মধ্যবিত্ত তরুণদের বিচ্ছিন্নতার শেকড়
১ মে ২০১৮বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মধ্যে কাজ করে যাচ্ছে ৪০ লক্ষ পোশাক শ্রমিক, যার অধিকাংশই নারী৷ রানা প্লাজার রক্তের দাগ, তাজরীনে পোড়া দগদগে ঘা এখনো শুকায়নি৷ পোশাক কারখানার মালিকেরা শ্রম আইনের ধার ধারেন না৷ তাঁরা কথায় কথায় শ্রমিক ছাঁটাই করেন, বিনা নোটিশে কারখানা বন্ধ করে দেন, শ্রমিকদের পাওনা বেতন-বোনাস দিতে গড়িমসি করেন৷ সরকার কিংবা মালিকদের ধামাধরা না হলে ট্রেড ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন হয় না৷ বাংলাদেশে শ্রম আইনে কিছু গণতান্ত্রিক সংস্কার করার প্রয়োজন থাকলেও তা না করে সরকার পূর্বতন সরকারগুলোর ধারাবাহিকতায় শ্রম আইনের আরো শ্রমিক স্বার্থবিরোধী সংশোধন করার পাঁয়তারা করছে৷
বাংলাদেশে রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ পোশাক খাত থেকে এলেও এই সেক্টরে শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি মাত্র ৫,৩০০ টাকা৷ পোশাক শ্রমিকেরা বর্তমান বাজারদর বিবেচনা করে ১৬ হাজার টাকা নিম্নতম মজুরির দাবি তুলেছেন৷ শ্রমিকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এ দাবি৷ এর পরিপ্রেক্ষিতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ছে, বিভিন্ন জায়গায় শ্রমিকদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে৷ একটা মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়েছে, যা বসতে বসতেই দীর্ঘ সময় পার হয়ে যাচ্ছে৷ প্রতিবারই মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন যখন হয়, তখন শ্রমিকদের উপর নেমে আসে জেল, জুলুম, নির্যাতন৷
সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার অধীনে তৃতীয় বিশ্বের একটি লুটেরা বুর্জোয়া শাসিত রাষ্ট্রে এমনটি হওয়া অস্বাভাবিক নয়৷ অস্বাভাবিক হচ্ছে, শ্রমিক ইস্যুতে তথাকথিত ‘সিভিল সোসাইটি' তথা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের নির্লিপ্ততা ও উন্নাসিকতা৷ শাসকশ্রেণির তৈরি করা বয়ানের বিপরীতে পালটা বয়ান তৈরির মতো বুদ্ধিজীবীর সংখ্যাও অত্যন্ত কম৷ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি, বিশেষত তরুণেরা শ্রমিক অধিকারের প্রশ্নে তেমন একটা সোচ্চার নন৷ সম্প্রতি শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে জেল খাটা সাবেক ছাত্রনেতা জলি তালুকদার, মঞ্জুর মঈনের মতো কিছু ব্যতিক্রমী উদাহরণ ছাড়া বর্তমান সময়ে ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের ছাত্রজীবন শেষ করে শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে দেখা যাচ্ছে না৷ শিক্ষিত রাজনীতিসচেতন মধ্যবিত্তের সাথে সমাজের বিপুল মেহনতি মানুষের সংযোগ হচ্ছে না৷ এই কারণেও গার্মেন্ট সেক্টরসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সেক্টরে সরকার ও মালিকপক্ষ বাধাহীনভাবে একচেটিয়া জুলুম চালিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে৷
২.
