পশ্চিমবঙ্গে প্রার্থী দিতে হিমশিম খাচ্ছে বিজেপি
২৫ মার্চ ২০১৯বিজেপি নেতারা বলছেন, তাঁদের মতো বড় এবং সর্বভারতীয় একটি দলের ক্ষেত্রে প্রার্থী বাছাই নিয়ে সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক৷ কিন্তু ঘটনা হলো, ভারতে আগামী লোকসভা ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার পর দু সপ্তাহ কেটে গেলেও ৪২টি আসনের সবকটিতে এখনও প্রার্থীই দিতে পারল না বিজেপি৷
দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পক্ষ থেকে ছয় দফায় প্রার্থী তালিকা ঘোষিত হয়েছে৷ তার পরেও পশ্চিমবঙ্গের ১৩টি আসনে প্রার্থীর নাম চূড়ান্ত হয়নি৷
যে কটিতে প্রার্থী ঘোষণা হয়ে গেছে, সেখানেও ব্যাপক ডামাডোল৷ শোনা যাচ্ছে, বিজেপি নেতৃত্ব নাকি প্রার্থী বাছাইয়ের আগে অন্তত ৬ দফায় সমীক্ষা করেছে৷ তার পরই ঘোষিত হয়েছে প্রার্থীদের নাম৷ কিন্তু বীরভূমের নেত্রীকে প্রার্থী করা হয়েছে হুগলিতে, পুরুলিয়ার নেতাকে দাঁড় করানো হয়েছে উত্তর ২৪ পরগণায়৷
বিজেপির রাজ্য মহিলা মোর্চার নেত্রী, অভিনেত্রী লকেট চ্যাটার্জি এতদিন মাটি কামড়ে পড়েছিলেন বীরভূমে৷ তাঁকে হুগলির প্রার্থী করা হয়েছে৷ সেই রাগে দলীয় পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন হুগলির বিজেপি নেতা রাজকমল পাঠক৷
ক্ষোভ রয়েছে বসিরহাট, বারাসাত, তমলুক নিয়ে৷ অনেক টালবাহানার পর আলিপুরদুয়ারের বিজেপির প্রার্থী হিসেবে অবশেষে যাঁর নাম ঘোষিত হয়েছে, সেই জন বারলার রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েই প্রশ্ন আছে৷
বসিরহাট দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের নির্বাচিত বিধায়ক ছিলেন বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্য৷ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় তিনিই ছিলেন বিজেপির একমাত্র নির্বাচিত প্রতিনিধি৷ সেই শমীক এবার দমদম লোকসভা কেন্দ্র থেকে দলের প্রার্থী৷ তাঁকে কেন বসিরহাট কেন্দ্রে প্রার্থী করা হলো না, সেই নিয়ে দলের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে৷ কারণ তৃণমূল কংগ্রেস এবার বসিরহাটে প্রার্থী করেছে জনপ্রিয় অভিনেত্রী নুসরতকে৷ মমতা ব্যানার্জির নিজস্ব জনসমর্থন এবং রাজনীতিতে নেহাত অনভিজ্ঞ হলেও নুসরতের গ্ল্যামারের বিরুদ্ধে হেভিওয়েট কোনো নেতাকে প্রার্থী করা হোক, নিদেনপক্ষে শমীককে, যাঁর বসিরহাট অঞ্চলে রাজনৈতিক পরিচিতি এবং প্রভাব রয়েছে, এটাই ছিল স্থানীয় বিজেপি কর্মীদের বক্তব্য৷ সেখানে বসিরহাটের বিজেপি প্রার্থী হয়েছেন রাজ্যে দলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু, যিনি এতদিন মূলত পুরুলিয়া অঞ্চলে সংগঠনের কাজে যুক্ত ছিলেন৷ নাম ঘোষণার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বসিরহাটে পোস্টার পড়েছে সায়ন্তনের বিরুদ্ধে!
