পরিবর্তনের অযোধ্যায় বদলের ঢেউ
২০ জানুয়ারি ২০২৪হনুমানগড়ির সামনের রাস্তাটা দেখে চিনতে পারছিলাম না। এক বছর আগেও দেখেছি, সরু, ঘিঞ্জি রাস্তা। দোকানপাট এসে রাস্তার অনেকটা অংশ দখল করে রেখেছে। অপরিচ্ছন্ন। অল্প মানুষের ভিড়কেই তখন বিশাল জনসমুদ্র মনে হত। কিন্তু এখন সেই ছবি একেবারে বদলে গেছে। দুই দিকের দোকান ছেঁটে ফেলা হয়েছে। ফলে রাস্তা অনেকটা চওড়া হয়ে গেছে। দোকানগুলি একই লাইনে করে দেয়া হয়েছে। নতুন রং করা হয়েছে। সব দোকানের সাইনবোর্ড একই রকমের। তাতে বৈচিত্র নেই। তবে সমতা আছে। মাঝেমধ্যে তা হয়ত চোখের পক্ষে ক্লান্তিকর। তবে জয়পুর, দিল্লি, বারাণসী-সহ ভারতের অনেক শহরেই এই কাজ করা হচ্ছে।
শুধু এই হনুমানগড়ির রাস্তা নয়, প্রাচীন এই নগরীর অনেক রাস্তাই চওড়া করা হয়েছে। লখনউ এক্সপ্রেসওয়ে দেখেও তো চিনতে পারছিলাম না। ফৈজাবাদের আগে থেকে একের পর এক ফ্লাইওভার। হুহু করে গাড়ি চলে যাচ্ছে অযোধ্যায়।
দেখে তো চেনা যাচ্ছে না সেই ভূমিখণ্ডও। যা নিয়ে দীর্ঘ দীর্ঘদিন ধরে বিবাদ ছিল দুই পক্ষের মধ্যে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর যেখানে দাঁড়িয়ে থাকা বাবরি মসজিদ ভেঙে রামলালার অস্থায়ী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন করসেবকরা। তারপর সরযূ দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। শেষপর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের রায় এসেছে। একসময় বিতর্কিত ভূমিখণ্ডে রামমন্দির হবে। আর বাবরি মসজিদের জন্য আলাদা জমি দেয়া হবে। সেই জমি দেয়া হয়েছে রামমন্দির থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের ধন্যিপুরে। সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের সেখানে মসজিদ করার কথা। রামমন্দিরের উদ্বোধন যখন হচ্ছে, তখন ধন্যিপুরে শুধু প্রস্তাবিত মসজিদের বোর্ডটুকু রয়েছে।
এই পরিবর্তনের জোয়ারে সামিল হয়েছেন ইকবাল আনসারিও। তার বাবা প্রায় প়ঞ্চাশ বছর ধরে বাবরি মসজিদের হয়ে মামলা লড়েছেন। রামমন্দিরের ভিভিআইপি গেটের কাছে তার সাদা-সবুজ রংয়ের বাড়িতে বসে ইকবাল আনসারি ডিডাব্লিউকে যা বললেন, তার মর্মার্থ হলো, তারা আর অতীত নিয়ে থাকছেন না। সুপ্রিম কোর্টের রায় তারা আগেই মেনে নিয়েছেন। ফলে অযোধ্য়ায় রামমন্দিরও মেনে নিচ্ছেন। রামমন্দির ট্রাস্টের কর্তারা তাকে ২২ তারিখ আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে গেছেন। তিনি যাবেনও। তার কথায়, আমরা এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছি। আমরা আদের মতোই মিলেমিশে থাকতে চাই। আর শোক তো একদিনই স্থায়ী হয়।
বদলের নিদর্শন
এই বদলের শুরু অযোধ্যায় ঢোকার মুখেই। প্লেন, ট্রেন বা সড়কপথে যেভাবেই আপনি অযোধ্যায় আসুন না কেন, বদলটা টের পাবেন।
রামমন্দিরের ২০ কিলোমিটার দূরে ঝাঁচকচকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। তার দেওয়ালে একের পর এক ফ্রেসকো। রাম ও রামায়ণের বিভিন্ন ঘটনা উঠে এসেছে সেখানে। ছোট কিন্তু সুন্দর বিমানবন্দর। এখন সেই বিমানবন্দরে দিনে পাঁচটা করে বিমান নামছে। কিন্তু উদ্বোধনের দিন নামবে ১২৫টি ফ্লাইট। অধিকাশই চার্টার বিমান। রাজনীতিক, শিল্পপতি, বলিউড তারকা, নামকরা প্লেয়ার-এককথায় হুজ হু-রা সকলেই আসছেন। এত প্লেন রাখার জায়গা এই ছোট এয়ারপোর্টে নেই। সেই বিমানের ভিড় সামলানোটাও একটা চ্যালেঞ্জ।