পাকিস্তান আমলে আমাদের এই অঞ্চলের গৌরবময় ইতিহাসের পাঠ থেকে আমরা দেখি, সেসময় ছাত্র আন্দোলনের বিকাশ আমাদের মুক্তিসংগ্রামের মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছিল৷ আমরা লক্ষ্য করি, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ছাত্রসমাজের ভেতর দরিদ্র কৃষকশ্রেণির সন্তানদের সংখ্যার আনুপাতিক বৃদ্ধি ঘটে৷ এছাড়া, শাসকশ্রেণি গণবিরোধী শিক্ষানীতি ও পূর্ব বাংলায় শিক্ষা সংকোচনের নীতি গ্রহণ করলেও স্থানীয় উদ্যোগে পূর্ববাংলায় অসংখ্য স্কুল কলেজ গড়ে ওঠে৷ নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা ছাত্ররা ছাত্র আন্দোলনকে ক্রমশ ব়্যাডিকাল চরিত্র নিতে প্রভাবিত করে৷ ভিয়েতনামসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব ইউরোপ, চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলে বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা সেই সময়ে বহু তরুণকে উদ্বুদ্ধ করে৷ সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ছাত্রসমাজ এবং গণমানুষের মধ্যে এক নিবিড়, অর্গানিক যোগাযোগ এবং আত্মার সম্পর্ক স্থাপিত হয়৷ ছাত্রসমাজ ক্রমশ তাই জনগণের আশা-আকাঙ্খাকে ধারণ করার উপযোগী হয়ে ওঠে৷ তারই প্রমাণ আমরা দেখি, ছাত্র আন্দোলনে শ্রমিকরাও মাঠে নেমে লড়াই করে, ৬২'র আন্দোলনে শ্রমিক সুন্দর আলী শহিদ হয়৷ ছাত্র-ছাত্রীরাও লাল ঝান্ডা নিয়ে সংগঠিত করতে থাকে শ্রমিক কৃষকের সভা৷ ছাত্র আন্দোলনপর্ব শেষ করে তরুণরা শ্রমিক রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে৷ সাহসী, ত্যাগী, কষ্টসহিষ্ণু নেতা-কর্মীরাই তখন ছাত্র-যুব আন্দোলনের প্রাণভোমরা৷
মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বামপন্থি, প্রগতিশীল ছাত্ররা ছয় দফার অসম্পূর্ণতা দূর করতে ১১ দফার কর্মসূচি ঘোষণা করে৷ সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা, একচেটিয়া পুঁজিবাদের বিলোপ, কৃষক-শ্রমিকের বিভিন্ন দাবি, ছাত্রসমাজের শিক্ষা বিষয়ক দাবি ইত্যাদি যুক্ত করে ছাত্রসমাজ ১১ দফাকে পরিণত করে বাংলার গণমানুষের মুক্তির সনদে৷ সবকিছু মিলিয়েই ছাত্রসমাজ এ দেশের প্রেক্ষাপটে তখন সমাজ বদলের এক প্রগতিশীল চরিত্র হয়ে ওঠে৷ বদলে যাওয়া এ ছাত্র-যুবসমাজ ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়৷ ব়্যাডিকেল ছাত্রসমাজের জঙ্গি মনোভাব স্বাধীনতার দাবিকে সামনে তুলে আনে, দেশের সর্বস্তরের মানুষ ভ্যানগার্ড ছাত্র-যুবদের লড়াইকে সমর্থন করতে থাকে, কারণ, ছাত্র-যুবরাই তখন জাতির প্রত্যাশাকে ধারণ করতে পারছিল কৃতিত্বের সাথে৷ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধেও ব্যাপকসংখ্যক শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিল ছাত্রসমাজ৷
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়েও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণদের মধ্যে আদর্শবাদী রাজনীতির ধারাটি শক্তিশালী ছিল৷ সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের পর নানাভাবে কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-যুব আন্দোলনকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হলেও প্রগতিশীল চিন্তাচেতনাকে দমিয়ে রাখা যায়নি৷ সে সময়কালের বিভিন্ন আন্দোলনে মেহনতি মানুষের সাথে শিক্ষিত রাজনীতিসচেতন জনগোষ্ঠীর দূরত্বটা এখনকার মতো পর্বতসম হয়ে যায়নি৷ গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে ছাত্রদের সাথে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ শরিক হয়েছিল৷ এ সময়কালেও আমরা দেখি কমরেড তাজুলের মতো বীর যোদ্ধা, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েও যুক্ত হন শ্রমিক আন্দোলনে, কিংবা শহিদ টিটো, যিনি ছাত্র আন্দোলনের সাথে সাথে যুক্ত হন ক্ষেতমজুর আন্দোলনে, এবং উভয়েই স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে শহিদ হন৷
অথচ, ছাত্র আন্দোলনকে কলুষিত করার সবরকম প্রচেষ্টাই চলেছে বিভিন্ন সময়ে৷ স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া থেকে শুরু করে, মাদকের বিস্তার, শিক্ষাখাতে অব্যাহত বৈষম্য ইত্যাদি বাস্তবতার পরিবর্তন না হলেও, ছাত্র-যুব আন্দোলনে আদর্শবাদী একটি ধারা কিন্তু ৯০-পূর্ব সময়েও বেশ শক্তিশালী অবস্থানে ছিল৷ ছাত্ররাও ছিল অধিকতর গণসম্পৃক্ত ও রাজনীতিসচেতন৷ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের উত্থাপিত দশ দফা সেটিই প্রমাণ করে৷
৩.
