ধর্ষণের মামলা, প্রভাবশালীদের চাপ
১১ মে ২০১৭বাংলাদেশে এই সময়ে সবচেয়ে আলেচিত ঢাকায় দুই তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনা৷ গত ৪ মে মামলা হলেও এখনো ৫ আসামির কেউ ধরা পড়েনি৷ মামলাটির মধ্যে বাংলাদেশের ধর্ষণ মামলা, তদন্ত এবং বিচার প্রক্রিয়ার সব দুর্বলতা স্পষ্ট৷
ঢাকার বনানীতে একটি হেটেলে ২৮শে মার্চ জন্মদিনের দাওয়াত দিয়ে দুই তরুণীকে হোটেল রুমে ১৩ ঘণ্টা আটকে রেখে অস্ত্রের মুখে ধর্ষণ করা হয়৷ তারা ধর্ষণের ঘটনা ভিডিও করে৷ এরপর তাদের প্রাণনাশের হুমকি এবং ভিডিও প্রকাশের হুমকি দিয়ে মামলা থেকে বিরত রাখা হয়৷ শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে তারা ৪ মে বনানী থানায় মামলা করতে যান৷ সেখানকার পুলিশ তাদের দুই দিন ঘুরিয়ে অবশেষে ৬ মে মামলা নেয়৷
মামলার পর তরুণীদের ফরেনসিক পরীক্ষা হয়েছে ঢাকা মেডিক্যালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সাপোর্ট সেন্টারে৷ কিন্তু মেডিক্যাল টেস্টে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যাবে কিনা, এ বিষয়ে নিশ্চিত নন চিকিৎসকরা৷ ১৫ দিন পর ফলাফল জানা যাবে৷
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের অধ্যাপক ডা. সেলিম রেজা চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘ধর্ষণের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ফরেনসিক পরীক্ষা হলে ভালো৷ এই সময়ের মধ্যে ধর্ষণের শারীরিক প্রমাণ পাওয়া সহজ৷ দেরি হলে প্রমাণ বিলীন হয়ে যায়৷ কিন্তু আমাদের দেশে ভিকটিমদের পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয় ১০-১২ দিন পর৷ ফলে এখানেই ধর্ষকের ছাড়া পাওয়ার সুবিধা তৈরি হয়ে যায়৷’’
তিনি বলেন, ‘‘সাধারণত ধর্ষণের পর প্রভাশালীরা সালিশসহ নানা বাহানায় সময় পার করে৷ তারপর থানায় গেলে থানা নানাভাবে মামলা নিতে দেরি করে৷ ফলে ধর্ষণ প্রমাণ কঠিন হয়ে পড়ে৷’’
কুমিল্লার তনু, দিনাজপুরের পূজার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে৷ তনুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে৷ তনু ধর্ষণ এবং হত্যার ঘটনা ঘটেছে সেনানিবাসের মধ্যে৷ সেখানেও ধর্ষকরা ঢাকার ঘটনার মতো প্রভাবশালী৷
মানবাধিকার কর্মী এবং জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট দিলরুবা শারমিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রভাবশালীরা কয়েকভাবে ধর্ষণ মামলাকে দুর্বল করার চেষ্টা করে৷ তারা প্রথমে চেষ্টা করে মেডিক্যাল টেস্টকে দুর্বল করতে৷ বাদি এবং সাক্ষী উভয়কে চাপ ও হুমকি দিয়ে সমঝোতা করাতে এবং আলামত নষ্ট করতে৷ আর এই কাজে প্রভাবশালীরা রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থ এবং পুলিশকে কাজে লাগায়৷ বনানীর ধর্ষণের ঘটনায় যা স্পষ্ট হয়েছে৷’’
অ্যাডভোকেট দিলরুবা শারমিন আরো বলেন, ‘‘পুলিশ প্রভাবশালীদের হয়ে ধর্ষণের শিকার যারা হন, তাদের ‘চরিত্র হরণ’ করে৷ একই সঙ্গে মেডিক্যাল টেস্টের জন্য পাঠাতে দেরি করে, যাতে ঘটনা প্রমাণ করা না যায়৷’’
তিনি মনে করেন, ‘‘আদালতে ধর্ষণ মামলার বিচার প্রক্রিয়াও ত্রুটিপূর্ণ৷ ধর্ষণকে যেভাবে আদালতে প্রমাণ করতে হয়, সাক্ষ্য আইন মেনে তা অনেক জটিল এবং অবমাননাকর৷ ফলে অনেক ভিকটিম মামলা করলেও আর শেষ পর্যন্ত আদালতে যান না৷’’
আদালত সূত্র জানায়, সারাদেশে বিচারের জন্য ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের দেড় লক্ষাধিক মামলা ঝুলে আছে৷ এসব মামলার বিচার চলছে ঢিমেতালে৷ বছরে নিষ্পত্তি হচ্ছে মাত্র ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ মামলা৷ আর সাজা পাচ্ছে হাজারে সাড়ে মাত্র ৪ জন আসামি৷
২০০১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে চিকিৎসা সহায়তা নিতে আসেন ২২ হাজার ৩৮৬ জন নারী৷ তার মধ্যে মামলা হয় পাঁচ হাজার তিনটি ঘটনায়৷ এর মধ্যে ৮০২টি ঘটনায় রায় দেয়া হয়েছে৷ শাস্তি পেয়েছে ১০১ জন৷ রায় ঘোষণার হার ৩.৬৬ ভাগ৷ আর সাজার হার ০.৪৫ ভাগ৷
পুলিশি তদন্তে ত্রুটি এবং অবেহেলার কারণেই প্রধানত এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷ আছে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির নেতিবাচক দিক আর আছে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা৷
আইনজীবী দিলরুবা শারমিন জানান, ‘‘নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ট্রাইব্যুনালে ৬ মাসের মধ্যে এসব মামলার বিচার শেষ করার বিধান আছে৷ কিন্তু নানা অজুহাতে তা শেষ হয় না৷ তাই আমি মনে করি, এসব মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যালে নিলে দ্রুত বিচার পাওয়া যাবে৷’’
প্রিয় পাঠক, এই বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন নীচে মন্তব্যের ঘরে...