নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গে শাসক ও বিরোধী
৩০ মার্চ ২০২৪ভারতের লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সাত দফায়৷ সব দল জোরকদমে প্রচারে নেমে পড়েছে৷ এরইমাঝে প্রচারে নেমে বেশ কয়েকজন প্রার্থী নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গে অভিযুক্ত হয়েছেন৷
ইউসুফের ছবি
ভোট ঘোষণার আগেই তৃণমূল কংগ্রেস তাদের ৪২ জন প্রার্থীর নাম জানিয়ে দিয়েছে৷ এই তালিকায় সবচেয়ে বড় চমক ছিল ভারতের জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেট তারকা ইউসুফ পাঠান৷ তিনি মুর্শিদাবাদের বহরমপুর কেন্দ্রে ঘাসফুলের প্রার্থী হয়েছেন৷ পাঠানের লড়াই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে৷
ইতিমধ্যে প্রচার শুরু করে দিয়েছেন ইউসুফ৷ তবে তার প্রচারে ব্যবহৃত একটি ছবি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়৷ ২০১১ সালে ভারতের বিশ্বকাপ জয়ী ক্রিকেট দলের সদস্য ছিলেন পাঠান৷ বিশ্বকাপ জয়ের পর ভারতীয়দের উচ্ছ্বাসের একটি ছবি ইউসুফের প্রচারে ব্যবহার করা হচ্ছিল৷ তাতে দেখা যাচ্ছে, পাঠানসহ অন্যান্য খেলোয়াড়দের কাঁধে চেপে রয়েছেন শচিন টেন্ডুলকার৷
এই ছবি নিয়ে প্রশ্ন তোলে জাতীয় কংগ্রেস৷ অভিযোগ ওঠে, রাজনীতির প্রচারে ক্রিকেটের আবেগকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন তৃণমূল প্রার্থী৷ অধীর চৌধুরীর পক্ষ থেকে দরবার করা হয় নির্বাচন কমিশনে৷ এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন নির্দেশ দিয়েছে, ওই ছবি ইউসুফ পাঠানের প্রচারে ব্যবহার করা যাবে না৷
অবশ্য পাঠানের বক্তব্য, ‘‘অনুরাগীরা কী ছবি ব্যবহার করছেন, সেটা আমি জানি না৷ আমি কোথাও পোস্টার লাগাইনি৷ কমিশনে যে কোনো অভিযোগ জমা পড়লে, আমাদের আইনি পরামর্শদাতারা বিষয়টি দেখবেন৷’’
দিলীপের ভাষা
বিজেপি সাবেক রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এবার বর্ধমান দুর্গাপুর কেন্দ্র থেকে ভোটে লড়ছেন৷ মেদিনীপুর কেন্দ্রের বিদায়ী সংসদের জেতা আসন এবার বদলে গিয়েছে৷ নতুন জায়গায় গিয়েও স্বমহিমায় দেখা যাচ্ছে প্রবীণ বিজেপি নেতাকে৷
অতীতে বারবার বেলাগাম বক্তব্যের জন্য সমালোচনার মুখে পড়েছেন দিলীপ৷ তারপর ক্ষমা চেয়ে রেহাই পেয়েছেন৷ এবার প্রচার শুরু করেই তিনি নিশানা করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে৷
তৃণমূল কংগ্রেস বিগত বছরগুলিতে পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়ার চেষ্টা করেছে৷ ত্রিপুরা থেকে গোয়ার বিধানসভা নির্বাচনে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে৷ এই বিষয়টিকে কটাক্ষ করতে গিয়ে তৃণমূল নেত্রীর সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করেন দিলীপ৷ তৃণমূল নেত্রীকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বসেন৷
সব দলের পক্ষ থেকে দিলীপের সমালোচনা করা হয়৷ নির্বাচন কমিশনের দরবার করে তৃণমূল৷ কমিশন শোকজ নোটিস পাঠায় দিলীপকে৷ তিনি মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন৷ এমনকি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও তাকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করেছে৷
কিছুটা একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের বিরুদ্ধে৷ তিনি বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী সম্পর্কে মন্তব্য করায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে বিজেপি৷
কাঠগড়ায় অভিজিৎ
সদ্য রাজনীতিতে পা রেখেছেন কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়৷ তিনি বিজেপিতে যোগ দিয়েই নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছেন৷ তাকে পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে পদ্ম শিবির৷
প্রচারে নেমে তৃণমূল নেত্রীর কড়া সমালোচনা করছেন তিনি৷ অভিজিতের ‘মৃত্যুঘন্টা' সম্পর্কিত মন্তব্য নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয়েছে৷ তৃণমূলের দাবি, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুকামনা করেছেন, যা অত্যন্ত রুচিহীনতার পরিচয়৷
যদিও বিজেপির বক্তব্য, সাবেক বিচারপতি তৃণমূল সরকারের প্রসঙ্গে ‘মৃত্যুঘন্টা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন৷ কোনোভাবেই তৃণমূল নেত্রী সম্পর্কে নয়৷ শাসক দল ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা প্রচার করছে৷
নিশানায় মোদী!
