রেখে আর কী করা যেতে পারে? স্বায়ত্তশাসন দিয়ে দেয়া৷ এ দাবি অনেক দিনের৷ কিন্তু অতীতের সরকারগুলোর মতো বর্তমান সরকারও এ নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়নের পথে এগোয়নি৷ বিটিভিও পড়ে আছে সেই তিমিরে৷ বাংলাদেশে অতীতে জিয়া সার কারখানাসহ বেশ কিছু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে, অথচ বাধ্য না হলে একজন মানুষও অনুষ্ঠান দেখেননা এমন প্রতিষ্ঠান বিটিভি আছে রামপুরার বিশাল জায়গা আর দেশের সেরা অবকাঠামোর নিষ্ফলা অহঙ্কার নিয়ে৷
এভাবে আর কতদিন? প্রভাষ আমিন মনে করেন, হয় স্বায়ত্তশাসন নয়তো বন্ধ করে দেয়া- বিটিভির জন্য এর যে কোনো একটা বিকল্প বেছে নেয়া উচিত অবিলম্বে৷
বিটিভি নিয়ে এই পর্বের পর বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর দিকেও তাকাবো আমরা৷ প্রভাষ আমিনই বলবেন, খুব আশা জাগিয়ে শুরু করে বিটিভির অস্তিত্ব এবং প্রয়োজনীয়তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারলেও বেসরকারি চ্যানেলগুলোর এখন কী অবস্থা? সেখানেইবা আশার আলো কতটা? সুস্থ প্রতিযোগিতা, দক্ষতা, দায়িত্বশীলতার ছাপ কতটুকু আছে সেখানে?