সরকারি দল আওয়ামী লীগ বলছে-বিএনপির চরিত্রটাই এমন, ২০১৩-২০১৪ সালে এরা সারা দেশে আগুন-সন্ত্রাস চালিয়েছে, মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে৷ এখন আবার তারা সেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করেছে৷ বিপরীত দিকে বিএনপি বলছে, এসব কাজ আসলে আওয়ামী লীগই করাচ্ছে৷ নিজেরা করে বিএনপির উপর দায় চাপাচ্ছে৷ রাজনীতিতে বিএনপিকে কোণঠাসা করার জন্য সরকারি দল করাচ্ছে এসব৷ দুপক্ষের এমন পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মধ্যেই চলছে এখন দেশের রাজনীতি৷
এই যে পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ, জনগণ কার কথা কতটুকু বিশ্বাস করছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তেমন কোন চিন্তা আছে বলে মনে হয় না৷ বরং কে কত উচ্চ শব্দে নিজের দাবিটা প্রকাশ করতে পারছে-সেটাই তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ৷ বলাবাহুল্য এ কাজে এখন অনেকটাই এগিয়ে আছে সরকারি দল৷ সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সকল মন্ত্রী, নেতা, সবাই যখন যেখানে কথা বলছেন, শুরুই করছেন তারা বিএনপি-জামায়াতকে দোষারোপের মাধ্যমে৷ আর উল্টো দিকে, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর থেকে শুরু করে বেশির ভাগ নেতাই এখন জেলে৷ বাকি যারা বাইরে আছেন, তারাও প্রকাশ্যে নেই কেউই, পালিয়ে বেড়াচ্ছেন৷ ফলে তাদের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে না৷ এদের মধ্যে রিজভী আহমেদ দুই তিন দিন পর পর অজ্ঞাত স্থান থেকে অনলাইনের মাধ্যমে হাজির হয়ে নতুন নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করছেন৷ কর্মসূচি বলতে হরতাল বা অবরোধের কর্মসূচি৷ এরই মধ্যে একদিন হরতাল এবং তিন দিনের অবরোধ পালিত হয়ে গেল৷ এখন সামনে রয়েছে আরও দুই দিনের অবরোধের ঘোষণা৷
রাজনীতির এই যে ধ্বংসাত্মক ধারা, এই দফায় এর শুরুটা হয়েছে গত ২৮ অক্টোবর থেকে৷ সেদিন নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ ছিল৷ এ মহাসমাবেশের ঘোষণা এসেছিল ১৮ অক্টোবরের সমাবেশ থেকে৷ গত বেশ কিছুদিন ধরে এরকমই চলছিল৷ বিএনপি ঢাকাতে একটা করে বড় কর্মসূচি বা সমাবেশ করছিল, তাতে বিপুল জনসমাগম হচ্ছিল, তারপর সেখান থেকে নেতৃবৃন্দ ঘোষণা করেছে নতু্ন আর একটি কর্মসূচির৷ কর্মসূচি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তারা সবসময়ই বলে আসছিল শান্তিপূর্ণভাবে সেটা পালনের কথা৷ বাংলাদেশের রাজনীতি যতদিন ধরে দেখছি, আমার দীর্ঘ ৪০ বছরের অভিজ্ঞতায় ধারাবাহিকভাবে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচির এমন ঘোষণা আগে কখনো দেখিনি৷ লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, যেমনটি তারা বলেছে, ঠিক সেভাবেই কর্মসূচিগুলো তারা পালন করতে পেরেছে৷ এর মধ্যে সরকারি দলের পক্ষ থেকে উস্কানি এসেছে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে মন্তব্য এসেছে, কিন্তু বিরোধী দলকে উত্তেজিত করা যায়নি৷ ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করেও সেরকম অনেক উস্কানি এসেছে৷ সরকরের মন্ত্রীরা বলেছেন, ২৮ অক্টোবর বিরোধীদল যদি বাড়াবাড়ি করে, যদি পল্টনে বসে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তাদের পরিণতি শাপলা চত্বরের চেয়েও করুণ হবে৷ এমন বক্তব্যের মাধ্যমে ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের অবস্থান কর্মসূচির পরিণতির কথাই আসলে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে-২৮ অক্টোবর তো এধরনের কোন অবস্থান কর্মসূচির কথা বলা হয়নি৷ বরং বিএনপি মহাসচিব স্পষ্ট করেই বলেছিলেন অবস্থান কর্মসূচির কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই৷ তাহলে সরকারি দলের তেমন হুঁশিয়ারি ভিত্তিটাই বা কোথায়?
