বাংলাদেশকে হারিয়ে ইতিহাস আফগানিস্তানের
২৫ জুন ২০২৪এই বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা ম্যাচ উপহার দিলো বাংলাদেশ-আফগানিস্তান। এই ম্যাচের শেষ ইনিংস মানে বাংলাদেশের ইনিংসের ওপর নির্ভর করছিল তিন দলের ভাগ্য। এমন ম্যাচে বারবার বৃষ্টির বাধা রান রেটের হিসাবকে আরো রোমাঞ্চকর করে তোলে।
সেই রোমাঞ্চ নাটকের শেষটায় বিজয়ী বীর আফগানিস্তান। হাফ সেঞ্চুরি করে একপ্রান্ত আগলে রাখা লিটন দাসকে বিরহের নায়কে রূপান্তর করে তারাই নাম লেখালো সেমিফাইনালে। নাভিন উল হক ও রশিদ খানের ৪ উইকেট করে নেয়া স্পেলে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবার এই গৌরব আফগানিস্তানের। সুপার এইটে জয়হীন থাকলো বাংলাদেশ। আর আফগানদের জয়ে বিদায় নিশ্চিত হলো অস্ট্রেলিয়ার।
ম্যাচের আগে বাংলাদেশের জন্য হিসেব ছিল হয় ৬২ রানে জেতো নয়তো আফগানদের রান ১২.১ ওভারে তাড়া করো। বোলারদের অবিশ্বাস্য বোলিংয়ে আফগানিস্তানের রান নাগালের মধ্যেই থাকে। এখনকার টি-টোয়েন্টিতে ১১৬ রান ১২ ওভারে তাড়া করাও কঠিন না। কিন্তু স্নায়ুর লড়াইয়ে জিততে পারেননি বাংলাদেশ ব্যাটাররা। ১৩ ওভারের মধ্যে রান তাড়ার পেছনে ছুটে ২০ ওভারের হিসেবও গুলিয়ে ফেলেছেন।
ব্যাটিয়ে নামার আগেই বাংলাদেশ জেনে যায় জিততে হবে ১৩ ওভারের মধ্যে। ব্যাটাররা চেষ্টার কমতি রাখেনি। শুরুর ১০ ওভারে সেমিফাইনালে পা রাখার জন্যই লড়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু সেন্ট ভিনসেন্টের স্পিন পিচে রশিদ খানকে সামলানো সহজ ছিলো না। রশিদের ৪ উইকেট বাংলাদেশের সেমিফাইনাল স্বপ্ন কেড়ে নেয়। সঙ্গে বাংলাদেশের হারের এপিটাফও লিখে দেন তিনি।
ছোট রান তাড়াতেও ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া ব্যাটিং লাইনে লিটন দাস আগলে রেখেছিলেন একপ্রান্ত। টি-টোয়েন্টিতে দেশের হয়ে প্রথমবার ব্যাট ক্যারি করার উদাহরণ উপহার দিয়েও জেতাতে পারেননি দলকে। শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ছিলেন ৪৯ বলে ১ ছক্কা ও ৫ চারে ৫৪ রানে। ১৭ ইনিংস পর টি-টোয়েন্টি ফিফটি পেলেন লিটন। এই ফরম্যাটে তার ১১তম।
ইনিংসের ১২তম ওভারে তৃতীয়বারের মতো বৃষ্টি নামলে ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটের নীতি বিরুদ্ধ কাজ করেন আফগান ক্রিকেটার গুলবাদিন নাইব। বৃষ্টি নামার মুহূর্তে ডাগআউট থেকে খেলার গতি কমানোর ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন আফগান কোচ জোনাথন ট্রট। ঠিক তখনই ইনজুরির মতো করে পায়ে হাত দিয়ে শুয়ে পড়েন গুলবাদিন। তাতে দুটি বল করার সুযোগ থাকলেও সময়টা নষ্ট হয়। অথচ বৃষ্টির পর বোলিং করেছেন এই অলরাউন্ডার।
ওই সময় বৃষ্টি আইনের হিসেব মতো নির্ধারিত ওভারে আফগানদের চেয়ে দুই রানে পিছিয়ে ছিলো বাংলাদেশ। ২ বল হয়ে গেলে ওই ব্যবধান কাটিয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল। অবশ্য এই সময়ে বৃষ্টিতে ম্যাচের বিরতি বেশি না হওয়ায় মাত্র ১ ওভার নষ্ট হয়। বাংলাদেশের টার্গেট ২ রান কমে দাঁড়ায় ১১৪।
