নির্বাচনি সহিংসতার বিচার হয় না কেন?
১৩ নভেম্বর ২০১৮বাংলাদেশে ২০০১ সালের নির্বাচনের পরের সহিংসতার কথা এখনো মানুষ ভুলে যায়নি৷ বিশেষ করে সংখ্যালঘু নির্যাতনের মাত্রা ছিল ভয়াবহ৷ সিরাজগঞ্জের পূর্ণিমা হয়ে উঠেছিলেন সংখ্যালঘু নির্যাতনের নির্মম প্রতীক৷ আর নির্যাতনের মুখে কোটালীপড়ার রামশীলে সারাদেশ থেকে, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের সংখ্যালঘুরা আশ্রয় নিয়েছিলেন৷ রামশীল যেন পরিণত হয়েছিল এক উদ্বাস্তু শিবিরে৷ সেই সময় এই নির্যাতন নিয়ে সংবাদ মাধ্যম ও সুশীল সমাজ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে৷ বাধ্য হয়ে তখনকার স্বরাষ্ট্রন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী রামশীল পরিদর্শনের ঘোষনা দেন৷ কিন্তু তিনি হেলিকপ্টারে করে রামশীলের অনেক ওপর দিয়ে আকাশে কয়েকটি চক্কর দেয়ার পর ঢাকায় এসে বলেন, ‘‘রামশীলে কোনো নির্যাতিত আশ্রয় নেননি৷ আমার চোখে কিছু পড়েনি৷''
তার এই হেলিকপ্টার পরিদর্শনের দিনই রামশীলে ছিলেন এই প্রতিবেদকসহ সুশীল সমাজের একটি প্রতিনিধি দল৷ তাঁদের মধ্যে ছিলেন খুশী কবির ও মেজবাহ কামালসহ আরো আনেকে৷ সেই ঘটনা আজও ভোলেননি মানবাধিকার কর্মী ও নারীনেত্রী খুশী কবীর৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা সেখানে তখন হাজার হাজার নির্যাতিত সংখ্যালঘুকে পেয়েছি৷ তাঁরা সবাই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাড়ি-ঘর ছেড়ে রামশীলে আশ্রয় নিয়েছিলেন৷ একাত্তরে বাংলাদেশের শরণার্থীরা যেমন ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তেমনি ২০০১ সালে রামশীলকে আমার মনে হয়েছে আরেকটি শরণার্থী ক্যাম্প৷ তাঁদের নির্যাতনের কথা শুনে আমরা তখন স্তম্ভিত হয়েছি৷ বাগেরহাটের এক নারীকে যৌন সন্ত্রাসীরা ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছিল৷ আমরা একটি প্রতিবেদনও দিয়েছিলাম৷ কিন্তু তখন ক্ষমতায় আসা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এসব নির্যাতনের কথা পুরোপুরি অস্বীকার করেছে৷ তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷''
২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী হামলা ও সহিংসতার ঘটনায় একটি বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর৷ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন তদন্ত কমিশনের কিছু তথ্য প্রকাশও করেছিলেন৷ তাঁর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর পরবর্তী ১৫ মাসে সারা দেশে খুন, ধর্ষণসহ ১৮ হাজারের বেশি সহিংস ঘটনার অভিযোগ পাওয়া যায়৷ তবে কমিশনে অভিযোগ দাখিল হয় ৫ হাজার ৫৭১টি৷ কমিশন ৩ হাজার ৬২৫টি অভিযোগের তদন্ত করে৷ এর মধ্যে রাজনৈতিক হত্যা রয়েছে ৩৫৫টি৷ ধর্ষণ, লুটপাট, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, অগ্নিসংযোগসহ অন্য অপরাধ ৩ হাজার ২৭০টি৷ তদন্তে ২৬ হাজার ৩৫২ জনকে হামলা এবং সহিংশতার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযুক্ত করা হয়৷ তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলারও সুপারিশ করে কমিশন৷ অভিযুক্তদের মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের নামও ছিল৷
এসব ঘটনায় তখন থেকেই বিচ্ছিন্নভাবে মামলা হয়েছে৷ কিন্তু অধিকাংশ ঘটনায় মামলা হলেও কোনো বিচার হয়নি৷ বিএননপি-জামায়াত জোট সরকার ঘটনাই স্বীকার করেনি, বিচার তো দূরের কথা৷ ২০০৮ সালের পর ক্ষমতায় এসে আওয়মী লীগ তদন্তের ব্যবস্থা করলেও বিচারের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি৷
বাংলাদেশে নির্বাচনি সহিংসতার সঠিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ নেই৷ পুলিশ সদর দপ্তরও আলাদাভাবে এ নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে না৷ তারা অপরাধের যে তথ্য সংগ্রহে রাখে, সেটাকে অপরাধের ধরন বিবেচনায় নানা ভাগ করে৷ সময় বা সুনির্দিষ্ট কোনো গ্রুপের ওপর অপরাধের হিসাব তারা বিবেচনা করে না৷ এমনকি যারা অপরাধ করে এবং যারা অপরাধের শিকার হয়, তাদের রজনৈতিক বা ধর্মীয় পরিচয়ও তথ্য-উপাত্তের ক্ষেত্রে বিচেনায় নেয় না৷ পুলিশ সদর দপ্তরের কথা হলো, ‘‘অপরাধীকে আমরা শুধু অপরাধী হিসেবেই বিবেচনা করতে চাই৷''
তবে বাংলাদেশের কিছু মানবাধিকার সংস্থা রাজনৈতিক সহিংসতার হিসাব আলাদাভাবে রাখলেও নির্বাচনকালীন সহিংসতার হিসাব আলাদা করে রাখে না৷ তবে তাদের তথ্য বিশ্লেষণ করলে নির্বাচনকালীন সহিংসতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়৷ সেখানে দেখা যায়, ৭০ ভাগ রাজনৈতিক সহিংসতাই হয় নির্বাচনের সময়৷ আর এর প্রধান টার্গেট হলো সংস্যালঘু এবং ‘দুর্বল' জনগোষ্ঠী৷ তাঁদের ভোট আদায় অথবা ভোট দানে বিরত রাখাই এই সহিংসতার মূল কারণ৷