বিএনপি বলেছিল, তাদের মহাসমাবেশ হবে শান্তিপূর্ণ৷ কিন্তু মির্জা ফখরুলের উচ্চারিত সে প্রত্যাশা বাস্তবায়িত হয়নি৷ ২৮ অক্টোবরের সমাবেশকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়েছে৷ ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ হয়েছে৷ নিহত এবং আহতের ঘটনাও ঘটেছে৷ ২৮ তারিখেই একজন পুলিশ ও যুবদলের একজন কর্মী নিহত হয়েছেন৷ আহতের সংখ্যা শতাধিক৷ পুলিশই আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক৷ আর বিরোধীদলীয় কর্মী সমর্থকদের কত আহত হয়েছে সে সংখ্যাটি পাওয়া যায়নি৷ কারণ আহত হলেও অনেকে মামলা মোকদ্দমা থেকে রেহাই পেতে কোনো হাসপাতালে ভর্তি হননি৷
এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে মহাসমাবেশটি স্বাভাবিকভাবে শেষ হতে পারেনি৷ প্রধান বক্তা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার বক্তৃতা শুরুই করতে পারেননি৷ তার আগেই টিয়ারগ্যাস আর সাউন্ড গ্রেনেডের কারণে সমাবেশ পণ্ড হয়ে গেছে৷ মঞ্চ থেকে নামতে নামতে একটা হ্যান্ড মাইকে তিনি কেবল হরতালের কর্মসূচিটি ঘোষণা করতে পেরেছেন৷
এরই মধ্যে নানা ধরনের ময়নাতদন্ত শুরু হয়ে গেছে৷ কে দায়ী, কেন দায়ী, কিভাবে দায়ী-তা নিয়ে নানা বক্তব্যও প্রকাশিত হচ্ছে৷ সরকার, সরকারি দল, পুলিশ এদের বক্তব্য একই ধরনের৷ দায়ী করেছেন তারা বিএনপি জামায়াতকে৷ বিপরীতদিকে আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো দায়ী করছে সরকারকে৷ বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশি শক্তি এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ৷ তাদের দিক থেকে পুরো ঘটনার প্রেক্ষিতে ডিপ্লোম্যাটিক বিবৃতি এলেও তাতে যেন সরকারের দায়কেই কিছুটা বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে৷ জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বক্তব্যের মধ্যেও সরকারের দায়ের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে৷ বলা হয়েছে পুলিশের অপ্রয়োজনে বাড়াবাড়ির কথা৷
সরকার এখন দারুণ কঠোর অবস্থানে৷ বিরোধীদলকে দমনে কিছুমাত্র ছাড় দেওয়া হচ্ছে না৷ ২৮ অক্টোবরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৩৭টির মতো মামলা করা হয়েছে৷ আসামি করা হয়েছে দেড় সহস্রাধিক৷ মানে এতো লোকের নাম উল্লেখ করে মামলাগুলো হয়েছে৷ এর বাইরে ‘অজ্ঞাত’ শিরোনামে আসামি রয়েছে আরও কয়েক হাজার৷ এর অর্থ হচ্ছে, যে কেউই এই তালিকায় পড়ে যেতে পারে৷ সবমিলিয়ে বিরোধী রাজনীতিকদের জন্য একটা ভীতিকর অবস্থা৷
একথা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়-এই যে মামলা মোকদ্দমা বা ধর পাকড়, এসবই হচ্ছে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে৷ গত কয়েক মাস ধরেই দেশে রাজনীতি যা কিছু হয়েছে, নেতারা যা করেছেন বা বলেছেন, পশ্চিমা কূটনীতিকরা যা বলেছেন-সব কিছুরই মূল লক্ষ্য ছিল আগামী নির্বাচন৷ নির্বাচনটা ঠিক কী পদ্ধতিতে হবে, দলীয় নাকি নির্দলীয় সরকারের অধীনে, তা নিয়েই বিরোধ৷ ক্ষমতাসীন দল চেয়েছে সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানে তারা নির্বাচনের যে পদ্ধতিটি যুক্ত করেছে, সেভাবেই নির্বাচন করতে৷ আর বিরোধীদল চেয়েছে এই সংশোধনের আগে সংবিধানে যে নির্বাচন পদ্ধতির কথা বল ছিল, সেভাবে নির্বাচন করতে৷ এই দুই চাহিদার বাইরে পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ থেকে বারবারই বলা হয়েছে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের কথা৷ তেমন নির্বাচন করতে না পারলে তারা নানা ধরনের প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলেও ঘোষণা করেছে৷ কিন্তু এতে তেমন একটা কাজ হয়েছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে না৷
