বিজেপি নেতা হলেও বিশ্বাসে ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা
১৭ আগস্ট ২০১৮‘‘ভারত যদি ধর্মনিরপেক্ষ না থাকে, তাহলে ভারত আর ভারত থাকবে না!'' বলেছিলেন ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী৷ রাজনৈতিক বহুমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকাতেও তিনি ছিলেন অটল৷
অটলবিহারী বাজপেয়ীর সম্বন্ধে সবথেকে মিথ্যে, অথচ সর্বাধিক প্রচারিত গুজবটি হলো, ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়ো' আন্দোলনে যোগ দিয়ে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তিনি মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেয়েছিলেন৷ শর্ত ছিল, তিনি আন্দোলনের নেতাদের সম্পর্কে গোপনে খবর দেবেন ব্রিটিশ সরকারকে৷
সোজা কথায়, তিনি ব্রিটিশদের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের ওই তুঙ্গ মুহূর্তে৷ ১৯৯৬ সালে বাজপেয়ী যখনভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লক্ষ্যে এগোচ্ছেন, চার দশক সংসদের বিরোধী আসনে কাটানোর পর প্রথম যখন ভারতে এক অ-কংগ্রেসি সরকার গঠিত হতে চলেছে, তখন এই বিতর্ক আবার মাথা চাড়া দিয়েছিল৷
বাজপেয়ী তথ্য দিয়ে দাবি করেছিলেন, উত্তরপ্রদেশের আগ্রা জেলার বটেশ্বর গ্রামের যে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের দায়ে তিনি ২৩ দিন জেল খেটেছিলেন, তাতে যে নেতার গ্রেপ্তারি এবং শাস্তি হয়েছিল, তাঁদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া ১৫ জনের মধ্যে তিনি ছিলেন না৷ আদালতের সামনে দেওয়া সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই ওঁদের শাস্তি হয়েছিল, কোনো গুপ্তচরের বয়ানের ভিত্তিতে নয়৷
ঐতিহাসিকরাও বলেন, ১৯২৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র শহরে জন্ম নেওয়া অটলবিহারীর বয়স ১৯৪২ সালের ওই আন্দোলনের সময় মাত্র ১৭ বছর ৮ মাস৷ আজকের হিসেবে যথেষ্ট প্রাপ্তবয়স্কও নয়৷ ওই বয়সে বিশ্বাসঘাতকতা করা, বিশেষত স্বদেশের বিরুদ্ধে, আদৌ স্বাভাবিক নয়৷ তা সত্ত্বেও ব্রিটিশদের গুপ্তচরবৃত্তির তকমা বাজপেয়ীর নামের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল৷
যেমন ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের এক অংশ বলে, বাজপেয়ীই প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবে ভারতের অবস্থান সুদৃঢ় করেছিলেন৷ আবার অন্য অংশ বলে, বাজপেয়ীর কারণেই উপমহাদেশে এক মাসে একজোড়া পরমাণু শক্তিধর দেশের জন্ম হয়েছিল৷
কারণ, ১৯৯৮ সালে বাজপেয়ীর ভারত পরপর ৫টি পরমাণু বোমা বিষ্ফোরণ ঘটানোর কিছুদিনের মধ্যেই প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান তাদের নিজেদের পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা ঘটিয়েছিল৷ চিরবৈরী দুই দেশের মধ্যে নতুন করে শুরু হয়েছিল সামরিক প্রতিযোগিতা৷ পাকিস্তানের সঙ্গে সেই উত্তেজনা কমাতেও উদ্যোগী হয়েছিলেন বাজপেয়ী৷ এক্ষেত্রে সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিজেপি সাংসদদের সঙ্গে নিয়ে বাজপেয়ীর বাসে চড়ে লাহোর যাত্রা এবং পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে তাঁর বৈঠক৷
যদিও তাতে কাজের কাজ কিছু হয়নি৷ বিশেষত কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ লেগেই ছিল৷ তার মধ্যেই ঘটে যায় কান্দাহারের কুখ্যাত বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা৷ তালিবানদের সশস্ত্র ও প্রত্যক্ষ মদতে, পাকিস্তানের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে সেই বিমান ছিনতাইয়ের নিষ্পত্তি ঘটাতে ভারতের জেলে বন্দি কিছু কাশ্মীরী জঙ্গিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় বাজপেয়ী সরকার৷