নতুন স্টেশনে অবশ্য সারা দেশ থেকে প্রচুর ট্রেন নিয়মিত আসছে। তৈরি সড়কপথও।
আগামী দিনগুলিতে অযোধ্যায় মানুষের ঢল নামতে পারে। ইতিমধ্যেই অযোধ্যার রাস্তায় প্রচুর মানুষ। সরযূতীরে তো সন্ধ্যার পর থিক থিক করছে মানুষ। কারণ, সেখানে লেজার শো হচ্ছে। হচ্ছে নাচ-গান।
তাদের থাকার জন্য ইতিমধ্যেই অযোধ্যা ও তার আশপাশের এলাকাজুড়ে শতাধিক হোটেল, লজ, ধর্মশালা তৈরি হয়েছে। আরো অনেক হচ্ছে। পুরনোগুলির হাল ফেরানোর কাজ শেষ। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে শহরের সর্বত্র জ্বল জ্বল করছে অমিতাভ বচ্চনের মুখ-সহ একটি সেভেন স্টার হোটেল, রিসর্ট-আবাসনের বিজ্ঞাপন। সেখানে সুপারস্টারও বিনিয়োগ করেছেন বলে গুজব।
শিল্পেও বিনিয়োগ আসছে। সবচেয়ে ফুলেফেঁপে উঠেছে নির্মাণশিল্প। জমি-বাড়ির কেনাবেচা তুঙ্গে। কান পাতলে তাতে বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগও শোনা যাচ্ছে। তবে গোলমাল হলে পুলিশ আপাতত স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নীতি নিয়ে চলছে।
তবে মন্দিরের আশেপাশে য়ে সব জায়গা চওড়া করা হয়েছে, বাড়ি বা দোকান ভেঙে দেয়া হয়েছে, ছোট করে দোকান তৈরি করে দেয়া হয়েছে, সেখানে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। বাজারের দামের থেকে বেশি ক্ষতিপূরণ। তার বেশিরভাগটা পেয়েছেন জমি যার নামে আছে তারা। তবে দোকানদাররা বঞ্চিত হননি। কয়েকলক্ষ টাকা তারাও পেয়েছেন।
এককথায় এই মন্দির ঘিরে একটা কর্মকাণ্ডের জোয়ার এসেছে। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও আশায় বুক বাঁধছেন, চাকরির জন্য তাদের বাইরে যেতে হবে না। মহম্মদ কাইফ যেমন ওষুধের দোকান খুলতে চান। ডি ফার্মা কোর্সে গত বছর সুযোগ পাননি বলে বিএসসি নিয়ে পড়ছেন। আবার এই বছর পরীক্ষা দেবেন। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেছেন, তাদের চপ্পল তৈরির কারখানা আছে। তিনি ওষুধের দোকান দিতে চান। শহর বাড়ছে। ফলে ব্যবসার সম্বাবনাও বাড়ছে।
আরেক ছাত্রর দাবি, তাদের চাকরি করতে ভারতের বাইরে বা দেশের মধ্যে অন্যত্র যেতে হবে না। বরং পুরো ভারত আসবে অযোধ্যায়। এখানে আর যাই হোক চাকরির অভাব হবে না।
সত্যিই কি তাই? আজ থেকে দশ বা বিশ বছর পর পরিস্থিতিটা কী হবে তা বলা মুশকিল। তবে আশঙ্কার একটা চোরাস্রোত যে নেই তা নয়। স্থানীয় সাংবাদিক সুমন দেবীর মতে, যে রামমন্দির ঘিরে এই কর্মকাণ্ড, তা একটা রাজনৈতিক আন্দোলনের ফল। এই যে প্রচার, আলোড়ন, উত্তেজনা তা একটা সময় পরে থিতিয়ে যেতে পারে।
তুলনাটা চলে আসছে কাশীর সঙ্গে। এত বছর ধরে কাশীর যে ঐতিহ্য, যার টানে লাখ লাখ মানুষ প্রতিবছর বারাণসী যান, অযোধ্যাতেও কি তা হবে?
বজরং দলের সাবেক প্রধান প্রকাশ শর্মা ডিডাব্লিউকে বলেছেন, এই তুলনাটা চলে না। কাশী আছে তার জায়গায়। অযোধ্যা নিজের স্থানে। রামভক্তরা অযোধ্যায় আসছেন। ভবিষ্যতেও আসবেন।
তাদের কাছে টানার জন্য পরিকাঠামো অনেকটাই তৈরি হয়ে গেছে। বাকিটা আগামী দিনে হবে। পরিবর্তনের এই দৌড়ে অযোধ্যা কতটা এগোতে পারবে, তা ভবিষ্যতই বলবে।