পশ্চিমা বিশ্বের পরামর্শ, মন্তব্য বা হুঁশিয়ারিতে প্রথম দিকে সরকার কিছুটা হলেও থমকে গিয়েছিল বলে ধারণা করা যায়৷ কারণ তখন দেখা গিয়েছিল তারা বিরোধীদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে দিচ্ছে৷ গ্রেপ্তার বা মামলার ঘটনাও অনেকটা কমে গিয়েছিল৷ সরকার হয়তো ভেবেছিল, এসব করে তারা পশ্চিমাদের সঙ্গে একটা আপস করতে পারবে৷ কিন্তু বাস্তবে সেটা সম্ভব হয়নি৷ দৃশ্যত এখনো মনে হচ্ছে, গণতন্ত্র এবং জনগণের ভোটাধিকারের প্রশ্নে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের পূর্বের অবস্থান থেকে মোটেই নড়েনি৷ অনেকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যা কিছু বলছে সেটা যতটা না বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য, তারচেয়ে অনেকটাই বেশি আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে কিছু সুবিধা প্রাপ্তির লক্ষ্যে৷ সে লক্ষ্যটি অর্জিত হচ্ছে না বলেই তারা এখন মুখে গণতন্ত্রের কথা বলছে৷ এটা হতে পারে, এমন মত একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না৷ এটা যদি সত্য হয়েও থাকে, তারপরও এদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের যে বিষয়টিকে তারা সমানে নিয়ে এসেছে, সেটাও কিন্তু গুরুতর৷ সরকারের ওপর চাপ দেওয়ার জন্য পশ্চিমা দেশগুলো আসলে অত্যন্ত পপুলার একটা ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসেছে৷ ফলে তারা সাধারণ মানুষের সমর্থন পাচ্ছে৷
দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা খুবই ভালোভাবে চলছে, এমন দাবি করা সহজ নয়৷ রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি এতটাই প্রবলভাবে ঢুকে পড়েছে যে উচ্চ আদালতের বিচারকগণও এখন প্রকাশ্যে স্বীকার করেন যে তারা এক একজন ‘শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ৷’ একটি রাজনৈতিক দল যখন রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করে, তখন সে দেশে ভিন্ন রাজনৈতিক মতের অবাধ বিচরণ কিভাবে সম্ভব হতে পারে? অবধারিতভাবেই দেশে তখন একটা কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন প্রতিষ্ঠা হয়৷ সেটাই চলছে এখন বাংলাদেশে৷
আজকে এই যে রাজনৈতিক বিরোধ বা আন্দোলন এর মূলে কিন্তু নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে দ্বন্দ্ব৷ সরকারি দল চাচ্ছে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে৷ অর্থাৎ নির্বাচনের সময় তারাই ক্ষমতায় থাকবে, প্রশাসনকে তারা যেভাবে সাজাবে সেভাবেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে৷ আর বিরোধীরা দাবি করছে নির্বাচনের সময় একটা নির্দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকবে৷
বাংলাদেশে এ যাবত মোট ১১টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ এর মধ্যে সাতটি নির্বাচন হয়েছে দলীয় সরকারের আমলে, আর চারটি নির্বাচন হয়েছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে৷ দলীয় সরকারের অধীনে হওয়া সাতটি নির্বাচনেই দারুণভাবে বিজয়ী হয়েছে সেই সময়ে ক্ষমতাসীন দলগুলো৷ অর্থাৎ ক্ষমতার কোনো পরিবর্তন হয়নি৷ প্রতিবারই বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে ওইসব নির্বাচনে বিপুল কারচুপির অভিযোগ করা হয়েছে৷ অন্যদিকে নির্দলীয় সরকারের অধীনে হওয়া চারটি নির্বাচনের প্রতিটিতেই সরকারি দল পরাজিত হয়েছে, ক্ষমতায় এসেছে বিরোধীদল বা জোট৷ এ নির্বাচনগুলো নিয়েও হেরে যাওয়া দলগুলো আপত্তি তুলেছে, কারচুপির অভিযোগ করেছে, তবে সেসব অভিযোগ খুব একটা জোরালো হয়নি৷