বাংলাদেশের জন্য এ ম্যাচের টস জেতা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল শান্তর ভাগ্য এদিন সঙ্গ দেয়নি। টস হেরে আগে বোলিং করতে হয়েছে। অধিনায়ক তাতে খুশিই হয়েছেন। টস জিতলেও আগে বোলিং নেয়ার ইচ্ছার কথাই বলেছেন তিনি।
নাজমুলের সন্তুষ্ট থাকার কারণ স্পষ্ট হয়েছে পরে। বোলাররা অসাধারণ বোলিং করে আফগানিস্তান ব্যাটারদের শান্ত রেখেছেন। পুরো ইনিংস জুড়েই ছিল তাদের দাপট। এমনিতে ইনিংসের প্রথম ওভার থেকেই বিধ্বংসী ক্রিকেট খেলা পছন্দ আফগান ওপেনার রহমানউল্লাহ গুরবাজের। এদিন তা হয়নি। তানজিম হাসান সাকিব ও তাসকিন আহমেদ মিলে শুরুর দুই ওভারে দেন মাত্র ৫ রান।
রানের চেষ্টায় প্রথম বলেই আউট হতে পারতেন গুরবাজ। এক রানের জন্য ছুটতে গিয়ে রান আউট হওয়ার মুখে পড়েছিলেন। ক্রিজে ফেরার পথে ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ষা পান। গুরবাজের এই নড়বড়ে অবস্থাটা পুরো ইনিংসে আর কাটেনি। বাংলাদেশ বোলারদের ওপর চড়াও হওয়ার পথ বের করা হয়নি তার।
গুরবাজ গর্জে না ওঠায় আফগানিস্তানের বোর্ডে রানও ওঠেনি। পাওয়ার প্লের ৬ ওভারে মাত্র ২৭ রান পেয়েছে তারা। এর মাঝে পঞ্চম ওভারে সাকিব আল হাসানের বলে কাভারে ইব্রাহিম জাদরানের ক্যাচ ফেলেন তাওহিদ হৃদয়। ৭ রানে জীবন পান ইব্রাহিম। পাওয়ার প্লে শেষে ফিল্ডিং বাঁধা একটু আলগা হতে হাত খোলার চেষ্টা করেন দুই ওপেনার। সপ্তম ও অষ্টম দুই ওভার মিলিয়ে ২০ রান নিলে আফগানদের স্কোরে বোর্ডে কিছুটা গতি আসে।
তবুও ১০ ওভারে ৫৯ রানের বেশি ওঠেনি। নবম ও দশম ওভারে আবারও বাউন্ডারি না হওয়ায় খুব চাপে পড়েন আফগান ওপেনাররা। ওই চাপে পড়ে ১১তম ওভারে লেগ স্পিনার রিশাদ হোসেনকে লং অফ দিয়ে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ২৯ বলে ১৮ করে আউট হন ইব্রাহিম। প্রথম উইকেট পায় বাংলাদেশ।
৫৯ রানে ওপেনিং জুটি ভাঙ্গে আফগানিস্তানের। চলতি বিশ্বকাপে ৪৪২ রান হলো এই উদ্বোধনী জুটির। যে কোনো টুর্নামেন্ট বা সিরিজে কোন এক জুটির এটাই সর্বোচ্চ রান। এই ম্যাচে রেকর্ডটি অবশ্য আফগানিস্তানের জন্য খুশির উপলক্ষ্য এনে দিতে পারেনি। ইব্রাহিমের আউটে আফগানদের ওপর চাপ আরও বাড়ে। উইকেট হারানোর পরের ওভারে তাসকিন কোন রান দেননি। রিশাদের ওভার থেকে শুরু করে টানা ১১ বলে আফগানিস্তান ছিল রানশূন্য। ১১ ও ১২ দুই ওভার মিলিয়ে এসেছে মাত্র ১ রান।
এই দুই ওভার আফগানদের রান তোলার গতিকে আরও পেছনে ঠেলে দেয়। ওই চাপে ছয় বলের ব্যবধানে তিন উইকেট হারাতে হয়। মোস্তাফিজের করা ১৫তম ওভারের চতুর্থ বলে আজমতুল্লাহ ওমরজাই (১০) ফেরেন। পরের ওভারে রিশাদ ফেরান গুরবাজ ও গুলবাদিন নাইবকে (৪)।
১৬তম ওভারের প্রথম বলে রিশাদের বিপক্ষে বড় শট খেলার চেষ্টায় ডিপ কাভারে সৌম্যকে ক্যাচ দেন গুরবাজ। ৫৫ বলে ৪৩ রানের স্বভাববিরুদ্ধ ইনিংস খেলে থামতে হয়েছে গুরবাজকে। বড় শটের নেশায় থাকা কলকাতা নাইট রাইডার্স ওপেনার এই ইনিংসে মাত্র একটি ছক্কা ও ৩টি চার মারতে সফল হন। ১৮তম ওভারে দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার মোহাম্মদ নবি (এক) বিদায় নেন তাসকিনের বাউন্সারে পুল করতে গিয়ে।