শমীক ভট্টাচার্য নিজে কিন্তু মানতে চাইলেন না যে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিজেপির উচ্চতর নেতৃত্বের সঙ্গে দলের নীচু তলার কর্মীদের যোগাযোগের অভাব, বা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে বলে৷ তাঁর বক্তব্য, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা তৈরি করে রাজ্যের সুপারিশের ভিত্তিতে৷ রাজ্যের নেতারা যেসব নাম সুপারিশ করেন, সেগুলো কোনোটাই অগ্রাহ্য করা হয় না৷ সব সম্ভাব্য প্রার্থীকেই বিবেচনা করা হয়, তার পর একজনের নাম চূড়ান্ত হয়৷ শমীক ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘দেখুন, (পশ্চিমবঙ্গে) দল তো বাড়ছে, স্বাভাবিকভাবেই আমাদেরও রাজনৈতিক অবস্থানগত একটা বার্তা দেওয়ার প্রশ্ন আছে৷ যে তৃণমূল কংগ্রেস ভাঙছে, বা সিপিআইএম-এর যাঁরা কর্মী ছিলেন, বাম দৃষ্টিভঙ্গী যাঁদের মধ্যে ছিল, তাঁরাও বুঝতে পেরেছেন যে সমাজকল্যাণ মূলক রাষ্ট্রের ধারণায় যা করার কথা, বা যে ইস্যুগুলোর দিকে নজর দেওয়া দরকার ছিল, মৌলিক ইস্যু, সেগুলো বিজেপি করতে পারছে৷''
প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলিতে ভাঙন নিয়ে রাজনৈতিক অবস্থানগত বার্তা দেয়ার যে কথা শমীক ভট্টাচার্য বলতে চাইলেন, সেটা মূলত এবারের পাঁচ বিজেপি প্রার্থীর কথা মাথায় রেখে৷ পাঁচজনই অন্য দল থেকে এসে প্রার্থী হলেন এবার৷
সিপিএম ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া বিধায়ক খগেন মুর্মু টিকিট পেয়েছেন মালদা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রে, তৃণমূল ছেড়ে আসা বিধায়ক অর্জুন সিং বিজেপির প্রার্থী হচ্ছেন ব্যারাকপুরে, তৃণমূলের প্রভাবশালী নেতা ও বিদায়ী সাংসাদ সৌমিত্র খাঁ বিজেপির টিকিট পেয়েছেন বিষ্ণুপুরে এবং মেদিনীপুরের ঘাটালে গতবারের বিজয়ী তৃণমূল প্রার্থী, বাংলা ছবির জনপ্রিয় অভিনেতা দেব ওরফে দীপক অধিকারীর বিরুদ্ধে বিজেপির প্রার্থী হচ্ছেন জঙ্গলমহলের প্রাক্তন পুলিস সুপার, পদত্যাগী আইপিএস অফিসার ভারতী ঘোষ, যিনি একসময় খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির অতি ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বস্ত ছিলেন৷
দলত্যাগী তৃণমূল নেতা, একদা মমতার ডান হাত বলে পরিচিত মুকুল রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলার কারণে ভারতী ঘোষ রাজ্য প্রশাসনের বিষ নজরে পড়েন৷ কার্যত তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অসংখ্য বেনিয়মের অভিযোগের থেকে আড়াল খুঁজতেই ভারতী বিজেপিতে যোগ দেন এবং এখন সরাসরি ভোটপ্রার্থী৷ স্বাভাবিকভাবেই বিজেপি এই দলত্যাগীদের এখন সামনে তুলে ধরতে তৎপর৷ যেমন বোলপুরের বিদায়ী তৃণমূল সাংসদ, অধ্যাপক অনুপম হাজরা তিনি এবার যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থী৷
কিন্তু রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিজেপির এই কৌশল এবং বিরোধী শিবিরে বার্তা পৌঁছনো যদিও বা কুশলী চাল হয়, নিচুতলার কর্মীদের কিন্তু এই চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত ঠিক হজম হচ্ছে না৷ গোপনে এবং প্রকাশ্যে বিরোধিতা হচ্ছে, দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর, নেতাদের নিগ্রহের ঘটনাও ঘটছে৷ কোচবিহারে নিশীথ প্রামাণিককে প্রার্থী করায় যেমন পোস্টার পড়েছিল, দিনহাটার স্মাগলারকে একটিও ভোট নয়৷ হয় যোগ্যতর প্রার্থী, অথবা নোটায় ভোট দিন৷ শমীক ভট্টাচার্য যদিও দাবি করেছেন, শুরুতে কিছু সমস্যা হলেও অনেক জায়গাতেই দলীয় কর্মীদের বোঝানো সম্ভব হয়েছে৷ বিরোধ ভুলে ভোটের প্রচারে সামিলও হয়েছেন তাঁরা৷