1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উগ্র জাতীয়তাবাদ

২৩ জুলাই ২০১৮

বিশ্বে উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান লক্ষণীয়৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের পর এ নিয়ে উদ্বেগ, আলোচনা আরো বেড়েছে৷ অভিবাসীবিরোধী যে প্রচারণা ইউরোপ ও আ্যামেরিকায় পোক্ত হচ্ছে, তা নতুন আশঙ্কার কথাই জানান দিচ্ছে৷

https://p.dw.com/p/31rPU
Bangladesch - die Stunde der Islamisten
ছবি: DW/H. C. Ostermann

তাহলে এশিয়ার দেশ বাংলাদেশের অবস্থা কী? এখানে কি উগ্র জাতীয়তাবাদের কোনো প্রবণতা আছে? আছে কি কোনো লক্ষণ? বাঙালি জাতীয়তাবাদ কি এখানকার অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে অস্বীকার করতে চায়? সংবিধান আদিবাসীদের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী হিসবে স্বীকৃতি দিতে চায় না কেন?

এখানে ধর্মীয় উগ্রবাদী তৎপরতা আছে৷ আছে সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ, নির্যাতনের অজস্র ঘটনা৷ অন্যদিকে রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব বাড়ছে৷ ধর্মের নামে ভিন্ন চিন্তার মানুষের ওপর হামলা, হত্যাও ঘটছে৷ হেফাজতের চাপে পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনা হয়েছে৷ সুপ্রিম কোর্টের সামনে স্থাপিত নারী ভাস্কর্য সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে সরকার৷ এই বিষয়গুলোকে কিভাবে ব্যখ্যা করা যায়? এটা কি কোনো উগ্র জাতীয়তবাদের লক্ষণ? এ সব প্রশ্নের জবাব ও প্রেক্ষাপট খুঁজতে গিয়ে যা পাওয়া যায়, তা আশঙ্কার জন্ম দেয়৷ সাধারণভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে উগ্র জাতীয়তাবাদ বলতে যা বুঝায় তা এখনো নেই৷ কিন্তু নানাভাবে যেসব পরিবেশ ও পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে জাতীয়তাবাদের উগ্রতার লক্ষণগুলো কম-বেশি দেখা যায়৷ আর সেই প্রবণতাগুলো চিহ্নিত করে কাজ করা প্রয়োজন৷ নয়ত কোনো এক সময়ে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে৷

‘এক সময় রাষ্ট্র চেষ্টা করেছিল সবাইকে বাঙালি বানানোর’

বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের আরো কয়েকটি অঞ্চলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস৷ সাংবিধানিকভাবে তাঁদের ‘উপাজাতি' বলা হয়৷ কিন্তু তাঁরা নিজেদের আলাদা জাতি হিসেবে দাবি করেন এবং আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পাকিস্তান শাসনামালে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আমাদের ঐক্যবদ্ধ করায় ভূমিকা রেখেছে৷ কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই আমরা দেখছি, বাঙালি জাতীয়তার নামে এইদেশে বাঙালি ভিন্ন অন্য যে জাতি আছে তাঁদের অস্বীকার করার কাজটা শুরু হয়৷ এই কারণেই এক সময় রাষ্ট্র চেষ্টা করেছিল সবাইকে বাঙালি বানানোর৷ বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবেই একটি বহু জাতিসত্ত্বার দেশ৷ বাংলাদেশে এখন বাঙালি ছাড়াও অন্তত ৭৮টি জাতিসত্ত্বা আছে৷ বাংলা ছাড়াও বাংলাদেশে অনন্তত ৪৩টি ভাষা আছে৷ আমাদের সংবিধান বলছে, জাতি হিসেবে আমরা বঙালি৷ যাঁরা বাঙালি, তাঁরা বঙালি৷ নাগরিকত্বে আমরা সবাই বাংলাদেশি, সেটা খুবই ঠিক আছে৷ কিন্তু এখানে সবাই বাঙালি নয়৷ বাঙালি ছাড়া আরো অনেক জাতি আছে৷ কিন্তু সংবিধানে তাঁদের  স্বীকৃতি নেই৷''

তিনি বলেন, ‘‘পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সমস্যা চলছে তার পিছনে এটা একটা কারণ৷ শান্তি চুক্তি যদি বাস্তবায়ন না হয় আর যদি ‘আমরা সবাই বাঙালি' এটা সংশোধন না করা হয়, তাহলে এটা একটা উগ্র জাতীয়তাবাদের দিকে আমাদের ধাবিত করবে৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশে যে ধর্মীয় উগ্রবাদ আছে, তার সঙ্গে আবার রাজনীতি ও ধর্মীয় রাজনীতির যোগাযোগ আছে৷ সেইসব গোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় বাঙালিত্ব ব্যবহার করে৷ একটি হলো উগ্র বাঙালিত্ব সেই সঙ্গে ধর্মীয় উগ্রবাদ৷ এই দু'টি মিলে একটা অদ্ভুত রকমের একটা প্রতিক্রিয়াশীল মিশেল তৈরি হয়৷ সেটা কিন্তু খুব বিপজ্জনক বিষয়৷ সেটা আমাদের সকলের সমানাধিকার এবং সম নাগরিকত্বের ব্যাপারে বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে৷''

বাংলাদেশে উগ্র জাতীয়তাবাদ সেই অর্থে না থাকলেও, তার যে উপাদান নেই, তা কিন্তু মনে করেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ৷ তিনি মনে করেন, এখানে ভাষা, রাজনীতি এবং ধর্মীয়ভাবে উগ্রবাদের লক্ষণ স্পষ্ট৷ তবে অর্থনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্রে যে উগ্র জাতীয়তাবাদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বাংলাদেশে তার কোনো আশঙ্কা নাই৷ কারণ, এখানকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শতকরা ৭ ভাগের বেশি৷ আর উগ্রবাদের পিছনে নানা স্বার্থ কাজ করে৷