১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের ফলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলেও তা হয়নি৷ ৯০ পরবর্তীতে গোটা দুনিয়াতেই এক বড় ধরনের পরিবর্তন আসে৷ পতন হয় সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের৷ একমেরু বিশ্বের অধিপতি হয়ে ওঠে সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্র৷ এদেশে অনেকেই সমাজতন্ত্রের শেষ দেখে ফেলেন৷ অনেক প্রগতিশীল তরুণ হতাশ হয়ে পড়ে, শিক্ষিত মধ্যবিত্তনির্ভর বাম আন্দোলনে তা বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলে৷ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এই দুর্বলতার সুযোগে খুব সহজেই সিভিল সোসাইটিতে সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাদর্শনের আধিপত্য তৈরি করে৷ ‘সুশীল সমাজ' নামের অভিজাত বুদ্ধিজীবীদের উত্সাহিত করা হয়, যারা মুক্তবাজারের গুণগান গাইতে থাকে৷ কর্পোরেট-বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এদেশে বিস্তার লাভ করে, সামান্য ঋণের বিনিময়ে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এর নির্দেশ মেনে চলে নতজানু লুটেরা শাসকগোষ্ঠী৷ এনজিও বিস্তার লাভ করে৷ এনজিওগুলো মানবাধিকার, দারিদ্র্য বিমোচনের গালভরা বুলি আর মোটা অংকের বেতন দিয়ে শিক্ষিত তরুণদের প্রলোভন দেখাতে থাকে৷ বিশেষত প্রগতিশীল শিক্ষিত তরুণরা হয় এদের টার্গেট৷
এ সময়কালে ক্রমবর্ধমান কোচিং বাণিজ্য, শিক্ষা উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অনেক মেধাবী দরিদ্র শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটছে৷ উচ্চশিক্ষায় বাজারমুখী শিক্ষাকে উত্সাহিত করা হচ্ছে, বাণিজ্যিকীকরণ ঘটছে৷ বাণিজ্যিকীকরণের ধারাবাহিকতায় গত দুই দশকে একের পর এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা হয়েছে, যেখানে মানবিক মানুষ তৈরি করার পরিবর্তে কর্পোরেট চাকুরে তৈরি করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে৷ জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার বদলে ইনফরমেশনভিত্তিক খন্ডিত শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে৷ মানবিক সৃষ্টিশীলতাকে উত্সাহিত না করে, শিক্ষার্থীদের সৃজনতার বিকাশ না ঘটিয়ে, বাজার ব্যবস্থার সাথে সংগতিপূর্ণ আত্মকেন্দ্রিক ক্যারিয়ারমুখী শিক্ষাকে উত্সাহিত করা হচ্ছে৷ ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব, কিছু শিক্ষকের দায়িত্বহীনতা ও অন্ধ লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির শিকার হয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রকৃত উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত হতে পারছে না৷ মাদকের অবাধ বিস্তার অনেক হতাশাগ্রস্ত তরুণকে গ্রাস করছে৷ ৯০-পরবর্তী গণতন্ত্রের (!) এই সময়ে, ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে, ডাকসুসহ ছাত্রসংসদ নির্বাচনকে নানা কৌশলে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷
লুটপাটের মহোত্সবে ক্ষমতায় টিকে থাকা ও ক্ষমতায় যাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ছাত্ররা৷ হল দখল-চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি-অস্ত্রবাজির অপরাজনীতি গ্রাস করছে ছাত্র আন্দোলনকে, কলুষিত করছে শিক্ষাঙ্গনকে৷ ছাত্র রাজনীতির নামে এই ধরনের কর্মকাণ্ডের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে শিক্ষিত তরুণদের এক বিরাট অংশ চিরকালের জন্য রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়ছে এবং ছাত্র-যুব আন্দোলনের প্রতি আস্থা হারিয়ে; ক্যারিয়ারসর্বস্ব, বিচ্ছিন্ন মানুষ হয়ে নিজের অজান্তেই এই বর্বর সমাজব্যবস্থাটাকেই টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা পালন করছে৷ সর্বগ্রাসী হতাশার এই ব্যক্তিবাদ, ভোগবাদ ও খোলাবাজারের যুগে বামপন্থি, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোও তরুণদের আর নতুন কোনো স্বপ্ন দেখাতে পারছে না৷
৯০-পরবর্তী তরুণদের অনেকেই ‘আই হেট পলিটিক্স' বলে রাজনীতি ও আন্দোলন থেকে দূরে সরে গেছে, একধরণের হতাশা এবং অপ্রাপ্তির বেদনা থেকেই৷ আবার অনেকে বিশ্বব্যাপী গড়ে ওঠা উগ্র প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থার প্রভাবে জড়িয়ে পড়ছে জঙ্গিবাদী কার্যক্রমে৷
৪.
এ সময়কালে গানে-নাটকে-সিনেমায়-সাহিত্যে সামাজিক বাস্তবতা ফুটে উঠতে খুব কমই দেখা যায়৷ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভাষায়, প্রচলিত মূল্যবোধ কিংবা সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো ধরনের জিজ্ঞাসার সম্মুখীন করতে সাম্প্রতিক কথাসাহিত্য ব্যর্থ, কবিতা জীবনের স্পন্দন ও প্রেরণা থেকে বঞ্চিত৷ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোও শাসকশ্রেণির স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত৷ আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির পাটাতন শক্ত না থাকায়, এ সময়কালে, ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইট চ্যানেলের মাধ্যমে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে ভিনদেশি সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের ঘটনা ঘটছে৷ নিত্যনতুন চাহিদা তৈরি হচ্ছে বিজ্ঞাপনের প্রলোভনে৷ অ্যান্ড্রয়েড ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া তরুণদের মনোজগতে বিশাল প্রভাব বিস্তার করছে, ভার্চুয়াল জগতে অখন্ড মনোযোগ বাস্তব জগতকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে৷ অনেক শিক্ষিত তরুণ সোশ্যাল মিডিয়ায় খোলাখুলিভাবে নিজেদের মত প্রকাশ করছে, নিজেদের মাঝে যোগাযোগ তৈরির মাধ্যমে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছে৷ সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কিছু আন্দোলনে সোশ্যাল মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও রাখছে৷ কিন্তু রাজনীতিসচেতন ও সংগঠিত নেতৃত্বের অভাব সেই আন্দোলনগুলোকে পরিণতি দিতে পারছে না৷ ইন্টারনেটের মাধ্যমে সত্য-অসত্য তথ্য এখন আগের চাইতে অনেক সহজলভ্য৷ কিন্তু দুনিয়াকে সামগ্রিকভাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে না উঠলে, সমাজ বিকাশের ধারাকে বুঝতে ব্যর্থ হলে সেসব তথ্য তেমন কোনো কাজে আসে না, বরং বিভ্রান্তির জন্ম দিতে পারে৷
বর্তমান সমাজবাস্তবতা, সিভিল সোসাইটিতে বুর্জোয়া আধিপত্য ও বিচ্ছিন্নতার চর্চার কারণে পুঁজিবাদী সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়ায় অনেক সচেতন তরুণও বিচ্ছিন্নতা, হতাশা ও আত্মমুখীনতার দর্শনের সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছে৷ সমাজে বিদ্যমান নানা অসংগতি নিয়ে তাঁরা সচেতন হয়তো হচ্ছেও, কিন্তু প্রত্যেকটি অসংগতিকে তাঁরা একেকটি বিচ্ছিন্ন ডিসকোর্স হিসেবে মনে করছে এবং তাঁদের মধ্যেকার সংযোগসূত্রকে খুঁজে পাচ্ছে না৷ কাঠামোবিরোধিতার কাঠামোতে তাঁরা ঘুরপাক খেতে থাকছে৷
