নারদ নারদ বলে স্টিং অপারেশন
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮কয়েকমাসের মধ্যেই বিধানসভা নির্বাচন৷ ভুয়ো অর্থলগ্নি সংস্থা সারদার মামলা নিয়ে জর্জরিত তৃণমূল কংগ্রেস৷ বিরোধী দলগুলি লাগাতার সে সব বিষয় নিয়ে প্রচার চালাচ্ছে৷ নাগরিক সমাজও শাসকের বিরুদ্ধে নানারকম আলোচনা করছে৷ ঠিক সেই পরিস্থিতিতেই নতুন ‘যন্ত্রণার' আবির্ভাব৷ ‘নারদ' নামে এক সংস্থা প্রকাশ করল তাদের স্টিং অপারেশন৷ দেখা গেল শাসকদলের ১২ জন নেতা-মন্ত্রী গোপন ক্যামেরার সামনে ঘুস নিচ্ছেন৷
নারদ স্টিং অপারেশন নিয়ে এরপর জলঘোলা হয়েছে বিস্তর৷ বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে বিরোধীরা লাগাতার প্রচার চালিয়েছে ঘুস নেওয়া নেতা মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে৷ শাসক দল কখনো যুক্তি দিয়ে, কখনো কুযুক্তি দিয়ে সমস্যার মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছে৷ নিজেদের দোষ ঢাকতে পুরো ঘটনাটিকেই বিরোধীদের ষড়যন্ত্র বলে চালানোর চেষ্টা করেছে৷ তবে শেষপর্যন্ত ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে নারদের কোনো প্রভাব পড়েনি৷ তৃণমূল দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেছে৷ কিন্তু নারদ মামলা এখনো অব্যাহত৷ অতি বড় তৃণমূলপন্থিও অস্বীকার করবেন না যে, নারদ কাণ্ড দলের ভাবমূর্তিকে প্রভূত নাড়িয়ে দিয়েছে৷
ঘটনার সূত্রপাত অবশ্য ২০১১ সালে৷ ম্যাথু স্যামুয়েল নামে কেরলের এক সাংবাদিক তখন কাজ করেন বিখ্যাত সংবাদসংস্থা ‘তহেলকা'-তে৷ এর আগে তহেলকা স্টিং অপারেশন করে নড়িয়ে দিয়েছিল দিল্লির গদি৷ মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে হয়েছিল তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজকে৷ এবং সেই স্টিং অপারেশনেরও প্রধান কাণ্ডারী ছিলেন ম্যাথু৷ ২০১১ সাল নাগাদ ‘তহেলকা' ঠিক করে আরো একটা স্টিং অপারেশন করা দরকার৷ পুরো দেশকে যা নাড়িয়ে দেবে৷ প্রাথমিক ভাবে তাদের সিদ্ধান্ত ছিল হিমাচল প্রদেশ কিংবা মধ্যপ্রদেশে গিয়ে অপারেশনটি চালানো হবে৷
কিন্তু বিজেপির বিরুদ্ধে আরও একবার অভিযান চালাতে রাজি হননি ম্যাথু৷ তাঁর বক্তব্য ছিল, এর আগেও তিনি বিজেপির বিরুদ্ধেই অপারেশন চালিয়েছিলেন৷ দ্বিতীয়বার নতুন কোনো দলের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে চান৷ পশ্চিমবঙ্গে ২০১১ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচন ততদিনে সম্পূর্ণ হয়েছে৷ ৩৪ বছরের বাম সরকারকে তাসের ঘরের মতো ভেঙে ফেলে ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল৷ আর ঠিক তার পরপরই সারদা কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে চলে এসেছে৷ নাম জড়িয়েছে তৃণমূলের প্রথমসারির বেশ কিছু নেতা মন্ত্রীর৷ এ হেন পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গকেই টার্গেট করেন ম্যাথু৷ একটি ভুয়ো সংস্থা তৈরি করেন৷ যার নাম দেওয়া হয় ‘ইমপেক্স কনসালটেন্সি সলিউশন'৷ বন্ধুদের সাহায্যে সেই সংস্থার একটি ওয়েবসাইটও তৈরি করে ফেলেন ম্যাথু৷ নিজেকে তার কর্ণধার হিসেবে পরিচয় দেন৷ বানিয়ে ফেলেন একটি ভুয়ো আধার কার্ডও৷