শেষদিকে আইপিএল তারকার দিকেই তাকিয়ে ছিলো আফগানিস্তান। দুর্দান্ত পাওয়ার হিটিংয়ে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য আছে রশিদের। তার ব্যাটেই তানজিমের করা শেষ ওভারে দুই ছক্কায় ১৫ রান যোগ হয়েছে দলের বোর্ডে। তাতে পাঁচ উইকেটে ১১৫ রানের পুঁজি দাঁড়ায়। রাশিদ দুই ছক্কা না মারলে এই স্কোর পেত না আফগানিস্তান। কারণ ১৯তম ওভারে মোস্তাফিজ মাত্র এক রান দিয়েছিলেন। ফিজের টানা চার বলে এক রানও নিতে পারেননি রশিদ।
রান তাড়ার শুরুটা ভালোই ছিল বাংলাদেশের জন্য। নাভিন উল হকের প্রথম ওভারে লিটন দাসের এক ছক্কা ও চারে ১৩ রান আসে। পরের ওভারেই রানের লাগাম ধরেন আফগানিস্তান বোলাররা। দ্বিতীয় ওভারে ০ রানে তানজিদ হাসান তামিমকে ফেরান ফজল হক ফারুকী। পরের ওভারে জোড়া আঘাত দেন নাভিন।
এক চারে ৫ রান করা শান্ত নাভিনকে ডিপ মিডউইকেট দিয়ে উড়িয়ে মারতে গিয়ে নবির ক্যাচ হন। পরের বলেই সাকিব আল হাসানকে ফেরান নাভিন। মুখোমুখি হওয়া প্রথম বলে অন সাইডে ফ্লিক করতে গিয়ে মাঝ ব্যাট হয়নি সাকিবের। ব্যাটের বাইরের কানায় লেগে বল হাওয়ায় ভাসে। গোল্ডেন ডাকে আউট হন সাকিব। অবশ্য হ্যাটট্রিক করা হয়নি নাভিনের।
১৩ ওভারের মধ্যে জয়ের তাড়ায় নামা বাংলাদেশ টানা দুই উইকেট হারিয়ে হোঁচট খায়। লিটন ও সৌম্য জুটি বেঁধে সাবধানে খেলা শুরু করেন। এর মাঝে বৃষ্টি এলে ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে। সেই বিরতি আরও এক উইকেট এনে দেয় আফগানিস্তানকে। সপ্তম ওভারে রশিদ খানের জোরের ওপর করা গুগলিতে বোল্ড হন ১০ রান করা সৌম্য। একাদশে ফিরে খুব একটা অবদান রাখতে পারলেন না এই ব্যাটার। ২২ বলে ২৫ রানের জুটি ভাঙে।
দ্রুত রান তোলার ভরসা ছিল তাওহিদ হৃদয়ের ওপর। দুটি চারে সেই ভরসা রাখছিলেন। রান তোলার চাপও বাড়ছিল সমান তালে। তাই রশিদ খানকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে নবম ওভারে ৯ বলে ১৪ রানে ক্যাচ আউট হয়ে থামেন হৃদয়। ৬৪ রানে পাঁচ উইকেট হারিয়ে বেশ চাপে পড়ে বাংলাদেশ।
হৃদয় ফেরার পর মাহমুদউল্লাহ ধীর ব্যাটিংয়ে নয় বলে ছয় রান করেন। নবম ওভারের পর তিন ওভারে ৪৩ রানের দরকার ছিলো বাংলাদেশের। ওই সময় দশম ওভারে অভিজ্ঞ ব্যাটার নিয়েছেন মাত্র চার রান। পরের ওভারে রশিদ শুরুর চার বলে দেন মাত্র ৩ রান। আর শেষ দুই বলে মাহমুদউল্লাহ ও রিশাদ হোসেনকে ফিরিয়ে বাংলাদেশের সেমিফাইনাল স্বপ্ন শেষ করে নিজেদের ইতিহাস গড়ার পথ তৈরি করেন।
সংক্ষিপ্ত স্কোর :
আফগানিস্তান : ১১৫/৫, ২০ ওভার। (রহমানউল্লাহ ৪৩, ইব্রাহিম ১৮, রশিদ খান ১৯*; রিশাদ ৩/২৬, তাসকিন ১/১২)
বাংলাদেশ : ১০৫/১০, ১৭.৫ ওভার। (লিটন ৫৪*, হৃদয় ১৪, সৌম্য ১০; রশিদ ৪/২৩, নাভিন ৪/২৬)
ফল : আফগানিস্তান বৃষ্টি আইনে ৮ রানে জয়ী। ম্যাচ সেরা : নাভিন উল হক।