এই এক নূতন
২৮ আগস্ট ২০২০মানুষের সমস্যা দুটি: আমার বোর লাগছে, এক্ষুনি উত্তেজিত হতে হবে, কী করব৷ এবং (যেহেতু মানুষ মূলগত ভাবে ধর্ষকামী): আমার কাউকে মারতে ইচ্ছে করছে, হিংস্র ভাবে কাউকে তছনছাতে ইচ্ছে করছে, কী করব৷ অন্য সব প্রাণীর সঙ্গে মানুষের তফাত এইগুলিই, মানুষের সময় কাটে না৷ আর, মানুষ মোটিভ ছাড়াই ঝাঁপিয়ে পড়ে ও কামড়ায়৷ সোশ্যাল মিডিয়া দুটোরই সমাধান মানুষকে দিয়েছে, অনন্ত বিনোদন, অশেষ প্রহার-মওকা, সঙ্গে কিছু দুরন্ত ফাউ৷ এমনিতে বহুদিন ধরে মানুষ একঘেয়েমির ওষুধ আবিষ্কার করে চলেছে, বানিয়েছে কত না খেলা, ক্রিকেট, ফুটবল, কিন্তু তার প্রিয়তম খেলা হল অন্য মানুষকে নিরাপদে পেটানো৷ নিরাপদে, মানে আড়াল থেকে, ফিরতি মারের সম্ভাবনাহীন অঞ্চলে, সংখ্যাধিক্যের আরামে ও সুরক্ষায় বুঁদ হয়ে৷ আগে রাস্তায় রাস্তায় প্রায়ই গণধোলাই হত, চোর পকেটমার মলেস্টার ধরে, সবাই মহা আগ্রহে একলা মানুষকে ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে ঠ্যাঙাত, মজা কখনও খুন অবধিও গড়াত৷ এখন তা কমে এসেছে৷ হয়তো সিরিয়াল বাড়ছে বলে (অবসর কাটানোর উপকরণ আছে), বা সিসিটিভি বাড়ছে বলে (ধরা পড়ার ভয় আছে)৷ কিন্তু মূলত, সোশ্যাল মিডিয়া বাড়ছে বলে৷ সেখানে ভার্চুয়াল গণধোলাই লেগেই আছে৷ হ্যাঁ, তাতে প্রত্যক্ষ প্রহারের তৃপ্তি অনেকাংশে অনুপস্থিত, কিন্তু এই প্রক্সি বহু বাড়তি আরাম দেয়: বার বার ছোবলানো, দর্শক ও সহ-প্রহারকারীদের সুস্পষ্ট বাহবা কুড়োনো, অন্য অনেকের মারার ক্রিয়া বহুক্ষণ ধরে চাখা, সর্বোপরি ভিকটিম-টির প্রলম্বিত বেদনা তারিয়ে তারিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে উপভোগ করার বাড়তি ফুর্তি এখানে ঝলমলাচ্ছে৷ চোরকে টর্চার মিনিট চল্লিশে শেষ হয়ে যেত, পুলিশ এসে পড়ত৷ আর, শারীরিক ও সামাজিক কারণে, মেয়েরা এই গণধোলাইয়ে তেমন অংশ নিতে পারত না৷ সোশ্যাল মিডিয়া উদাত্ত আহ্বানে বলেছে, এখানে কোনও বৈষম্য নেই, সবাই মারো৷ কোনও সময়ের চাপ নেই, সকালে রাতে অবসর মতো নিগ্রহ করো ও যখন খুশি হাই তুলে কোটরে ফিরে যাও৷ চড় না মেরে অপমান করছ, বাটাম না মেরে খিস্তি, কিন্তু তা কম কই বরং বেশি আনন্দময়, এ এক পরিচ্ছন্ন প্রহার, ঘুসি মারলে মুষ্টিতে লাগে না, ছুরি ঢোকালে রক্ত ছিটকে শার্টে পড়ে না৷ আর, নিজের পরুষ পাটকেল, নিজের উদ্যত ও উদ্ধত সত্তা, ফ্রিজ শটে খচিত থাকে কালের প্রাচীরে, ফিরে ফিরে সে অলীক অ্যাকশন রিপ্লের কাছে যাওয়া যায়, ওম পোয়ানো যায়৷
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই মানুষের কষ দিয়ে গরল যে নিরন্তর গড়ায়, তার কারণ আছে৷ জিন-গত ভাবে সে হিংস্র, তাই আসতে-যেতে অন্যের টুঁটি নর্দমায় ঠুসে ধরতে চায়: পূর্ণ সত্যি নয়৷ মানুষের যথেষ্ট টাকা নেই৷ যথেষ্ট যৌনতা নেই৷ সমাজ ও প্রশাসনে তাকিয়ে সে দেখেছে তার প্রতি কারও যত্ন নেই, সু-পাহারা নেই৷ বিনোদন দিয়ে সে নিজেকে ভুলিয়ে রাখে ঠিকই, কিন্তু মোবাইলে ঘাড় নিচু করে সেঁধিয়ে যাওয়ার কালেও তার বুকের পিছনে ধড়াসধড়াস