নির্বাচনকে টার্গেট করে প্রশাসন সাজানো হচ্ছে?
১৭ জুন ২০২৩তবে আওয়ামী লীগ বলছে এসব রুটিন ওয়ার্ক। নির্বাচনের আগে তিন মাস এই দায়িত্ব থাকবে নির্বাচন কশিমনের হাতে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন," এই ধরনের রদবদলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তবে সরকার নিরপেক্ষ হলে সরকারি কর্মকর্তারা নিরপেক্ষ আচরণ করেন।”
প্রক্রিয়া শুরু:
সর্বশেষ ১৩ জুন পুলিশের ২২ এজন এসপি এবং সাতজন জিআইজিকে বদলি করা হয়েছে। গত ১২ মে পদ না থাকার পরও ১১৪ জন যুগ্ম সচিবকে পদোন্নতি দিয়ে অতিরিক্ত সচিব করা হয়। এরই প্রতিক্রিয়ায় এখন পুলিশের ৭২০ জন কর্মকর্তা পদোন্নতি চাচ্ছেন বলে জানাগেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের একটি পদোন্নতি সংক্রান্ত প্রস্তাব নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করেছে। শূন্য পদ না থাকলেও তারা প্রশাসনের মতোই পদোন্নতি চান। যুগ্ম সচিব পদেও বড় সংখ্যায় পদোন্নতির প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।
গত ৭ জুন তিনজন সচিব এবং একজন অতিরিক্তি সচিবকে বদললি করা হয়। বদলি করা হয় ১৪ জন যুগ্ম সচিবকে। একই দিনে পুলিশের ১৭ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকেও বদলি করা হয়।
প্রশাসনে এখন পদের চেয়ে তিনগুণ বেশি কর্মকর্তা রয়েছেন। ফলে বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা যেমন ওএসডি হয়ে আছেন তেমনি অনেক কর্মকর্তা তাদের র্যাংকের চেয়ে নিম্নপদে চাকরি করছেন।
যেভাবে পরিকল্পনা:
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) পদে শতাধিক নতুন কর্মকর্তাকে চলতি জুন মাসে এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) পদে জুলাইয়ের মধ্যে পদায়ন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গত মার্চ মাসে প্রশাসন ক্যাডারের ২৫ ও ২৭তম ব্যাচের দুই শতাধিক কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ শেষে জেলা প্রশাসক( ডিসি) নিয়োগের ফিটলিস্ট চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। একই ভাবে ইউএনও হিসেবে পদায়নের জন্য ৩৫তম ব্যাচের তিন শতাধিক কর্মকর্তাকে ফিটলিস্টে রাখা হয়েছে। আর ৩৩তম ব্যাচের যে সকল কর্মকর্তা বর্তমানে ইউএনও হিসেবে দায়িত্বে আছেন তাদের ফিটলিস্ট করে জুলাই মাসের দিকে এডিসি হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হবে বলে জানা গেছে।
গত ১২ মার্চ দেশের ৮ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
গত বছরের ২৩ নভেম্বর ঢাকাসহ দেশের ২৩ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেয়া হয়। এছাড়া গত আগষ্ট মাসে ৪০ জেলায় নতুন পুলিশ সুপার পদায়ন করা হয়। বাকি জেলায় নতুন ডিসি এবং ৪৯৬ উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদায়নের জন্য আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরির কাজ ইতিমধ্যে শেষ করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
ইউএনওদের ফিটলিস্ট তৈরির পর ৪০ জনের প্রশিক্ষণ চলছে। ধাপে ধাপে তাদেরকে পদায়ন করা হবে বলে জানা গেছে।
এদিকে ৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, ১৩ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনের চাকরির মেয়াদ শেষে অবসরে যাওয়ার কথা। ২৫ মে অবসরে যাওয়ার কথা থাকলেও প্রতিরক্ষা সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলমের চাকরির মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়েছে।
এই পদগুলোতে যারা দায়িত্ব পালন করেন, তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কাজে সম্পৃক্ত থাকেন। জননিরাপত্তা বিভাগের অধীনে বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী রয়েছে। তাই এই বিভাগটি নির্বাচনকালিন সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ । এই কারনে এসব সচিব পদে যারা আছেন তাদের অবসরে না পাঠিয়ে চুক্তিভিত্তিক আরো এক বছরের জন্য নিয়োগ দেয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ অথবা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচনহওয়ার কথা আছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে নির্বাচন পর্যন্ত প্রশাসনে বদলি বা অন্যকোনো সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন। সেই হিসাবে পুলিশ ও প্রশাসন তিন মাস তাদের অধীনে থাকে। ফলে সরকার পদলি, পদায়ন, পদোন্নতি তার আগেই করে ফেলতে চাইছে।