‘উগ্রবাদ থেকে অসহিষ্ণুতা ও তা থেকে জঙ্গিবাদ তৈরি হচ্ছে’

তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘উগ্র জাতীয়তাবাদ বাংলা ভাষা নিয়ে আছে বলেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সমস্যা রয়ে গেছে কোনো কোনোভাবে৷ আবার অনেকে উগ্র জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে ধর্ম নিয়ে আসে, যেটা আমরা শ্রীলঙ্কায় দেখেছি৷ সিনহালা আর বুদ্ধিস্ট মিলে তামিলদের বিরুদ্ধে যেটা হয়েছে৷ তাই বাংলাদেশেও যখন উগ্র জাতীয়তাবাদের মধ্যে ধর্মীয় উপদান আসে, তখন মাইনরিটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম তো আছে হিন্দু মাইনরিটিও আক্রান্ত হয়৷ জাতীয়তাবাদের মধ্যে এক ধরনের উগ্রতা সব সময় আছে৷ রাজনীতিবিদরা তাদের স্বার্থে এটাকে ব্যবহার করে৷ আবার অর্থনৈতিক মন্দা যখন দেখা দেয়, তখন এই জাতীয়তাবাদ দিয়ে এক ধরনের রাজনীতি করা হয়৷ পুরো বিষয়টির সঙ্গে রাজনীতি জড়িত৷ এখন বাংলাদেশে যেহেতু ৭ দশমিক ১ ভাগ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তাই অর্থনেতিকভাবে উগ্র জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করবে না৷ স্বাভাবিকভাবে বিশ্বায়নের বিষয়টি সামনে আনার চেষ্টা করবে৷ কারণ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বিশ্বায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত৷ সে কোনোভাবে ওই ধরনের অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে যাবে না, যাতে উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রকাশ ঘটে৷''

তিনি বলেন, ‘‘অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে৷ আদিবাসীদের এখন আর আদিবাসী বলা যায় না, বলা হয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী৷ এভাবেও কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রকাশ ঘটে৷''

বাংলাদেশে ধর্মকে ব্যবহার উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রকাশ কতটা ঘটে? বিশেষ করে লেখক, প্রকাশক ব্লগার হত্যা, জঙ্গি হামলা বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর চাপ এগুলোকে কিভাবে ব্যখ্যা করা যায়? অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, ‘‘বাংলাদেশের ৯০ ভাগই মুসলমান৷ এখানে শিয়া-সুন্নির বিষয়টি ঐরকম নেই৷ বলতে গেলে সবাই হানাফি মাযহাবের অনুসারী৷ কিছু জায়গায় হয়ত ওহাবি মাযহাবের তৎপরতা দেখা যায়৷ তবে এগুলোকে রাজনৈকিভাবে ব্যবহার ততটা করা হয় না৷ বাংলাদেশে বিএনপি, জামায়াত  ব্যবহার করে৷ এর মধ্যে ভারতবিরোধিতার একটা ব্যাপার আছে৷ তবে সেটা খুব কাজে আসে বলে মনে হয় না৷ তবে এই উগ্রবাদ থেকে এক ধরনের অসহিষ্ণুতা এবং তা থেকে জঙ্গিবাদ তৈরি হচ্ছে৷ হোলি আর্টিজানের হামলা থেকে মনে হয়, এটার সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি নয় বিশ্বায়নের সম্পর্ক আছে৷''

তিনি বলেন, ‘‘অ্যামেরিকায় উগ্র জাতীয়তাদের সঙ্গে মন্দার একটা সম্পর্ক আছে৷ সেখানকার হোয়াইট পপুলেশনরা মনে করে হিস্পানিকরা তাঁদের দেশ নিয়ে যাচ্ছে৷ মাইগ্রেন্টরা তাঁদের দেশ নিয়ে যাচ্ছে৷ সেটা ডোনাল্ড ট্রাম্প রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে৷ এখন দেখা দরকার এটার সত্যতা আছে কিনা৷ অনেকেই বলছেন, সত্যতা নেই৷ এটা রাজনৈতিকভাবেই ব্যবহার করা হচ্ছে৷''

এই দুই বিশ্লেষকের কথায় এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে উগ্র জাতীয়বাদ মাথাচাড়া দিতে পারে৷ তার উপাদানগুলো এখানে বিদ্যমান৷ তার মধ্যে রয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে সর্বাত্মক মনোভাব এবং অন্য জাতিসত্ত্বাকে স্বীকৃতি না দেয়৷ বাংলাভাষাকে নিয়ে এক ধরনের আধিপত্যবাদী মনোভাব, উগ্র ধর্মীয় মতবাদ, জঙ্গিবাদ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বেচ্ছাচারিতা৷ সঙ্গে রাজনৈতিক শক্তিও কখনো কখনো একে ব্যবহার করে তার স্বার্থে৷ কিন্তু ইতিবাচক দিক হলো, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, যা উগ্র জাতীয়তাবাদকে নিরুৎসাহিত করে৷ এখানে কখনো কখনো উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রকাশও ঘটে৷ কিন্তু এটা অনেকটাই নির্ভর করে রাজনীতির ওপর৷

বাংলাদেশেও কি উগ্র জাতীয়তাবাদ হানা দেবে? মন্তব্য লিখুন নীচের ঘরে৷ 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য