প্রতিবাদ না করলে মেনে নিতে হয়
২৮ আগস্ট ২০২০সাকিব আল হাসানের মেয়ের ঘটনা এবং তা ঘিরে তাঁর স্ত্রীর মন্তব্য, কয়েক মাস আগে ফিরিয়ে নিয়ে গেল।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাস। গোটা ভারত তখন উত্তাল সিএএ, এনআরসি নিয়ে। তারই মধ্যে ভারতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক এবং বিসিসিআইয়ের প্রধান সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে একটি খবর ইনস্টাগ্রামে শেয়ার করেন। সানা গঙ্গোপাধ্যায় এখন কলেজের ছাত্রী। খুব ছোট নন। তাঁর বয়সী অনেকেই সিএএ, এনআরসি বিরোধী আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছেন। জেলে গিয়েছেন। সানা যে স্টোরি শেয়ার করেছিলেন, তেমন অনেক খবরই দেশের অসংখ্যা ছাত্রছাত্রী প্রতিদিন শেয়ার করছেন। কিন্তু সানা কেবল একজন ছাত্রী নন। তিনি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে। ফলে মুহূর্তের মধ্যে তাঁর পোস্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। স্টোরি শেয়ার করার সময় সানা লিখেছিলেন, ‘ফ্যাসিস্ট মনোভাব একটি দেশের ভিতর বিভাজন আরও বৃদ্ধি করে, জুড়তে সাহায্য করে না।’
সানার পোস্ট ভাইরাল হতেই পক্ষে এবং বিপক্ষে মন্তব্য আসতে শুরু করে। বিপক্ষ সুর এতটাই চড়া ছিল যে এক সময় সেই বিতর্কে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হন সৌরভ স্বয়ং। তিনি লেখেন, সানা এখনও ছোট। রাজনীতি বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট জ্ঞান নেই। যা নিয়ে সকলে মন্তব্য করছেন, তা ভিত্তিহীন। বোঝাই যায়, এক সময় লর্ডসের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে যে দাদা জামা খুলে আকাশে উড়িয়েছিলেন, নিজের মেয়ের ক্ষেত্রে তাঁকেই ব্যাকফুটে গিয়ে চরম রক্ষণাত্মক শট খেলতে হলো।
সাকিব আল হাসানের স্ত্রী যা করেছেন, যে মন্তব্য করেছেন, ক্রিকেটের ভাষায় তাও এক ধরনের ডাক। মাথা নীচু করে বাউন্সার থেকে বাঁচা। বাউন্সারটা কী? সোশ্যাল মিডিয়ায় সূর্যমুখী ফুলের মধ্যে তাঁর মেয়ের একটি ছবি। আর তা ঘিরেই নানা রকম মন্তব্য করতে শুরু করেন নেটিজেনরা (ইন্টারনেট ব্যবহারকারী)। বলাই বাহুল্য, তার মধ্যে এমন কিছু মন্তব্য ছিল, যা কোনও সুস্থ, ভদ্র সভ্যতায় বাঞ্ছনীয় নয়। পরিস্থিতি এমন এক জায়গায় গিয়ে পৌঁছল, সকলে মিলে এমন সব কথা বলতে শুরু করলেন যে, বাধ্য হয়ে পোস্ট ডিলিট করে সাকিবের স্ত্রী জানিয়ে দিলেন, এ নিয়ে আর কোনও কথা হোক, তিনি চান না। যাঁরা এর প্রতিবাদ করছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও কার্যত সোচ্চার হলেন তিনি।
কয়েক মাস আগে সৌরভ যা করেছিলেন, সাকিবের স্ত্রীও ঠিক সে কাজটাই করেছেন। প্রতিবাদীদেরও চুপ করার আর্জি জানিয়ে বিষয়টিকে মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছেন। স্বভাবতই যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় সৌরভের মেয়ে কিংবা সাকিবের স্ত্রীর জন্য লড়াই করছিলেন, তাঁরা হতাশ হয়েছেন। শুধু তাই নয়, কেউ ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। দুই দিক থেকেই বিষয়টিকে দেখা যায় আসলে। সৌরভ বা সাকিব জানেন, তাঁদের খ্যাতি যেমন আনন্দের কারণ, ঠিক ততটাই বিড়ম্বনারও। সানাকে ট্রোল করা আসলে এক দিক থেকে সৌরভকেই ট্রোল করা। যাঁরা ট্রোল করেছিলেন, তাঁরা বার বার সানার পোস্টে সৌরভকে টেনে এনেছেন। সৌরভের সঙ্গে জয় শাহের সম্পর্কের কথা টেনে এনেছেন। জয় শাহ অমিত শাহের ছেলে। সৌরভের বিসিসিআইয়ে জয় শাহ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী। অমিত শাহ সিএএ-র কারিগর। এই সব বিষয়গুলিই একটি পোস্ট ঘিরে সামনে চলে এসেছে। সৌরভ জানতেন, বিতর্কটিতে স্টেপ আউট করলে সমস্যা আরও বাড়বে, কমবে না। সাকিবের স্ত্রীও জানতেন একই কথা। প্রতিবাদ জারি থাকলে আরও খারাপ কথা সামনে চলে আসবে। কোনও বাড়ির মেয়ে ধর্ষিত হওয়ার পর ঠিক এই কথাটাই ভাবেন পরিবারের সকলে। বিষয়টি নিয়ে সমাজে প্রতিবাদ করতে হলে বার বার ধর্ষিত হতে হবে মেয়েকে। সকলের সামনে বার বার সেই ধর্ষণের কাহিনি শোনাতে হবে। সমাজের একাংশ প্রশ্ন তুলবে মেয়ের চরিত্র নিয়ে। ফলে বিষয়টি চেপে গেলে কিছুদিন হৃদয়বেদনা হবে। তারপর ধীরে ধীরে অতীত বিস্মৃত হবে মেয়ে, পরিবার।
