সুফিবাদ যখন হুমকি
৩ নভেম্বর ২০১২সুফিবাদ৷ ধর্ম, অথচ ধর্ম নয়৷ এ এক জীবনবোধ, মানুষে-মানুষে সংযোগ৷ তত্ত্বের তির্যক বাকযুদ্ধকে পিছনে ফেলে মর্মের গভীরে অনুপ্রবেশ৷ হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান - সব ধর্মের মানুষ এখানে একই সূত্রে বাঁধা৷ এক স্বরে ঈশ্বরের নৈকট্যকামী৷
আর সেখানেই সমস্যা৷ তালেবানের মতে, গান শোনা ইসলামে হারাম৷ হাদিসে আছে, একবার নবী মুহাম্মদ (সা.) তাঁর সাহাবীদের নিয়ে কোনো এক জায়গায় যাচ্ছিলেন, সেখানে ঢোল বাজানো হচ্ছিল৷ নবী নাকি তখন তাঁর কানে হাত দেন এবং সাহাবীদেরও সেটা করতে বলেন৷
তাই পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী এলাকায় তালেবান জঙ্গিদের যেন সাধারণ প্রবণতা দাঁড়িয়েছে সুফি, ভিন্ন সম্প্রদায় এবং সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালানো৷ ঠিক যেমনটা ঘটে গেল গত রবিবার৷ নওশেরার বিখ্যাত ষোড়শ খ্রিষ্টাব্দের 'কাকা সাহিব' মাজারে তালেবান হামলায় নিহত হলেন তিনজন সুফি সাধক, আহত আরো প্রায় ২৫ জন৷ জানান স্থানীয় পুলিশ প্রধান মুহাম্মেদ হুসেইন৷
এমনটা আগেও হয়েছে৷ তালেবান জঙ্গিরা, যাদের বেশিরভাগই সৌদি-ওয়াহাবি ইসলামে বিশ্বাসী, তারা বহুবার পাকিস্তানের বেশ কিছু সুফি সমাধিস্থলে হামলা চালিয়েছে৷ হত্যা করেছে সংখ্যালঘু শিয়া অথবা সুন্নি বারেলভি জাতির সাধকদের৷ এমন এক হামলাতেই ২০১০ সালে লাহোরের ডাটা দরবার মাজারে প্রাণ হারান ৩০ জন সাধক৷
পাকিস্তানের ইতিহাসবিদ ড. মুবারক আলি অবশ্য মনে করেন, মাজারে আক্রমণ করার এ ধরণের ঘটনার কোনো ধর্মীয় কারণ থাকতে পারে না৷ তাঁর কথায়, ''যারা এ ধরণের ঘটনা ঘটায় তাদের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই৷ যারা আধ্যাত্মিকতার বিরোধিতা করে, তারা বধির৷ আজকে আমরা নিজেদের মুসলমান দাবি করে গর্ব করি৷ অথচ এই সুফি সাধকেরাই কিন্তু আমাদের মধ্যে ইসলাম ছড়িয়ে দিয়েছেন৷''
স্বাভাবিকভাবেই, মাজারগুলোতে এহেন সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় উদ্বিঘ্ন পাকিস্তান সরকার৷ তাছাড়া হামলার ভয়ে বহু সুফি মাজারে তো এখন শুধুমাত্র ভেতরেই সুফি সংগীত পরিবেশন করা হয়৷ করাচি শহরের অধিবাসী, মানবাধিকারকর্মী এবং আইনজীবী শওয়াব আশরাফ জানান, ''তালেবান গোষ্ঠী পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে বিনষ্ট করতে চায়৷ বিশেষ করে ওয়াহাবিরা৷ যে কোনো ধরণের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, সংগীতানুষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের পরিপন্থী৷''
অথচ হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে নিঃসৃত এক চিরায়ত আবেগের প্রকাশ ঘটে সুফিতত্ত্বের মাধ্যমে৷ এ তত্ত্ব বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষকে একত্র করে৷ সে কারণেই হয়ত এই তালেবান হামলা সত্ত্বেও পাকিস্তানের শিক্ষিত প্রজন্ম আজ সুফিবাদের দিকে ঝুঁকছে৷
পাকিস্তানের কিশোরী সাবার কথায়, ''আধ্যাত্মিক গানের মূল ব্যাপার হলো শান্তি, এখানে সন্ত্রাস বা চরমপন্থার কোনো সুযোগ নেই৷ তাই সুফিগান ধর্মীয়ভাবে আদৌ অনুমোদিত কিনা, এইসব বিবেচনা না করেই আমি এটাকে সমর্থন করি৷''
কথায় বলে, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই৷ এটাই কি সুফিতত্ত্বের মূল কথা? বাংলার বাউল আর সুফিবাদ - দুটোর মূলেই রয়েছে মানবতাবাদ, ঈশ্বরের প্রতি প্রেম আর ভালোবাসার কথা৷ আল্লাহকে আপন করার কথা৷ মানুষের মধ্যে ঈশ্বরকে খোঁজার, খুঁজে পাওয়ার কথা৷