প্রায় সাড়ে পাঁচ ট্রিলিয়ন রূপির হিসাব মেলে না
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩বিশাল অঙ্কের একটা ছোট হিসাব দিয়েই শুরু করি। ২০২২ সালে ভারতের সরকারি ব্যাংকগুলির এনপিএ বা সাদা বাংলায় ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার পরিমাণ ছিল পাঁচ দশমিক চার ট্রিলিয়ন টাকা। এক ট্রিলিয়ন মানে এক লক্ষ কোটি টাকা। আর ২০১৯-এর আগে তার পরিমাণ ছিল সাত দশমিক তিন ট্রিলিয়ন টাকা। এই অঙ্কটা এতটাই বিশাল যে সাধারণ মানুষ তার ধারণাই করতে পারবেন না। বারবার জিজ্ঞাসা করবেন একের পর কতগুলো শূন্য লাগাতে হবে? তা আমরা আদার ব্যবসায়ী, জাহাজের খোঁজ রাখব কী করে?
কিন্তু ঘটনা হলো, আদার ব্যবসায়ী হয়েও এক্ষেত্রে আমাদের জাহাজের খোঁজ রাখতে হচ্ছে। কারণ, এই টাকাটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাদের পকেট থেকেই গেছে। আমরা যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কর দিই, তার থেকেই তো টাকাটা পেয়েছে সরকারি ব্যাংকগুলি। আর তারপর সেই টাকা নিয়ে ফেরত দেননি তাবড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও অন্যরা।
আপনি কোনো ব্যাংকে গিয়ে ঋণ নিতে চান, দেখবেন তাতে কতগুলি স্তর পার হতে হয়। আপনি কী করে টাকা ফেরত দেবেন, তার বিস্তারিত হিসাব কষেই ঋণ দেয়া হয়। গাড়ি বা বাড়ির ক্ষেত্রে ঋণ খেলাপি হলে ব্যাংক তা বাজেয়াপ্ত করে নেয়। একসময় বাহুবলী পাঠিয়ে গাড়ি তুলে নিয়ে যাওয়া হতো। হইচই হওয়ার পর তা অনেকটা কমেছে। ঋণ দেয়ার সময় এই সতর্কতা ও টাকা ফেরত না পেলে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো অন্যায় নেই। বরং তা না করলে ব্যাংকই ডুববে। তারা যে টাকাটা ঋণ হিসাবে দিয়েছে সেটাও ডুববে। ডুবেছেও। ভারতে বেশ কিছু সরকারি ব্যাংকের এমন অবস্থা হয়েছিল যে একাধিক ব্যাংককে একসঙ্গে মিশিয়ে একটা ব্যাংক করা হয়েছে। ২০২৩ সালেই দশটি ব্যাংককে মিশিয়ে চারটি ব্যাংক করা হয়েছে। এই মেশানোর ক্ষেত্রে এনপিএ একটা কারণ, এছাড়াও আরো অনেক কারণ আছে।
সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলি যতটা উদ্যোগী, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের ক্ষেত্রে সেই উদ্যোগের কিছুই দেখা যায় না। থাকলে, আজ এই অবস্থা হতো না। এমনকী কোন কোন কোম্পানি বা ব্যক্তি বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েও দেননি, তার পুরো তালিকা সরকার বা ব্যাংক প্রকাশ করেনি। বারবার দাবি সত্ত্বেও সেই তালিকা অধরা থেকে গেছে। যেমন সুইস ব্যাংকের অ্য়াকাউন্টে কার কত অর্থ আছে, সেই তালিকাও সরকার দেয় না। আর ব্যাংকের নিয়মকানুনের মধ্যে কত যে ফাঁক আছে, তা একসময় হর্যদ মেহতা ও তেলগি ব্যাপক জালিয়াতি করে দেখিয়ে দিয়ে গেছে। আর উপমহাদেশের অরণ্য়ের প্রাচীন প্রবাদ বলে, আইন থাকলে তার ফাঁকফোকড় আছে। সেগুলিকে গহ্বরও বলা যেতে পারে। হাতিও গলে যায় এমন ফাঁক।
