বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতার উৎস ও গতিপথ
৩ নভেম্বর ২০২৩বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতার যোগ লক্ষ্য করা যায় স্বাধীনতার পর থেকেই৷ জাসদ এবং ওই সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ (পরবর্তীতে বাকশাল) সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার গোড়াপত্তন সেখান থেকেই। ওই সময় রাজনৈতিক হত্যারও শুরু৷ জনপ্রতিনিধিদের হত্যা, থানা লুটের অনেক ঘটনা ঘটে ঘ্টে তখন। ১৯৭৫ সালের ১৭ মার্চ জাসদ ঢাকার রমনা এলাকায় তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর বাসভবন ঘেরাও করতে গেলে ব্যাপক সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
বাংলাদেশের রাজনীতির সবচয়ে জঘন্য এবং মর্মান্তিক অধ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা। তারপর জিয়াউর রহমানের শাসনামলেও হত্যাকাণ্ড থামেনি৷ এমনকি জিয়াউর রহমান নিজেও হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
স্বৈরশাসক এরশাদের আমলে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পুরোটা সময় ছিল দমন-পীড়নের। কিন্তু সেই পর্বেও যে রাজনৈতিক সহিংসতা ছিল না তা বলা যাবে না। হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও ওই সময়ে অনেক হয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ছিল এক কাতারে। সম্মিলিত আন্দোলনের মুখে এরশাদের পতন হয় ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর। ৯০-এর গণ অভ্যুত্থানের পর আশা করা হয়েছিল বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংঘাত সহিংসতা বন্ধ হবে, কিন্তু তা হয়নি।
দেশের রাজনীতিতে সহিংসতা প্রসঙ্গে সাবেক বিএনপি নেতা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান বলেন, "স্বৈরশাশকরা ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। ফলে তাদের সঙ্গে তো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সংঘাত, সংঘর্ষ হবেই। সহিংসতাও হবে। তা না হলে তো তাদের সরানো যাবে না। এটা সারা পৃথিবীতেই হয়। তোমার বিরুদ্ধে আামার আন্দোলন মানে কী? মানে হলো, তোমাকে আমি মানি না। কিন্তু আমার কথায় তো সে যাবে না। শেষ পর্যন্ত তো আমাকে সংঘাতেই যেতে হবে।”
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আন্দোলন, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপির আন্দোলন, ২০০৭ সালে বিএনপির শাসনামলে রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আন্দোলন, ২০১৩-১৪ সালে বিএনপির নির্বাচন বর্জন আন্দোলন আর এখন চলছে বিএনপির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকরের দাবিতে আন্দোলন।''
গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের দিন থেকেই এই আন্দোলনে সংঘাত- সহিংসতা যুক্ত হয়েছে। একদিন হরতালের পর বিএনপি এখন টানা অবরোধের দিকে চলে গেছে। তাদের শীর্ষ নেতাদের যেমন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তেমনি আন্দোলনে যানবাহনে আগুন আর সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে। আর এবারই সরকারবিরোধী আন্দোলনের কোনো কর্মসূচির দিন শাসক দল আওয়ামী লীগও পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকছে। আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘‘যেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকে; সেখানে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার থাকে; সেখানে রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতা কম থাকে। তারপরও সহিংসতা হতে পারে , সেটা নির্ভর করে রাজনৈতিক কাঠামোর ওপর। কিন্তু আমাদের এখানে আদিম সহিংসতা চলছে। এর কারণ হলো; এখানে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ব্যবস্থা, জনগণ ভোট দিয়ে যে সরকার নির্বাচন করবে; সেটাই আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি।”
তার কথা, ‘‘এটাও একটা বাস্তবতা যে; যারা ক্ষমতার বাইরে থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য লড়াই করে তারাই আবার ক্ষমতায় গিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে। তারপরও আমাদের তো কোথাও না কোথাও থেকে শুরু করতে হবে। সেই লড়াইটাই আমরা করছি। আমরা বিশ্বাস করছি যে বিএনপির বোধোদয় হয়েছে।”
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আকসাদুল আলম মনে করেন, "এই রাজনৈতিক সহিংসতার ঐতিহাসিক কারণ আছে। বাংলাদেশ যে একটি ঐতিহাসিক কনসিকোয়েন্সের মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে, সেই সৃষ্টির পরও কিন্তু আগের লিগ্যাসিগুলোকে টানতে হচ্ছে। তার মানে হলো, কোনো একটা জায়গায় গিয়ে একটি বড় সমস্যার মীমাংসার কিছুটা অভাব ছিল। যে আদর্শ আর মূলনীতির ভিত্তিতে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি সেইখানে ৫২ বছর ধরে একটি বড় সমন্বয়হীনতাকে টানতে হচ্ছে। তার বহিঃপ্রকাশ আমরা রাজনৈতিক সংঘাত আর সহিংসতায় দেখতে পাচ্ছি।”
