বাংলাদেশে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সহিংস আন্দোলন
২০ জুলাই ২০২৪বাংলাদেশে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সৃষ্ট সহিংসতায় শুক্রবার অবধি একশ'র বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যম৷
ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ স্বপন শনিবার টেলিফোনে বলেছেন, ‘‘সংবাদমাধ্যমে দেখতে পেয়েছি গত দুইদিনে মৃত্যুর সংখ্যা ১০৩ বলেছে৷''
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে পুলিশ ও সরকার দলীয় সমর্থকদের সঙ্গে প্রতিবাদকারীদের তীব্র সহিংসতার মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে ইন্টারনেট, টেলিফোন এবং ম্যাসেজিং সার্ভিস প্রায় বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ৷ এরপর ঢাকা থেকে প্রকাশিত সংবাদমাধ্যমগুলোর মধ্যে দৈনিক প্রথম আলো কয়েকঘন্টা ওয়েবসাইটে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করলেও পরবর্তীতে অন্যান্য পত্রিকার মতোই আর কোনো নতুন তথ্য প্রকাশ করছে না৷
বিবিসি বাংলা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে, গত চারদিনের সহিংসতায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর প্রিন্ট সংখ্যায় উল্লেখ করেছে।
‘‘প্রথম আলো পত্রিকা লিখেছে, শুক্রবার ৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে গত তিন দিনে নিহত হয়েছে ১০৩ জন৷ শুক্রবার অন্তত ৬৬ জনের মৃত্যুর খবর নিয়ে শিরোনাম করেছে ডেইলি স্টার,'' লিখেছে বিবিসি বাংলা৷
আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা এএফপি এবং রয়টার্স আলাদাভাবে গত কয়েকদিনে সংঘর্ষে মৃতের সংখ্যা অন্তত ১০৫ বলে লিখেছে৷
ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ শনিবার বিকেলে জানিয়েছেন, শনিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজে অন্তত পাঁচটি মরদেহ পৌঁছেছে৷ তার মধ্যে দুটি মরদেহ পুলিশ সদস্যদের৷
স্মরণকালের সবচেয়ে সহিংস আন্দোলন
গতমাসে হাইকোর্ট এক রায়ে কোটা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিলে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা৷ ২০১৮ সালেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর কোটা বাতিল হয়েছিল৷
এবার শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সরকারের তরফ থেকে কঠোর মনোভাব দেখানো হলে আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে এবং দ্রুতই পরিস্থিতির অবনতি ঘটে৷
বাংলাদেশে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় এবং প্রচলিত টেলিফোন নেটওয়ার্কে বিদেশ থেকে সংযোগ পাওয়া দুরূহ হয়ে ওঠায় ঢাকা থেকে নিয়মিত প্রতিবেদন পাঠাতে পারছেন না ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ স্বপন ও সমীর কুমার দে৷
শনিবার টেলিফোনে তারা জানেন, গত কয়েক দশকে এরকম সহিংস আন্দোলন দেখেনি বাংলাদেশ৷
‘‘আমার বয়স প্রায় ৫২ বছর৷ আমি এরশাদবিরোধী আন্দোলনটা দেখেছি৷ বিশেষ করে আমি যদি পয়েন্ট আউট করি, গণঅভ্যুত্থানের সময়টা দেখেছি৷ আমার মনে হয়েছে যে আন্দোলনের যে প্যাটার্ন এবং আন্দোলনের যে অ্যাক্টিভিটিজ, সেটি বড় আকারের আন্দোলনের৷ সহিংসতা যদি বলেন, সেটি উঁচুমাত্রায় পৌঁছে গেছে,'' কয়েকবার চেষ্টার পর টেলিফোনে বলেন হারুন উর রশীদ৷