দুই দলের কথা:
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ১৫ জুন অভিযোগ করেন," দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ পুলিশ ও প্রশাসনে রদবদল করে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নিতে চাচ্ছে। সব কিছু নিয়ন্ত্রণে নেয়া শুরু করে দিয়েছে। কয়েকটি পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, পুলিশের ব্যাপক রদবদল, ব্যাপক পদোন্নতি, ৭৫০ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে আর পোস্টিং করা হয়েছে। কারণ মাথার মধ্যে নির্বাচন।”
আর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স শনিবার ডয়চে ভেলেকে বলেন," তারা যতই সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলুক না কেন তাদের এই কাজই প্রমাণ করে পুলিশ ও প্রশাসন দিয়ে তারা নির্বাচন তাদের মতো করতে চায়। গত ১৫ বছরে তারা প্রশাসনকে পুরোপুরি দলীয়করণ করেছে। দলীয় লোকজনকে বিভিন্ন পদে বসিয়েছে। এখন নানা প্রক্রিয়ায় তা আরো সংহত করছে। ফলে এই সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়।”
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন," প্রশাসনকে দলীয়করণ করার পরও এখনো কিছু যোগ্য ও নিরপেক্ষ লোক আছে। যারা চাপে আছেন বা তাদের ওএসডি করে রাখা হয়েছে। যদি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় তাহলে তারা প্রশাসনকে নিশ্চয়ই নিরপেক্ষ করার উদ্যোগ নেবেন।”
এর জবাবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেনবলেন," প্রশাসনে বদলি, পদোন্নতি, পদায়ন একেকটি নিয়মিত কাজ, রুটিন ওয়ার্ক। সরকার তাই করছে। নির্বাচনের কথা বলে তো আর পদোন্নতি বদলি আটকে রাখা যাবেনা। যাদের পদোন্নতি পাওনা হয়ে গেছে তাদের তো তা দিতে হবে। তিন বছরের বেশি কাউকে তো একই জায়গায় রাখার সুযোগ নাই। বদলি তো করতে হবে।”
তার কথায়," প্রশাসনে কখনো দলীয় লোক থাকে না। আর নির্বাচনের তিন মাস তো পুরো ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকবে। বিএনপি যদি তখন কারুর বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয় তা হলে নির্বাচন কমিশন তা তো দেখবে। বিএনপি যেসব অভিযোগ করছে তার কোনো ভিত্তি নাই।”
সরকার নিরপেক্ষ হলে প্রশাসনও নিরপেক্ষ হয়:
আর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন," এভাবে নির্বাচনের আগে বদলি পদোন্নতি, পদায়ন করা হলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, প্রক্রিয়াও ঠিক নেই। কিছু রুটিন ওয়ার্ক আছে সেগুলো চলতে পারে। যেমন কারুর বদলির সময় হয়ে গেছে, কারুর প্রমোশন পাওনা হয়ে গেছে, কারুর অবসরে যাওয়ার সময় হয়েছে- এগুলো তো করতে হবে। এর বাইরে যা করা হচ্ছে তা তো ঠিক না।”
তার কথা,"নির্বাচনের আগে সাধারণত সব রাজনৈতিক দলই তালিকা দেয়। সেটা দেখে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা করার তা করা যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে সময় আমরা তা দেখেছি। তারা সব দলের তালিকা নিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা ভালো মনে করেছেন তা করেছেন। এককভাবে কিছু করা ঠিক না।”
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন," যদি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় অথবা দলীয় সরকারও যদি নিরপেক্ষ হয় তাহলে প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে কাজ করে। এই প্রশাসনই অতীতে একাধিক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করেছে।”
তিনি মনে করেন," প্রশাসনে প্রচুর নিরপেক্ষ লোক আছে। তারা নিরপেক্ষভাবেই কাজ করতে চান। তারা সুযোগ পেলে দলীয় চিন্তার বাইরে গিয়ে নিরপেক্ষভাবে কাজ করবেন। অতীতে এর একাধিক প্রমাণ আছে।”
এবিষয়ে কথা বলার জন্য জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীকে চেষ্টা করেও পাওয় যায়নি।