করে ইএমআই শোধের দায়, বাড়িতে অসুখ ঢুকে পড়লে নিঃস্ব হওয়ার আশঙ্কা, যখন-তখন চাকরি চলে যাওয়ার আতঙ্ক৷ আর, বহু বহু বছর কোনও আদর না পাওয়া ও আসছে বছরগুলোতেও এতটুকু আদরের সম্ভাবনা না থাকার কান্না৷ এত বয়ে চলতে তার পিঠ ন্যুব্জ হয়ে আসে৷ অতি কষ্টে নিজেকে নড়া ধরে নিয়ে যেতে হয় টুথব্রাশের দিকে, নিজেকে বোঝাতে হয়, ফিলিমস্টারের তৃতীয় বিয়ে নিয়েই চেগে উঠতে হবে৷ এই সময়ে তার ভেতরে নিজের ও অন্যের প্রতি যে ঘেন্না, পরিস্থিতি ও জীবনের প্রতি যে অপরিসীম রাগ, যাদের সুতোয় তার গোটা গা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা সেই ক্ষমতাবানদের প্রতি যে আক্রোশ, তা বলকাতে বলকাতে যদি চকিতে দেখতে পেয়ে যায় একটা সহজ শিকার, চান্স ছাড়া যায় কি? যদি খবর পাওয়া যায় এই মোড়ে ওই গলিতে একটা লোককে অনেকে মিলে মারছে, বা, এখনও মারছে না কিন্তু রক্তের লৌহগন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, একবার ঝাড় শুরু করে দিতে পারলে অচিরে অনেকে রইরই করে এসে জুটবে— তখন তার ভেতর থেকে তড়াক হড়কে আসে সেই লোকটা, যে আর্তনাদ আর লাথির একটা অন্ধকুয়োয় বাইক ছটকাচ্ছিল৷ বঞ্চনা আর অপ্রাপ্তির বিষ সে বমন করতে শুরু করে তোড়ে, সেটাকে শুধু একটা ঠোঙা পরিয়ে দেয় বর্তমন হেডলাইনের৷ ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ সিনেমায় নায়কের বেকারত্বের জ্বালা, সমাজ বদলাতে না-পারার হতাশা, বাড়ির অশান্তি মিলে তাকে লোফালুফি করতে করতে এরকম একটা গণধোলাইয়ের ভিড়ে ছুড়ে দিয়েছিল, সে অবশ্য থমকে যায় এক অপাপবিদ্ধ কিশোরীর (যার গাড়ির ড্রাইভারকে ধরে পেটানো হচ্ছে) মুখ দেখে৷ ফেসবুকে মুখ দেখা যায় না৷ তাই থমকাতে হয় না৷ যাকে মারছি তার আর্তনাদ সরাসরি শোনা যায় না, এদিকে তার দুর্দশা, ঠাস ঠাস টিটকিরির ঘায়ে তার কালশিটে পড়া মুখ, আধলা আধলা ইতরোমোর আঘাতে তার নিংড়ে যাওয়া চির-দাগ পড়া আত্মা বেশ আন্দাজ করা যায়৷ তাই হৃদয়ের ঝাল গেলে দেওয়ার এমন লীলাক্ষেত্র আর দুটি নেই৷
কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার অভিনবতম কেরদানি হল, ঘিরে ধরে পেটানোর নীচ কাজকে, মানুষের গায়ে পাঁক ছুড়তে ছুড়তে ফুর্তিতে তুড়ুক নৃত্যের নীচতাকে, সে প্রকাণ্ড মহিমার মোড়কে প্যাক করে দেয়৷ সবাই মিলে ঠোকরানোর নাম তখন হয় সমাজকল্যাণ, সবাই মিলে লাথি মারার নাম হয় বিপ্লব৷ বিখ্যাত লোককে যে লোক খুব ভাল অপমান করতে পারে এবং প্রায়ই করে, সে হয়ে যায় পজিটিভ কালাপাহাড়৷ অভদ্রতা, উগ্রতা, কাঁটাওলা বুট নিজেদের ডাকে: জরুরি কাস্তে৷ সবাই সঙ্গী-রক্তচোষাকে রাজা উজির বাদশা পরমাত্মা বাতলে নেয়৷ আগে রাস্তায় চোরকে নিকেশ করে হেঁটে ফেরার সময়ে লোকে বলাবলি করত, পাড়াকে পাহারা দেওয়ার পবিত্র কাজই তারা করেছে, কিন্তু ভেতরে খচখচ করত, মিনিট সাতেক হলেও৷ এখন এই অ্যাকশন থেকে অপরাধবোধ পূর্ণ অন্তর্হিত, কারণ সোশ্যাল মিডিয়া সব্বাইকে দিয়েছে পূত ধ্বজাধারীর স্টেটাস৷ তোমার পতাকা যারে দাও তারে দাও তারে শকতি-টকতি না দিলেও চলবে, দাও শুধু একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট৷ আজ প্রতিটি নাগরিক মনে করে, তার মহান দায়িত্ব পৃথিবীর সমস্ত, সমস্ত, সমস্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞের মত প্রদান ও সেই মন্তব্যের ডগায় আচ্ছাসে বিছুটি মাখিয়ে দেওয়া৷