তা হলে কি প্রতিবাদ হবে না? যেমন চলছে তেমনই চলবে সব? ট্রোল যাঁরা করেন, তাঁরা মনে করেন এটা তাঁদের অধিকার। প্রতিবাদ না হলে তাঁরা সেই অধিকারের স্বীকৃতি পেয়ে যাবেন। ইতিমধ্যে স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন। সে কারণেই ট্রোল বাহিনী তৈরি করছে রাজনৈতিক দলগুলি। আইটি সেলের নামে বেতনভুক সেই কর্মীরা সোশ্যাল মিডিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। গালাগাল, অসাংবিধানিক শব্দে জেরবার করে ছাড়ছে তথাকথিত ভদ্র সমাজকে। কোথাও ধর্মের জিগির ওঠে। কোথাও জাতের। কোথাও লিঙ্গের। কোথাও রাজনীতির। এক একটা সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট, অথবা তার কমেন্ট ভারতে, খাস ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারী পশ্চিমবঙ্গে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। দাঙ্গা হয়েছে। মানুষের প্রাণ গিয়েছে। বড় বড় লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক প্রতিদিন অপমানিত হচ্ছেন এই ট্রোলবাহিনীর ভার্চুয়াল গুন্ডাগিরিতে।
প্রতিবাদ করতেই হয়। চুপ করে বসে থাকা আসলে অন্যায়কে মেনে নেওয়া। ছোটবেলা থেকে এ সব আপ্তবাক্য অনেক শুনেছি আমরা। কিন্তু কাজের বেলায় সবাই ভয় পাই। ভয় পেতেও সমাজই শিখিয়েছে। কারণ আমরা জানি, প্রতিবাদ করলে লড়াই করতে হয় অনেক দূর পর্যন্ত। সেই প্রস্তুতি মানসিক ভাবে থাকে না অনেকরই। আর যাঁদের থাকে?
কিছুদিন আগে #বয়েজক্লোকরুম নামে এক ভয়াবহ সত্য সামনে এসেছিল ভারতে। স্কুলের ছাত্ররা সহপাঠী ছাত্রীদের সম্পর্কে কী ধরনের মন্তব্য করে সোশ্যাল মিডিয়ায়। নিজেদের ছোট ছোট ভার্চুয়াল গ্রুপে। পাশে বসা বান্ধবীকে রেপ করে দেওয়ার ছক কষা হয়েছে সে সব আলোচনায়। বিষয়টি জানাজানি হতেই গোটা দেশ জুড়ে নীতি পুলিশি শুরু হয়। সকলেই সোশ্যাল নেটওয়ার্কে এর প্রতিবাদ করতে শুরু করেন। মাঝে মাঝে মনে হয়, সকলেই এত নীতিবাগীশ হলে এ সব ঘটনা ঘটে কী করে? বয়েজক্লোকরুমের অধ্যায়েই একাধিক কাহিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করতে শুরু করেন অনেকে। একেবারে নাম দিয়ে। তেমনই এক স্কুল ছাত্র নিজের নামে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে পোস্ট দেখে, আর সামলাতে পারেনি। আত্মহত্যা করে। গোটা সোশ্যাল মিডিয়া তখন ওই ছেলেটির বিরুদ্ধে যা খুশি তাই বলে গিয়েছে। বেশ কিছুদিন পর জানা যায়, আত্মহননকারী ছেলেটির কোনও দোষ ছিল না। তাকে ফাঁসাতে ওই পোস্ট করা হয়েছিল।
বড় অদ্ভুত জায়গা এই সোশ্যাল মিডিয়া। গোটাটাই ভার্চুয়াল। অথচ সেটাই এখন নিয়ন্ত্রণ করছে সমাজ। সমাজের আয়নার মতো। যে সমাজ সভ্য নয়, সে সমাজের সোশ্যাল মিডিয়াও সভ্য নয়। আয়না চেহারাটা আরও স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয়। সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের সমাজের চেহারাটা আরও স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিচ্ছে প্রতিদিন। এর প্রতিবাদ দরকার। করতেই হবে। পালিয়ে গেলে আগামীকাল সুরক্ষিত থাকে না। সৌরভ, সাকিবের মেয়েদের আগামী কাল সুরক্ষিত করার জন্যই আজ প্রতিবাদ হওয়া জরুরি।