আওয়ামী লীগ যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে, তখন ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকার পল্টনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সংঘাত ও সংঘর্ষ বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেকটি বড় ঘটনা। তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামায়াত সরকার। ওই দিনও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। বিএনপি জামায়াত সেই ঘটনাকে ‘লগি-বৈঠার' সন্ত্রাস বলে।
২০১৩-২০১৪ সালে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক রাজনৈতিক সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে। বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে তা প্রতিহত করার ডাক দেয়। তখন গানপাউডার, আগুন আর প্রেট্রোল বোমা দিয়ে বাসে হামলা এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। অনেক লোকের প্রাণ যায়। অনেক নিরীহ মানুষ সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যান। ওই আগুনসন্ত্রাসের জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তখন বিএনপি জামায়াতকে দায়ী করে। বিএনপি তখন টানা হরতাল-অবরোধ দেয়।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, "যারা ক্ষমতায় থাকেন, তারা সাধারণভাবে বলা যায় জনগণের গণতন্ত্রকে গুরুত্ব দেয় না, জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেয় না। এখন জনগণের দাবি যখন সামনে চলে আসে, তখন তাকে ক্ষমতায় থাকতে দমন-পীড়নের পথ বেছে নিতে হয়। এখন বাইরে যারা থাকেন, তাদের তখন সহিংসতার পাল্টা সহিংসতা করতে হয়, যেটা এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময়ও আমরা দেখেছি।...যদি এমন হতো যে, যারা ক্ষমতায় আছেন, তাদের একটি গণতান্ত্রিক নর্মস আছে, যারা বাইরে আছেন তাদেরও গণতান্ত্রিক নর্মস আছে, তাহলে এই ধরনের সমস্যা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যেতো,” মনে করেন এই রাজনৈতিক নেতা।
তার মতে, ‘‘এই ধরনের ঘটনার সময় দেশি-বিদেশি অনেক শক্তি সুযোগ নেয়, নানা অপশক্তি সুযোগ নেয়।”
৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক সহিংসতার আরেকটি বড় উদাহরণ হলো, ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে মতিঝিলের শাপলা চত্ত্বরে হেফাজতে ইসলামের অবস্থানের আগে ও পরের ঘটনা। হেফাজত কোনো রাজনৈতিক দল না হলেও তাদের ওই সময়ের অবস্থানকে ‘উৎসাহিত' করেছে বিএনপি , জামায়াত ও জাতীয় পার্টি। পরে শাপলা চত্ত্বর থেকে তাদের উৎখাত করে আওয়ামী লীগ সরকার।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতেও ব্যাপক রাজনৈতিক সহিংসতার অভিযোগ আছে জামায়াতে ইসলামির বিরুদ্ধে। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াতনেতা মওলানা দেলাওয়ার হোসের সাঈদীর ফাঁসির রায় দিলে দেশের অন্তত ১০টি জেলায় কয়েকদিন ধরে ব্যাপক সহিংসতা চালায় জামায়াত-শিবির। তারা রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিতে গাছপলাও কেটে ফেলে। সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘরেও হামলা চালানো হয় তখন। ওই সহিংসতায় বেশ কয়েকজন নিহত হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন মনে করেন, " দেশে কঠিন একটা বিভাজন হয়ে গেছে। এটা আসলে কাম্য নয়। আমাদের একটা সংলাপাও করতে হবে আবার কাঠামোগত সংস্কারও করতে হবে। যদি ভোটের অনুপাতে সংসদের আসন দেয়া হতো, তাহলে এই সংকট অনেকটাই কেটে যেতো।” তিনি বলেন," আমাদের যেকোনো সমঝোতার জন্য একটি আদর্শিক ঐকমত্য প্রয়োজন। আমি মনে করি, সেটা হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ভিত্তিতে।”
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে তখনকার বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলাও বাংলাদেশের ইতিহাসে জঘন্য এক ঘটনা। বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় ওই হামলায় শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হন, আহত হন তিন শতাধিক। ওই হামলাকে বিএনপি-জামায়াত সরকার তখন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে। মামলার তদন্ত ও বিচারে দেখা গেছে, বিএনপি-জামায়াত সরকারের পরিকল্পনায়ই ওই হামলা হয়েছিল।
সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া এই রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতা কমার কোনো আশা দেখেন না। বরং আরো বাড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি। তার কথা, "বাংলাদেশের রাজনীতিতে দর্শনগত সমস্যা আছে। বাংলাদেশ যে মূল দর্শনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, একটি অংশ তা স্বীকার করে না। ফলে এই সংকট কমবে না। এটা আমাদের রাজনীতির অংশ হয়ে গেছে।’’