ডয়চে ভেলের অপর প্রতিনিধি সমীর কুমার দে বলেন, ‘‘ঢাকায় গত কয়েকদিনে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এরকম পরিস্থিতি আগে দেখিনি৷ ঢাকায় আমি গত বিশ বছর ধরে থাকি৷ ২০০৬ সালে আমি আওয়ামী লীগের লগি বৈঠার আন্দোলন দেখেছিলাম৷ আরেকবার দেখেছিলাম ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন, যে আন্দোলন শুরু হয় শাপলা চত্বরে৷ এসব আন্দোলন হয় নির্দিষ্ট একটি এলাকায়৷ আওয়ামী লীগের লগি বৈঠা আন্দোলন ছিল পল্টন মতিঝিল এলাকাকেন্দ্রিক৷ আবার হেফাজতের ছিল শাপলা চত্বরকেন্দ্রিক৷ কিন্তু এই আন্দোলনের যে বিস্তৃতি এবং সহিংসতা, এরকম পরিস্থিতি আমি কখনো দেখিনি৷ ''
ঢাকা প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপকালে মাঝেমাঝেই সংযোগে বিঘ্ন ঘটছিল৷ স্বপন জানিয়েছেন, ঢাকার যেসব স্থানে প্রতিবাদকারীরা গতকাল শক্ত অবস্থান নিয়েছিল সেসব স্থান ছাড়া অন্যত্র রাস্তাঘাট ফাঁকা রয়েছে৷ দোকানপাটও বন্ধ এবং কোথাও কোথাও জিনিসপত্র বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে৷
সমীর কুমার দে এই বিষয়ে বলেন, ‘‘পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, গুলির মুখেও আন্দোলনকারীরা পিছু হটছে না৷ গতকালকে আমি যেটা দেখেছি যে, শিক্ষার্থীদের যে আন্দোলন সেখানে রাজনৈতিক কর্মীদের সম্পৃক্ততা বেশি দেখা গেছে৷''
চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানারকম প্রতিক্রিয়া দেখছেন ডয়চে ভেলের এই প্রতিনিধিরা৷ হারুন উর রশীদ স্বপন এই বিষয়ে বলেন, ‘‘তারা (সাধারণ জনগণ) মনে করছেন, ছাত্রদের দাবি মেনে নেয়া উচিত৷ তারা এটাও মনে করছেন, দাবি যদি আরো আগে মেনে নেয়া হতো, তাদের সাথে কথা বলতো, তাহলে এই ধরনের সংঘাত, সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না৷ তারা মনে করছে সরকার তাদের সঙ্গে আলোচনায়, কথা বলায় যথেষ্ট দেরি করেছে৷''
সমীর কুমার দে বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক বিভক্তি দেখতে পাচ্ছি, একটা পক্ষ মনে করছে এই ইস্যুতে সরকার পতনের চেষ্টা করা ঠিক আছে, আবার অন্যপক্ষ মনে করছে এটার জন্য সরকারকে ফেলে দেয়া তারা সমর্থন করে না৷''
আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ধরপাকড় প্রসঙ্গে হারুন উর রশীদ স্বপন বলেন, ‘‘পুলিশের বক্তব্য, এখন পর্যন্ত তিনহাজার লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সারাদেশ থেকে৷ তার ভেতরে তো অবশ্যই আন্দোলনকারীরা রয়েছেন৷''
এদিকে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শুক্রবার রাতে দেশব্যাপী কারফিউ এবং সেনা মোতায়েন সংক্রান্ত পরিপত্র জারি করেছে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্পেন ও ব্রাজিল সফর বাতিল করা হয়েছে৷
এর আগে জনগণের উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুপ্রিম কোর্টের এ সংক্রান্ত নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানান৷ তিনি সহিংসতার নিন্দা জানানোর পাশাপাশি প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার করা হবে বলেও জানান৷
প্রধানমন্ত্রীর মঙ্গলবারের এই বক্তব্যের পর কোটা আন্দোলনে সহিংসতার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে৷
ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ মনে করেন, ‘‘বিষয়টা আর শুধু কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে সেটা আমার মনে হয় না৷ নানা দিকে আন্দোলনটা ছড়িয়ে পড়ছে৷ সামনের দিকে কারফিউ অবস্থা বা এভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে কিনা সেটা এখনই বলতে পারছি না৷ কারণ এখনো আন্দোলনকারীরা রয়েছেন বিভিন্ন জায়গায়৷ আমি মনে করি না পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার মতো কোনো সিগন্যাল আমি পাচ্ছি৷''
‘‘উদ্যোগ আছে, কিন্তু তাতে যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তা আরো ৪৮ ঘণ্টা পার না হলে বলা যাবে না,'' যোগ করেন তিনি৷