সমাজবিকাশের মূলধারাকে তাঁরা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হচ্ছে, বাছবিচারবিহীনভাবে প্রচলিত সবকিছুকেই খারিজ করার নৈরাজ্যবাদী চিন্তার জগতে তাঁরা পতিত হচ্ছে৷ উপরিকাঠামোর নানা অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁরা সংগ্রাম করতে চায়, কিন্তু সমাজ সম্পর্কিত বোধ ও গণবিচ্ছিন্নতার কারণে অন্যায়-অবিচারের মূল দুর্গকে তাঁরা চিহ্নিত করতে পারে না৷
এই বাস্তবতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে প্রগতিশীল তরুণেরা যে লড়াই করছে না, তা নয়৷ গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনে আমরা দেখলাম এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণরা মাঠে নামলো, আন্দোলনকে সংগঠিত করলো৷ তবু সেই বিচ্ছিন্নতা তাঁদের আন্দোলনকে শেষ পর্যন্ত শহুরে মধ্যবিত্তদের আন্দোলনের কানাগলিতে আটকে ফেললো৷ শহুরে শ্রমিক ও গ্রামীণ কৃষিজীবী খেটে খাওয়া মানুষের সাথে তাঁদের এই দূরত্বের সুযোগ নিলো মৌলবাদী শক্তি এবং সরকার সেই আন্দোলনকে কাজে লাগালো নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নে৷ সম্প্রতি ছাত্র-তরুণদের কর্মসংস্থানের দাবি শেষ পর্যন্ত কোটা সংস্কারের ছোট গন্ডিতে আটকে পড়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে সফল হলো না৷ বাংলাদেশে তৃতীয় প্রজন্মের শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্তের সাথে গার্মেন্ট শ্রমিকসহ সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের দূরত্ব উভয়ের আন্দোলনকেই ক্ষতিগ্রস্ত যেমন করছে, তেমনি এই বিচ্ছিন্নতা বাংলাদেশের রাজনীতিকেও প্রগতিশীল পথে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে৷
বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের নেতৃত্বে অন্যান্য শিল্প শ্রমিক, ক্ষেতমজুর-প্রান্তিক কৃষক-মধ্যকৃষক, রিকশা শ্রমিকসহ অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ৷ একসময় প্রগতিশীল পরিবর্তনকামী রাজনৈতিক দল ও মেহনতি মানুষের মধ্যে যোগাযোগের সেতুস্বরূপ ছিল উদ্যমী শিক্ষিত তরুণেরাই৷ কিন্তু পরিবর্তিত সময়ে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোকেই বিশেষভাবে নজর দিতে হবে এই বিচ্ছিন্ন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণ সমাজের সাথে মেহনতি মানুষের বিচ্ছিন্নতা ঘোচাতে৷ তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে, টেনে আনতে হবে তাঁর নিজের তৈরি বিচ্ছিন্নতার মেকি জগত থেকে৷ নির্মাণ করতে হবে গণমানুষের পক্ষে সময়োপযোগী গান-কবিতা-কথাসাহিত্য-নাটক-চলচ্চিত্র৷ বিদ্যমান বিচ্ছিন্নতার, স্বার্থপরতার, ভোগবাদী দর্শনের বিপরীতে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মীদের পালটা আধিপত্য তৈরি করতে হবে৷ এই পালটা আধিপত্য গড়ে তোলার সংগ্রামে শিক্ষিত তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে, তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের সাথে, অন্যথায় বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি প্রতিক্রিয়াশীলতার চোরাবালিতে একটু একটু করে তলিয়ে যেতে থাকবে৷
তরুণরা কেন সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে? মতামত লিখুন নীচের ঘরে৷