বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে মুখোমুখি সরকার ও ইসলামপন্থিরা
২৩ নভেম্বর ২০২০ইসলামে ভাস্কর্য নির্মাণ 'নিষেধ' দাবি করে ১৩ নভেম্বর এক সমাবেশে তা বন্ধের দাবি তোলেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিসের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা মামুনুল হক৷
বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানিয়েছে, ঢাকার বিএমএ মিলনায়তনে খেলাফত যুব মজলিস ঢাকা মহানগরীর এক অনুষ্ঠানে মামুনুল এই ভাস্কর্যকে ‘বঙ্গবন্ধুর আত্মার সঙ্গে গাদ্দারি' বলে উল্লেখ করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন করে তারা বঙ্গবন্ধুর সু-সন্তান হতে পারে না৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান একজন মুসলিম হিসেবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন৷ তার মূর্তি তৈরি করে রাস্তার মোড়ে মোড়ে স্থাপন, এটা বঙ্গবন্ধুর আত্মার সঙ্গে বেইমানি করা হবে৷''
কেবল বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যই নয়, ঢাকা শহরের সব ভাস্কর্যকেই ‘অনৈসলামিক' দাবি করে হুঁশিয়ারিও জানান মামুনুল৷ তিনি বলেন, "আমরা বারবার দেখতে পাচ্ছি, এই মসজিদের শহরের গৌরবময় পরিচয়কে মুছে দিয়ে এটাকে মূর্তির শহরে পরিণত করার অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে৷ এ দেশের তৌহিদী জনতা আবার শাপলা চত্বরে যাবে৷”
এরপর ১৯ নভেম্বর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে এক বিক্ষোভেও একই মন্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন মাওলানা মামুনুল৷ সেখানে তিনি বলেন, ‘‘বঙ্গবন্ধু মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান এর প্রতি জাতীয় নেতা হিসেবে আমাদের পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রয়েছে। আমরা চাই না একজন মরহুম, একজন মৃত মুসলমানকে নিয়ে এমন কোনও কার্যকলাপ পরিচালনা করা হোক, যে কার্যকলাপের কারণে কবরের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনও আজাবের সম্মুখীন হতে হয়।''
দেশের সকল মুসলিম নেতাদের ভাস্কর্য বা মূর্তি অপসারণের দাবি জানিয়ে মামুনুল বলেন, ‘‘এই মূর্তি যারই হোক, জিয়াউর রহমানের হোক, এগুলো সরাতে হবে। দেশের মুসলমানরা এই মূর্তি সংস্কৃতি মানবে না।''
হেফাজতে ইসলামের নতুন কমিটিতে যুগ্ম-মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছেন মাওলানা মামুনুল৷ সেই কমিটিতে সংগঠনটির সদ্যপ্রয়াত আমির মাওলানা আহমেদ শফীর অনুসারীদের বাদ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে৷ শফীর অনুসারীরা নতুন কমিটি ‘জামায়াত-শিবির' ও ‘উগ্রপন্থিদের' দখলে যাওয়ার অভিযোগ করে পালটা সংবাদ সম্মেলনও করেছেন৷
বাংলা ট্রিবিউন জানিয়েছে, হেফাজতে ইসলাম নিয়ে এমন আলোচনার মধ্যেই মাওলানা মামুনুল বলেন, ‘‘আমরা মাঠে নামবো, এভাবে ছেড়ে দেবো না৷ হেফাজতের কমিটি আপনাদের মন মতো হয়নি, আপনারা রাগ করেন, অভিমান করেন৷ হেফাজত আপনার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী চলবে না, আলেমদের সমর্থনে চলবে৷ হেফাজত বাংলাদেশের পক্ষে থাকবে৷
অস্বস্তিতে আওয়ামী লীগ ও সরকার
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ বন্ধ দাবি এবং বন্ধ না করলে তা ‘ভেঙে ফেলার' হুমকি সত্ত্বেও সরকারে থাকা বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য দুই সপ্তাহ পরেও পাওয়া যায়নি৷ দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে সাংবাদিকরা এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি উত্তর দিয়েছেন, ‘‘সরকার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে৷''
সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী এমন দাবি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন৷ ১৪ নভেম্বর চট্টগ্রামে এক সমাবেশে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল হুঁশিয়ারি দেন, ‘‘যতটুকু বলেছেন ক্ষমা চেয়ে সাবধান হয়ে যান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করলে ঘাড় মটকে দেবো৷''
১৮ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘রাস্তাঘাটে এখানে সেখানে কারো কোন কথা আমলে নেয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য হবেই।'
মন্ত্রী বলেন, ‘‘সারাদেশেই অসংখ্য ভাস্কর্য আছে। এটা তো নতুন কিছু না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুরসহ সারাদেশেই অনেক স্থানেই আছে। এসব অর্বাচীনদের কথা আমলে নেওয়ার কোন গুরুত্ব দেখি না। রাস্তাঘাটে এখানে সেখানে কারো কোন কথা আমলে নেয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য হবেই।''
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মিত্র ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চসহ নানা সংগঠনের পক্ষ থেকে মামুনুল হকের মন্তব্যের প্রতিবাদ ও তাকে গ্রেপ্তারের দাবিও উঠেছে৷
নানা ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে এ আগেও বিরোধিতা করেছে বাংলাদেশের কিছু ইসলামপন্থি সংগঠন৷ এর আগে গত কয়েক দশকে নানা সময়ে রাজধানী ঢাকার বলাকা ভাস্কর্য ভাঙচুর করে কট্টর ইসলামপন্থিরা, তাদের দাবির মুখে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনের চত্ত্বর থেকে বাউল ভাস্কর্য এবং হাই কোর্টের সামনে থেকে লেডি জাস্টিসের ভাস্কর্যও সরিয়ে নেয়া হয়৷
এডিকে/কেএম (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, বাংলা ট্রিবিউন)