মার্কিন-জার্মান সম্পর্ক
২৫ অক্টোবর ২০১৩নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা, ভেবে-চিন্তে কথা বলা, বক্তব্যে ভারসাম্য রাখা – আঙ্গেলা ম্যার্কেল এ সব গুণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত৷ সেই ম্যার্কেলই যখন প্রকাশ্যে ক্রোধে ফুঁসছেন, তখন তা নজর কাড়ার মতো ঘটনা বটে৷ মনঃস্তত্ববিদরা বলবেন, তাঁর সহ্যশক্তির সীমা ভেