বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলন কোন পথে
৩০ এপ্রিল ২০১৮বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের এখন শ্রমিক শাখা রয়েছে৷ ওই দলগুলোর নামে কেন্দ্রীয় থেকে শুরু করে ইউনিট পর্যন্ত শ্রমিক সংগঠনের শাখা রয়েছে৷ শ্রমিক নেতারা এখন মন্ত্রী হন, অতীতেও হয়েছেন৷ পাটকলগুলোর শ্রমিক সংগঠন এক সময় খুব প্রভাবশালী ছিল৷ তাদের নেতারা জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতেন৷ এখন সেই জায়গা নিয়েছে পরিবহণ শ্রমিকদের সংগঠন৷ নৌমন্ত্রী শাহজাহান খান একই সঙ্গে মন্ত্রী এবং পরিবহণ শ্রমিকদের শীর্ষ নেতা৷ তাঁর প্রভাবের কারণে সড়ক পরিবহণ নিয়ে জনবান্ধব আইন করা যায় না বলেও অভিযোগ রয়েছে৷
এক সময় আদমজী পাটকলে প্রতিদ্বন্দ্বী শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ এবং হত্যাকাণ্ড নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছিল৷ কিন্তু সেই আদমজী পাটকল বন্ধ হওয়ার সময় নেতাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ বাংলাদেশের সরকারি ব্যাংকগুলোতে সিবিএ আছে৷ অভিযোগ আছে, ওইসব ব্যাংকের সিবিএ নেতাদের কাছে ব্যাংকের সর্বোচ্চ প্রশাসন অসহায়৷ তাঁদের চাপ আর ধমকের মুখে থাকতে হয় কর্মকর্তাদের৷ এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকেরও একই অবস্থা৷ তাঁরা গভর্নরকেও পরোয়া করেন না বলে অভিযোগ আছে৷ এমনকি কিছু অপ্রীতিকর ঘটনায় ওই সিবিএ নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে৷ আর হবেই বা না কেন? সম্প্রতি সোনালী ব্যাংকের এক ঘটনায় সিবিএ নেতাদের পক্ষে অবস্থান নেন একজন মন্ত্রী কাম শ্রমিক নেতা৷ তিনি কোনো অনুমতি ছাড়াই ব্যাংকের ভিতরে সভা করে কর্তৃপক্ষকে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলার পরামর্শ দেন৷
ওয়াসা, ডেসা, বিদ্যুৎ বিভাগ, তিতাস গ্যাস, বিমান, প্রতিটি সেক্টরেই আছে সিবিএ বা কর্মচারি কল্যাণ সমিতি৷ অভিযোগ আছে, সিবিএ নেতারা প্রকৃতই শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণে যত না ব্যস্ত, তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত নিজেদের আখের গোছাতে৷ আর সবখানেই সরকার সমর্থক সিবিএ-র দাপট থাকে৷ প্রতিপক্ষরা থাকে কোণঠাসা৷ সরকার বদল হলে পরিস্থিতিও বদলে যায়৷
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সংগঠন এবং আন্দোলন এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত৷ রানা প্লাজা ধসের পর থেকে শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করতে দেয়ার আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে৷ কিন্তু সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো পোশাক কারখানা থাকলেও মাত্র ৬শ'র মতো কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন আছে৷
২০০৬ সালের জুন মাসে পোশাক শ্রমিকরা বড় ধরনের আন্দোলনের মাধ্যমে প্রথম তাঁদের অধিকার নিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়৷ মাসিক মাত্র ১,৬৬২ টাকা ৫০ পয়সা মজুরি নির্ধারণের বিরুদ্ধে তাঁরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন৷ কোনো শ্রমিক সংগঠন ওই মজুরি মানেনি৷ তখন তাঁরা তিন হাজার টাকার ন্যূনতম মজুরির দাবিতে আন্দোলন করেন৷ সরকার রানা প্লাজা ধসের পর পাঁচ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে৷
কলাম লেখক শাহ মো. জিয়াউদ্দিনের লেখা থেকে জানা যায়, শ্রমিকদের অধিকার ও দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে মে দিবস পালিত হয়৷ স্বাধীনতার পর মে দিবস রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে মহান মে দিবস উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে মে দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন৷
স্বাধীনতার পর দেশের শ্রম আন্দোলনে তৈরি হয় নানা বিভাজন৷ ১৯৭৩ সালে কর্ণফুলী কমপ্লেক্সে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়৷ এই শ্রমিক অসন্তোষে বহু শ্রমিক আহত হয়৷ ওই সময়ে টঙ্গী শিল্প এলাকায় শ্রমিক লীগ এবং শ্রমিক ফেডারেশনের মাঝে দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা দেয়৷ শ্রমিক সংগঠনগুলো নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়৷ ১৯৭৩ সালে প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রেড ইউনিয়নের মধ্যে সংঘাত চলতে থাকে৷ এই সংঘাতের জের ধরে চট্টগ্রামের বারবকুন্ড শিল্প এলাকায় অনেক শ্রমিক নিহত হয়৷ ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সদস্য পদ লাভ করে৷ ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের পর সারাদেশে একটি শ্রমিক সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়৷ ওটাই ছিল একক জাতীয় শ্রমিক সংগঠন৷ তার নামকরণ হয় জাতীয় শ্রমিক লীগ৷
গবেষক আলতাফ পারভেজ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিক সংগঠনগুলো বড় ভূমিকা রাখে৷ এরপর শ্রমিকদের অধিকার আন্দোলনের বাইরেও আশির দশকে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) স্বৈরাচার এরশাদ সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়৷ তারা রাজনৈতিক দলের সমান্তরাল কর্মসূচি দেয়৷ কারণ, তারা তখন মনে করেছিল দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকলে শ্রমিকদের অধিকার আদায় করা সম্ভব নয়, সম্ভব নয় শ্রমিক আন্দোলন৷ কিন্তু এরশাদ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক সরকার শ্রমিক আন্দোলন এবং শ্রমিক নেতাদের দলীয় নেতায় পরিণত করে৷ ফলে শ্রমিক আন্দোলন বিভ্রান্ত হয়ে রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিতে পরিণত হয়৷ শ্রমিক নেতারা নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে শ্রমিকদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের স্বার্থে কাজ করে৷ সরকারের স্বার্থে কাজ করে৷ একই সঙ্গে শ্রমিক সংগঠন কিছু বামপন্থি নেতাদের হাতে চলে যায়৷ স্বাধীন শ্রমিক সংগঠন অস্তিত্ব হারায়৷ সরকার ও শিল্পপতিরা মনে করেন, এতেই শিল্পের লাভ৷ আশির দশকে যে পোশাক কারখানা বিকশিত হয়, তাতেও শ্রমিক সংগঠন বিরোধী মনোভাব স্পষ্ট হয়৷ আর কিছু শ্রমিক নেতার জনস্বার্থবিরোধী কাজের কারণে শ্রমিক আন্দেলনকে নেতিবাচক হিসেবে দেখা হয় তখন৷''
তিনি বলেন, ‘‘এরশাদের সময় শ্রমিক নেতাদের একাংশ এরশাদের হয়ে কাজ করেন৷ আদমজী জুট মিল এলাকায় তখন প্রায়ই শ্রমিক সংঘর্ষ হতো৷ ওই সময়ে শ্রমিক নেতাদের দ্বন্দ্বের শিকার হয়ে অনেক শ্রমিক নিহত হন৷ আদমজী জুট মিলকে তখন অস্ত্রাগারের সঙ্গে তুলনা করা হয়৷'' ওই সময় আলোচিত শ্রমিক নেতা কাজী জাফর আহমেদ এরশাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে মন্ত্রী হন৷
আলতাফ পারভেজ বলেন, ‘‘একসময় শ্রমিক আন্দোলন ছিল তেজগাঁ, টঙ্গী ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক৷ কিন্তু সেই অবস্থা এখন আর নাই৷ আর শ্রমিক আন্দোলনও শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে তেমন নেই৷''
শাহ মো. জিয়াউদ্দিনের লেখায়, ‘‘১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর শ্রমিক শ্রেণির সংগঠনগুলোতে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আদর্শিক চর্চার চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায় দলীয় রাজনৈতিক আদর্শিক ধারার চর্চা৷ ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করতে শুরু করলে শ্রমিক সংগঠনগুলোতে তার প্রতিফলন ঘটে, জামায়াতের মতাদর্শের ‘শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন' নামে শ্রমিক সংগঠন গঠিত হয়৷ এভাবেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিতে শ্রমিক সংগঠনগুলো জড়িয়ে পড়ে৷ ফলে শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থ রক্ষার পরিবর্তে শ্রমিক সংগঠনগুলো রাজনৈতিক নেতাদের গদি রক্ষা এবং গদিতে নেয়ার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থাকে৷ এর ফলে দেখা যায়, শ্রমিক রাজনীতির নেতৃত্ব আর শ্রমিক শ্রেণির হাতে নেই৷''
গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ষাট, সত্তর এবং আশির দশকে পাট ও টেক্সটাইল কারখানাভিত্তিক শ্রমিক আন্দোলন ও ট্রেউ ইউনিয়নের ধারা ছিল ইতিবাচক৷ তখন মালিকপক্ষও এর তেমন বিরোধী ছিল না৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্যাংক ও সেবাখাতের ট্রেড ইউনিয়ন বা সিবিএ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়৷ কিন্তু আশির দশকে যখন তৈরি পোশাক কারখানার বিকাশ ঘটতে শুরু করে, তখন থেকেই এই খাতে ট্রেড ইউনিয়নবিরোধী মনোভাব ছিল প্রবল৷ হয়ত শতভাগ রপ্তানিমুখী হওয়া একটা কারণ হতে পারে৷ কিন্তু মালিকদের মনোভাব এতই নেতিবাচক হয় যে, যাঁরা পোশাক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের উদ্যোগ নেয়, তাঁদের ছাঁটাই করে, মামলা দেয় এবং নির্যাতন করে৷''
তিনি বলেন, ‘‘তাজরীন ফ্যাশান ও রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর পোশাক কারখানায় আন্তর্জাতিকভাবে ট্রেড ইউনিয়নের চাপ আসে৷ সরকার তা মেনেও নেয়৷ কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো, এখনও ৭৯ ভাগ কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন নেই৷''
মিশু বলেন, ‘‘পোশাক কারখানার মতো এখন অন্যান্য শিল্পেও শ্রমিক ইউনিয়নবিরোধী মনোভাব স্পষ্ট হয়েছে, যা অতীতে ছিল না৷ বিশেষ করে রি-রোলিং মিল, নির্মাণ শিল্পসহ অন্যান্য অনেক শিল্পে এই অবস্থা বিরাজ করছে৷''
বাংলাদেশের ২০১৩ সালের সংশোধিত শ্রম আইনে শ্রমিক নয়, এমন কেউ শ্রমিক ইউনিয়নের কাজে সরাসরি অংশ নিতে পারেন না৷ ফলে শ্রমিকদের সংগঠিত করায় শিক্ষিত লোকের সংকট দেখা যাচ্ছে৷ আবার সব রাজনৈতিক দলের নিজস্ব শ্রমিক সংগঠন থাকায় তাঁরা দলীয় সিদ্ধান্তে কাজ করেন৷ বিশেষ করে যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁদের শ্রমিক সংগঠন সরকারের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে৷ ফলে শ্রমিকদের জন্য স্বাধীন সংগঠন বিলুপ্ত প্রায়৷
আলতাফ পারভেজ বলেন, ‘‘স্বাধীন শ্রমিক সংগঠন শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য সহায়ক৷ শ্রমিক সংগঠন বা বার্গেইনিং এজেন্ট না থাকলে শিল্প প্রতিষ্ঠানে অনিয়ন্ত্রিত শ্রমিক আন্দোলন হতে পারে, যা প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকর৷ সরকার বিষয়টি ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে৷ মালিকরাও বুঝবেন আশা করি৷''আর মোশারেফা মিশু বলেন, ‘‘উৎপাদনে পুঁজির মতো শ্রমিকও একটি অংশ, তাই শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের কল্যাণ নিশ্চিত করেই উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা দরকার৷''
বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলন আসলে কোন পথে? লিখুন নীচের ঘরে৷