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ জানিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস৷ তার সঙ্গে নদিয়ার কৃষ্ণনগর কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী অমৃতা রায়ের ফোনালাপকে সামনে রেখে এই অভিযোগ তুলেছে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল৷
কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের বংশধর অমৃতাকে ফোন করেন মোদী৷ এই আলাপচারিতায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইডি পশ্চিমবঙ্গ থেকে তিন হাজার কোটি টাকার যে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে, তা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ফিরিয়ে দেয়া হবে৷ এ ব্যাপারে তিনি আইনি পরামর্শ নিচ্ছেন৷ নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে এ নিয়ে পদক্ষেপ করা হবে৷
এর পাশাপাশি সেই কথোপকথনে মোদী এবং অমৃতা উভয়ই সনাতন ধর্মের কথা বলেছেন৷ তৃণমূলের অভিযোগ, ধর্মের নামে ভোট চেয়ে সুবিধা নিতে চাইছে বিজেপি৷
কমিশনের হুঁশিয়ারি
প্রতি নির্বাচনের মতো এবারো কমিশন বিধিভঙ্গ রুখতে কড়া নির্দেশিকা জারি করেছে৷ আচরণবিধি লংঘন করলে প্রার্থীর প্রতীক বাতিলের মতো ব্যবস্থা নিতে পারে কমিশন৷ যদিও তাতে অভিযোগের স্রোত বন্ধ হয়নি৷
সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘রাজনীতিতে আদর্শ বলে যখন কিছু নেই, সেখানে আদর্শ আচরণবিধি মানা হবে, এটা আশা করা যায় না৷ প্রধানমন্ত্রী নিজেই এই বিধি অনুসরণ করেন না৷ তা হলে অন্য রাজনীতিকরা কী করবেন, বোঝা যায়৷’’
আচরণবিধি নিয়ে সাধারণ মানুষ যাতে অভিযোগ জানাতে পারেন, সেজন্য রয়েছে সি-ভিজিল অ্যাপ৷ এর মাধ্যমে পরিচয় গোপন রেখে যেকোনো নাগরিক কমিশনের কাছে অভিযোগ পৌঁছে দিতে পারেন৷
টাকা বা উপহার বিতরণ, মদ বিতরণ সংক্রান্ত অভিযোগ এই অ্যাপে জানানো যেতে পারে৷ অনুমতি ছাড়া সভা-সমাবেশ, বিদ্বেষমূলক প্রচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সুযোগ রয়েছে৷
মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমারের আশ্বাস, অভিযোগ পাওয়ার ১০০ মিনিটের মধ্যে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ ইতিমধ্যে জমা পড়া অভিযোগের অধিকাংশের নিষ্পত্তি করা হয়েছে বলে কমিশনের দাবি৷
ইন্ডিয়া টুডে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার পর্যন্ত সি-ভিজিল অ্যাপে প্রায় ৮০ হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে৷ এর তিন চতুর্থাংশই সমাধান করেছে কমিশন৷
সুমনের বক্তব্য, ‘‘সাধারণ মানুষের স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত বিষয়গুলি তুলে ধরা হচ্ছে না৷ গ্যাসের দাম, কর্মসংস্থান, ব্যাংকের সুদের হার আলোচনায় থাকছে না৷ কোনো এজেন্ডা জনতার কাছে নিয়ে যাওয়ার নেই বলেই কুকথা বলতে হচ্ছে৷’’
প্রবীণ সাংবাদিক দেবাশিস দাশগুপ্ত ডি ডাব্লিউকে বলেন, ‘‘কমিশনকে কঠোর হতে হবে৷ সাবেক মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টিএন শেষন দেখিয়েছিলেন, কমিশন কতটা কড়া হাতে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে৷ সেই পথেই কমিশনকে তার ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করতে হবে৷ নইলে নিম্নরুচির প্রচার রোখা যাবে না৷ একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলিরও এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল হওয়া দরকার৷’’