এরপর কলকাতায় এসে এক ট্যাক্সি চালকের সাহায্যে রাজ্যের বিশিষ্ট নেতা এবং মন্ত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন ম্যাথু৷ একে একে যোগাযোগ করেন তৃণমূলের তৎকালীন সর্বভারতীয় সভাপতি মুকুল রায় থেকে শুরু করে পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, তৎকালীন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র থেকে শুরু করে লোকসভার সাংসদ সৌগত রায় পর্যন্ত সকলের সঙ্গেই৷ বাদ যাননি পুরসভার মেয়র এবং পরিবেশমন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায়ও৷ গোপন ক্যামেরায় দেখা যায় এঁদের অধিকাংশই ম্যাথুর কাছ থেকে সরাসরি টাকা নিচ্ছেন৷ মুকুল রায় এবং ফিরহাদ হাকিম অবশ্য তাঁদের সহকর্মীদের হাতে টাকা পৌঁছে দেওয়ার কথা বলেন৷ রাজ্যের এক উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার এসএমএইচ মির্জাকেও ক্যামেরায় দেখা যায়৷ তিনি ম্যাথুকে বলেন, মন্ত্রী এবং নেতাদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করিয়ে দেবেন৷
গোপন ক্যামেরার সামনে নেতা মন্ত্রীদের ম্যাথু বলেন, কলকাতায় তাঁর সংস্থা ব্যবসা করতে চায়৷ সমস্ত ব্যবস্থাপনা যাতে ঠিক থাকে তার জন্য তিনি নেতা মন্ত্রীদের খুশি করতে চান৷ মন্ত্রীরাও সব ঠিক থাকবে এই আশ্বাস দিয়ে তাঁর কাছ থেকে ঘুস নেন৷
ঘটনা সাড়া ফেলে দেয় সর্বত্র৷ প্রথামিক ভাবে তৃণমূলের তরফ থেকে জানানো হয়, বিরোধীদল বিজেপি চক্রান্ত করে তাদের ফাঁসানোর চেষ্টা করছে৷ তবে ক্যামেরার সামনে টাকা নেওয়ার বিষয়টি নিয়ে তারা কথা বলতে চায়নি৷ পরবর্তীকালে অবশ্য বলার চেষ্টা করা হয়, ঘুস নয়, স্যামুয়েল পার্টিকে অনুদান দিতে চেয়েছিলেন৷ সে কারণেই নেতারা অর্থ গ্রহণ করেছেন৷
পুরো ঘটনাটির তদন্ত এখনো চলছে৷ ইতিমধ্যেই কলকাতা হাইকোর্টে এই মোতাবেক মামলা শুরু হয়েছে৷ প্রাথমিক ভাবে ঘটনার তদন্ত শুরু করেছিল কলকাতা পুলিশ৷ পরবর্তীকালে আদালতের নির্দেশে তদন্তভার হস্তান্তরিত হয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইয়ের হাতে৷ আদালত জানায়, কলকাতা পুলিশের তদন্ত পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে৷
তৃণমূল অবশ্য বিষয়টিকে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে৷ তারা প্রশ্ন তুলেছে, কোথা থেকে টাকা জোগার করেছিলেন ম্যাথু? বিজেপি কি তাঁকে দিয়ে এই কাজ করিয়েছিল? যদিও ম্যাথু জানিয়েছেন, তৃণমূলের প্রাক্তন রাজ্যসভার সাংসদ কে ডি সিংহ তাঁকে অর্থ সাহায্য করেছিলেন৷ বিষয় যা-ই হোক, তা তদন্ত সাপেক্ষ৷ আদালতেই তার ফয়সলা হবে৷
তবে নারদ স্টিং অপারেশন যে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল এবং ভবিষ্যতেও দেবে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ এবং এক্ষেত্রে রাজনীতি যে তরজাই করুক না কেন, একজন সাংবাদিক যে স্বাধীনভাবে এ ধরনের স্টিংঅপারেশন চালাতে পারেন, তা আরো একবার পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে৷ ডয়চে ভেলের তরফ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল ম্যাথু স্যামুয়েলকে৷ হোয়াটসঅ্যাপে নিজের মতামত জানিয়েছেন বলেছেন তিনি৷ তাঁর মতে, ভারতের মতো দেশে আরো বেশি স্টিং অপারেশন হওয়া দরকার৷ কারণ, উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি ধরার জন্যএটা একটা মোক্ষম অস্ত্র৷ এবং তার চেয়েও বড় কথা, এটি একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া৷ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা৷ কোনো সরকার সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে না৷ নাগরিক সমাজের মতে, এটাই গণতান্ত্রিক দেশে বাকস্বাধীনতার চরিত্র হওয়া উচিত৷ মত প্রকাশের এবং সাংবাদিকের স্বাধীনতার প্রমাণ৷ এর আগেও জর্জ ফার্নান্ডেজের রাজনীতি হার স্বীকার করেছিল সাংবাদিকের স্বাধীনতার কাছে৷ আগামীদিনেও পারবে, এমনই তাঁদের বিশ্বাস৷ বিশেষত, বাংলাদেশে নতুন আইনের খসরা প্রস্তাব তৈরি হওয়ার পর বিষয়টি ভারতের কাছেও অন্যরকম গুরুত্ব পাচ্ছে৷
লেখকের ভাবনার সঙ্গে আপনি কতটুকু একমত? লিখুন নিচের মন্তব্যের ঘরে৷