এই বছরই রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী ভাগবত কারাড লিখিতভাবে কিছু নাম জানিয়েছেন। মোট ৮৭ হাজার ২৯৫ কোটি টাকার ঋণখেলাপিদের তালিকা দেয়া হয়েছে। সেই তালিকায় এক নম্বরে আছে মেহুল চোকসির গীতাঞ্জলি জেমস লিমিটেড। তারা আট হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করেনি। মেহুল চোকসি অবশ্য ভারত থেকে পালিয়েছেন। তিনি অ্য়ান্টিগুয়া ও বার্বুডাতে আছেন। এছাড়া আরইআই অ্যাগ্রো লিমিটেড পাঁচ হাজার ১৪৮ কোটি টাকার ঋণের টাকা ফেরত দেয়নি। এরকমভাবেই ৫০টি সংস্থা ৮৭ হাজার কোটির বেশি টাকা ঋণ নেয়ার পর আর ব্যাংককে ফেরত দেয়নি। ওই পাঁচ দশমিক চার ট্রিলিয়ানের বাকি টাকা কাদের কাছে আছে তা জানা নেই।
এই সব সংখ্য়াতত্ত্ব তার নিজের জায়গায় আছে, প্রশ্ন হলো, কেন এই অবস্থা হলো? এব্যাপারে একটা চালু প্রায় প্রবাদ হয়ে যাওয়া কথা আছে। সেটা হলো, যদি আপনি ব্যাংকের কাছ থেকে একশ ডলার পান, তাহলে সেটা আপনার সমস্যা। আর যদি ব্য়াংক আপনার কাছ থেকে একশ কোটি ডলার পায়, তাহলে সেটা ব্যাংকের সমস্যা। ভারতে সরকারি ব্যাংকগুলির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ছোট ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে টাকা আদায় করার ক্ষেত্রে যতটা তৎপর, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের ক্ষেত্রে তাদের সেই তৎপরতা দেখা যায় না। সেই সমস্যার সমাধান তারা করে না। কেন? ধোঁয়া থাকলে তো আগুন থাকবেই, একটা কিছু যদি ঘটে, তাহলে তার কারণও থাকবে। এই কারণ খুঁজতে গেলেই কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে পড়ে।
আর তখন প্রবেশ ঘটে রাজনীতি ও দুর্নীতির। যেখানে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ নয়-ছয়ের কাহিনি আছে, সেখানে এই দুয়ের প্রবেশও অবশ্যম্ভাবী। একটা কাল্পনিক পরিস্থিতির কথা ধরা যাক। কোনো প্রভাবশালী মন্ত্রীর বা নেতার কাছ থেকে ব্যাংক কর্তার কাছে ফোন এলো। কোনো ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিকে যেন ঋণ দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করা হয়। বলা হলো, বিষয়টা একটু দেখে নেবেন। এবার সেই ব্য়াংক কর্তা কী করবেন? মন্ত্রীর কাছ থেকে আসা মৌখিক নির্দেশই মানবেন। তাতে সবপক্ষেরই লাভ। ব্যাংককর্তা, রাজনীতিক, শিল্পপতির। এরপর যদি সেই শিল্পপতি ঋণখেলাপি হন, তখন কার দায়? এককথায় কারও নয়। ভারতে সরকারি কর্মীদের কখনোই তাদের কাজের জন্য দায়ী করা হয় না। মন্ত্রীর কাছ থেকে তার অফিস থেকে মৌখিক অনুরোধ(নির্দেশ) এসেছিল। তা তো প্রমাণ করা যাবে না। শিল্পপতিকে গ্রেপ্তার করা যেতে পারে। করা হয়েওছে কিছু ক্ষেত্রে। তবে সেই সংখ্যা খুবই কম।
ফলে এনপিএ বেড়ে যায়। যেতেই থাকে। সরকার বা ব্যাংক একসময় তাকে তামাদি বলে ঘোষণা করে দেয়। কিছু ক্ষেত্রে চাপ দিয়ে আংশিক অর্থ উদ্ধার হয়।
সরকার জানাচ্ছে, গত কয়েক বছরে এনপিএ-র পরিমাণ প্রচুর কমেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে এই অভিযোগও আছে, নতুন এনপিএ যুক্ত হচ্ছে। সেই ছেলেবেলা থেকে আমি কিছুতেই চৌবাচ্চায় জল ভরার অংক মেলাতে পারিনি। এই সব সংখ্য়াতত্ত্বও মেলাতে পারি না। খালি রাজনীতি, দুর্নীতি, এনপিএ-র অঙ্কটা কেমন করে জানি মিলে যায়।