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রথমত তারা ভীতির সৃষ্টি করতে চায়৷ আর এই ভীতির মাধ্যমে হয় ভোট নিতে চায়, অথবা ভোট দানে বিরত রাখতে চায়৷ এতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা একটা বড় টার্গেট৷ কিন্তু ভোট ব্যাংক বিবেচনা করেও তারা সহিংসতা চালায়৷ বিশেষ করে দুর্বল ও সাধারণ মানুষ এর শিকার হয়৷ আবার সংখ্যালঘুদের হামলার মুখে ফেলে কেউ কেউ প্রতিবেশি দেশে সমর্থনও পেতে চায়৷ যে-কেনো পক্ষেরই নির্বাচনি সহিংসতার মূল বিষয় হলো ক্ষমতা দখল অথবা প্রতিশোধ নেয়া৷''
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ও পরে বাংলাদেশে ব্যাপক নির্বাচনি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে৷ বিএনপি-জামায়াত ও তাদের সমমনা দলগুলো ওই নির্বাচন বর্জন এবং প্রতিহতের ডাক দিয়েছিল৷ শেষ পর্যন্ত একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় যায়৷
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী, নির্বাচনের আগের বছর ২০১৩ সালের ২৩ নভেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৪টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ৮৫ জন নিহত হন৷ আহত হন ২,৭৭৭ জন৷ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ২০১৪ সালের ২৩ জানুয়ারি একদিনে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৬০ জন নিহত এবং ১৪৫১ জন আহত হন৷
আসকের হিসাব মতে, ২০১৩ সালে ৭০৪টি সহিংসতার ঘটনায় ৪১৮ জন নিহত হন৷ আহত হন ২০ হাজার ৩৪১ জন৷ ২০১৪ সালে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ১৭১টি৷ এসব ঘটনায় মারা গেছেন ১৪৭ জন, আহত হয়েছেন আট হাজার ৩৭৩ জন৷ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরে বাংলাদেশে বাসে আগুন এবং পেট্রোল বোমা ছোড়ার ব্যাপক সহিংস প্রবণতা দেখা যায়৷ হামলার শিকার হয় পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও৷ রাজনৈতিক সহিংসতায় ২০১৩ সালে ১৫ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন৷ ২০১৪ সালে তিন জন এবং ২০১৫ সালে আরো তিন জন পুলিশ সদস্য রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হন৷
এই নির্বাচনের আগে-পরে রাজনৈতিক সহিংসতা ঢাকায় দুইশ' মামলা হয়৷ সারাদেশে হয় এক হাজার ৮৪১ মামলা৷ এসব মামলায় আসামি করা হয় ৫ হাজারেরও বেশি ব্যক্তিকে৷
সংবাদমাধ্যম এবং মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবেদন অনুযায়ি, ২০১৪ সাল পর্যন্ত গত ২৪ বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৩০৮৪ জন৷ এর মধ্যে ২০১৩ এবং ২০১৪ সাল এই দুই বছরেই নিহত হয়েছেন ৫৫৬ জন৷
খুশী কবির বলেন, ‘‘আমার জানা মতে, রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত বিচার হয় না বললেই চলে৷ আবার অনেক ঘটনায় মামলা করতেও সাহস পান না কেউ কেউ৷ এর কারণ বিচারহীনতা৷ ২০০১ সালে যারা হামলা করেছে, তারাই ক্ষমতায় ছিল৷ পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তদন্ত করলেও সার্বিকভাবে বিচারের উদ্যোগ নেয়নি৷''
নির্বাচনের আগে ও পরে হামলার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘এই ধরনের হামলা ভারত, পাকিস্তানেও হয়৷ এর কারণ হলো, ডিভাইড অ্যান্ড রুল৷ ভয়-ভীতি দেখিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া৷ ভোটে প্রাধ্যান্য বিস্তার করা৷''
অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘নির্বাচনি সহিংসতার বিচার না হওয়ার নানা কারণ আছে৷ যারা হামলা করে, তারা যদি ক্ষমতায় যায়, তাহলে তো তাদের স্বার্থেই তারা বিচার করে না৷ আর তারা যদি ক্ষমতায় না যায়, তাহলেও বিচার হয় না আরেক কারণে৷ সেটা হলো, মামলাগুলোকে ঝুলিয়ে রাখা হয় বিরোধীদের ভয়ে বা চাপে রাখার উদ্দেশ্যে৷ এটা একটা রাজনৈতিক খেলা৷ রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য নির্বাচরকালীন সহিংসতা হয়৷ আবার বিচারও হয় না রাজনৈতিক কারণেই৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘যারা এই নির্যাতনের শিকার হন, তারা দুর্বল৷ তারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু অথবা ক্ষমতাহীন মানুষ৷ এটা বন্ধে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব নেয়া উচিত৷ আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এর দায় এড়াতে পারে না৷ আর রাষ্ট্রকে এর দায়িত্ব নিতেই হবে৷''
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