এই বিরোধেরই পরিণতি ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধ৷ পররাষ্ট্র নীতি-রীতিতে কুশলী, ভারতে ১৯৭০-এর দশকের জনতা পার্টি সরকারের বিদেশমন্ত্রী বাজপেয়ী কখনোই যাকে যুদ্ধ বলতে রাজি হননি৷ বলা হতো, কাশ্মীর সীমান্তকে হানাদারদের দখলমুক্ত করার সামরিক অভিযান৷ সেই কার্গিল অভিযানের সাফল্যের সুবাদেই সে বছর স্বস্তিজনক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফেরেন বাজপেয়ী৷ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন তৃতীয়বারের জন্য৷
তার আগের দু'বারে বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ ছিল যথাক্রমে ১৩ দিন এবং ১৩ মাসের৷ ১৯৯৬ সালের সংসদীয় ভোটে কংগ্রেস হেরে যাওয়ার পর একক বৃহত্তম দল হিসেবে সরকার গড়ার ডাক পায় বিজেপি, বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হন৷ কিন্তু সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় ১৩ দিনের মাথায় সেই সরকারের পতন হয়৷ ১৯৯৮ সালে দ্বিতীয়বারের জন্যে জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন বাজপেয়ী৷ কিন্তু বিভিন্ন মতাদর্শ এবং উদ্দেশ্যের ১৭টি রাজনৈতিক দলের সেই জোটের সরকার পরিচালনা করা ছিল শূন্যে দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটার থেকেও বেশি কঠিন৷ ১৩ মাসের মাথায় জোটসঙ্গী এডিএমকে সমর্থন তুলে নিলে সেই সরকারেরও পতন ঘটে৷ শেষ পর্যন্ত ১৯৯৯ সালে স্থায়ী সরকার গড়তে সফল হয় বিজেপি এবং পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করেন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী৷
'৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের শুরুতে বাজপেয়ীর মেলামেশা ছিল ভারতের কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি হিন্দুত্ববাদী জনসংঘ পার্টির সঙ্গ ধরেন, একনিষ্ঠ অনুগামী হন জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের৷
অথচ এই বাজপেয়ীই কিন্তু পরবর্তীতে বিজেপির মধ্যপন্থি এবং নমনীয় হিন্দুত্ববাদের মুখ হয়ে ওঠেন৷ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি বিশ্বাস রাখতেন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতায়, প্রকাশ্যে বার বার সেকথা বলতেন৷ অক্ষয় হয়ে আছে ২০০২ সালে তাঁর সেই অমোঘ উক্তি, ‘‘ভারত যদি ধর্মনিরপেক্ষ না থাকে, তাহলে ভারত আর ভারত থাকবে না!''
রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার পর, এই ৯৩ বছর বয়সে প্রয়াত হওয়ার পরও যে কারণে সারা দেশের সংবাদ মাধ্যম স্মরণ করছে সেই মুহূর্তটির কথা৷ গুজরাট দাঙ্গার পর, গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী, আজকের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে পাশে বসিয়ে, সকলের সামনে বাজপেয়ী স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, একজন শাসকের একটাই ধর্ম হওয়া উচিত৷ তা হলো রাজধর্ম৷ বলেছিলেন, প্রশাসকের চোখে সবাই সমান৷ জাত বা ধর্মের কোনো বিভেদ তাঁর করা উচিত নয়৷ দৃশ্যতই নরেন্দ্র মোদীর মুখের হাসি শুকিয়ে গিয়েছিল সেই মুহূর্তে৷
সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতাতেও বিশ্বাসী ছিলেন বাজপেয়ী৷ সত্যিই বিশ্বাস করতেন, বিরুদ্ধমতকে প্রাপ্য সম্মান দেওয়া গণতন্ত্রের অন্যতম মৌলিক শর্ত৷ সংসদে বার বার তার প্রমাণ বাজপেয়ী দিয়েছেন৷ সাংসদ হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুবক্তা৷
রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় শক্তিশালী, কিন্তু সকলের প্রতি সহানুভূতিশীল৷ আজকের ভারতীয় রাজনীতিতে যখন অসহিষ্ণুতাই ক্রমশ দাপট বাড়াচ্ছে, দেশকে ছাড়িয়ে বড় হয়ে উঠছে গোষ্ঠীবিশেষের ধর্ম, তখন আরও বেশি করে যে নেতার অভাব দেশ বোধ করবে, তাঁর নাম অটলবিহারী বাজপেয়ী৷ তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধায় ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার৷ সেই ৭ দিনে একবারও কেউ বাজপেয়ীর নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধকে স্মরণ করবেন কিনা, বিরাট প্রশ্ন সেই নিয়েই৷