আর সোশ্যাল মিডিয়ার তামসিক তুরুপ: হরিদাস পালকে রবীন্দ্রনাথের সমান সম্মান প্রদান৷ চূড়ান্ত সাম্যের এই পুণ্যভূমিতে কেউ কারও চেয়ে বড় নয়৷ সোশ্যাল মিডিয়া বলেছে, কিসের যোগ্যতা? কে বললে, একটা বিষয়ে কথা বলার অধিকার বহু বুদ্ধি খাটিয়ে অনেক অনুশীলন ব্যেপে তবে অর্জন করতে হয়? তুমি একজন মানুষ, একজন ক্রেতা, এ-ই তোমার সর্বাধিক যোগ্যতা৷ তাই তুমি কাব্য নিয়েও ডেঁটে কথা বলবে, সিনেমা নিয়েও দাবড়ে চিল্লাবে, কে কী রকম পোশাক পরবে তা-ও টিক মেরে ঠিক করে দেবে, কে কী ভাবে ধর্ম পালন করবে তা-ও থাবড়ে বুঝিয়ে দেবে৷ তুমি কম কিসে? এই তো তোমার ভাঁড়ারে ৩৭৬টা লাইক৷ ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপের আগেও কি এ জিনিস ছিল না? আগেও কি সাধারণ মানুষ মনে করত না, এ-হাতে তপন সিংহ ও-হাতে জ্যোতি বসু নিয়ে সে জাগল করতে করতে পেরিয়ে যেতে পারে তেপান্তর? ছিল, কিন্তু তার সেই নির্বুদ্ধিতাকে প্রশস্ত রাজপথে প্যারেড করানোর রেলা তাকে কেউ রিবন বেঁধে উপহার দেয়নি, তার কমেন্ট নিতান্ত ক্লাবের ক্যারম বোর্ডের ঝুলন্ত আলোর তলায় চার বার টাংকি খেয়ে পকেটে তলিয়ে অক্কা পেত৷ এই আজ এল তার স্বাধীন প্রান্তরে খুর ঠুকে দৌড় করার সময়, এই এল গণতন্ত্রের পার্মানেন্ট ভোর, এতদিনে জয় হল নিশ্চয়৷ বুদ্ধিহীন বিদ্যাহীন সংস্কৃতিহীন মক্কেল মুক্তি পেল হীনম্মন্যতা থেকে, এবার চর্চাহীন দীক্ষাহীন ধ্যানহীন বেয়াদব অনায়াসে শিক্ষিত চিন্তাশীল নীতিবান নম্র মানুষের কাঁধে হাত রেখে কথা বলবে এবং প্রায়ই সে হাত ফসকে উসকে যাবে গাঁট্টা রদ্দা উড়নচাঁটির মহামুদ্রায়৷
এর নেশা অবিশ্বাস্য৷ আয়নাকে যতবার জিজ্ঞেস করো ‘কে সেরা প্রফেট?’, আয়না সাষ্টাঙ্গে বলে ‘আপনি স্যর'৷ যে আমাকে কেউ পুঁছত না, যে আমি আলুপটল কেনা ছাড়া ক্ষণমাত্র ব্রেন নাড়াইনি, আজ আমিই সিনেমা ক্রিটিক, আমি গম্ভীর থুতনি নেড়ে ফতোয়াদাতা৷ ছাড়ব কেন? অবসর পেলেই মারব৷ মারার জন্য খলবল করতে করতে অবসর জুটিয়ে নেব৷ ইঁদুর সারাক্ষণ কিছু না কিছু কুরে খায়৷ নইলে তার দাঁত অনবরত বেড়ে যায়৷ বেশি বেড়ে গেলে সেই দাঁত নিজেকেই ফুঁড়ে দেয়৷ জনগণকে, অন্তত বাঙালি জনতাকে, নিজ আল্ট্রা-তিক্ততা সামাল দিতে, কিছু না কিছু কুরে খুঁড়ে ছিঁড়ে চলতে হয়৷ নইলে মজা ঘটে না৷ সন্ধে হয়ে গেল, কেউ চা দিল না, এই আঁধার মুডে সত্তা ম্যাজম্যাজ করতে থাকে৷ তাই নিরন্তর খুবলে যাওয়ার শখ-পার্লার এই সোশ্যাল মিডিয়াই হল সভ্যতার শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ৷ অলস আলুভাজা খেতে খেতে বারোয়ারি সমাজ-গার্জেনির এই ন চরিতার্থতায়, পিতঃ, বাঙালি পাবলিককে করো তেড়ে জাগরিত, শেষপাতে খেতে হোক ভয়াবহ তিতো৷