এই ইতিহাসকে বিবেচনায় নিলে এটা স্পষ্টই বোঝা যায় যে, বিরোধী জোটের দাবি মেনে নিয়ে যদি নির্দলীয় কোন সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়, সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে সরকারি দলের পরাজয়ের৷ জেনেশুনে সরকারি দল সেটা করতে যাবে কেন? বিপরীত দিকে বিরোধী দল যদি সরকরি দলের অধীনেই নির্বাচনে যায়, তাদের পরাজয়ের সম্ভাবনাও ৯৯ শতাংশ৷ জেনে বুঝে তারাই বা সেটা কেন সেই আত্মহত্যা করতে যাবে? অর্থাৎ দুই পক্ষের জন্যই পরিস্থিতিটা জীবন-মরণ সংকটের৷ হতাশার বিষয় হচ্ছে-দুপক্ষের এই অবস্থানের মধ্যে জনগণের স্বার্থটা তেমন একটা নেই৷ আছে প্রধানত কিভাবে ক্ষমতায় থাকা যায় অথবা যাওয়া যায়-এই বিষয়টি৷
পুরো রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হচ্ছে ইতিহাস রিপিট এর বিষয়টি৷ আজ বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলো যে দাবি করছে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলছে, ঠিক এই দাবিটিই ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ করেছিল৷ আজ যে ভাষায়, সংবিধানের অজুহাতে, আওয়ামী লীগ প্রত্যাখ্যান করছে বিএনপির দাবিকে, ১৯৯৬ সালে বিএনপিও একই ভাবে সেটা করেছিল৷ আজ শেখ হাসিনার কণ্ঠে যে কথাগুলো উচ্চারিত হচ্ছে, সেদিন খালেদা জিয়ার কণ্ঠেও এই কথাগুলেই উচ্চারিত হয়েছিল৷ সে সময় শেষ পর্যন্ত বিরোধীদের দাবিতে পর্যুদস্ত হয়ে, অথবা দেশের ভালোর কথা বিবেচনা করে, যেভাবেই হোক বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিকে সংবিধানে সংযোজিত করেছিল৷ তার সুফল ১৯৯৬ এবং ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ পেয়েছে, ক্ষমতায় আসতে পেরেছে৷ ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর আবার আওয়ামী লীগই তাদের আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিকে সংবিধান থেকে বিদায় করেছে৷ এখন তারাই হয়ে দাঁড়িয়েছে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির সবচেয়ে বড় বাধা৷ এটাই হচ্ছে উর্বর এই মাটির রাজনীতি৷ এক্ষেত্রে আরও একটা কৌতুককর বিষয় হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতির কুফল প্রমাণে আওয়ামী লীগ যে ওয়ান ইলেভেন সরকারের কথা বলে থাকে, সেটাকে কিন্তু সেই সময়ে তারা তাদেরই ‘আন্দোলনের ফসল’ হিসাবে অভিহিত করেছিল৷ সবাই জানেন, ওয়ান ইলেভেন সরকার না আসলে ২০০৮ এর নির্বাচনই হতো না, আওয়ামী লীগও ক্ষমতায় আসতো না৷ ২০০৭ এর জানুয়ারির ২২ তারিখে যে নির্বাচনকে সাজিয়ে নিয়েছিল বিএনপি সরকার, সেটা বাস্তবায়িত হলে বিএনপিও বোধ করি বর্তমানে আওয়ামী লীগ যেমন একটা ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ করে নিয়েছে তেমন কিছু একটা করতে পারতো৷ ফলে এমন কথা বলাই যায় যে, আওয়ামী লীগ আসলে বিএনপির দেখানো পথেই অগ্রসর হচ্ছে৷ পার্থক্য কেবল, বিএনপি যে ভুলগুলো করেছে, সেখান থেকেই শিক্ষা নিয়ে আওয়ামী লীগ সেগুলো এখনো পর্যন্ত করছে বলে মনে হয় না৷ সেই সঙ্গে ১৫ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকার কারণে তাদের নিগড় আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি কঠিন হয়ে গেছে৷
এতকিছুর পরও যে প্রশ্নটি অবধারিতভাবে চলে আসে সেটা হচ্ছে-তাহলে কী হবে এরপর? নির্বাচন কি হয়েই যাবে? দেশ কি এভাবেই চলবে? এসব প্রশ্নের আসলে খুব সহজ কোনও উত্তর নেই৷ তবে আমার মনে হয়, নির্বাচন হয়ে যাবে, সরকার যেভাবে চাচ্ছে অনেকটা সেভাবেই নির্বাচন হয়ে যাবে৷ কিন্তু নির্বাচন হওয়াটাই তো শেষ নয়৷ এর পর কী হবে? দেশটাকে তো চালাতে হবে৷ নির্বাচন যদি পশ্চিমা দেশগুলোর প্রত্যাশা অনুযায়ী না হয়, তারা যদি মনে করে নির্বাচনটি যথাযথ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হয়নি, তখন তারা কি আমাদের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বর্তমানের মতোই রাখবে? সেখানে কি কিছুটা হলেও শীতলতা তৈরি হবে না? যদি হয়, সে চাপ কি আমরা নিতে পারব?
নির্বাচনের আগে পর্যন্ত এমন অনেক প্রশ্ন সকল মহলে উচ্চারিত হতেই থাকবে৷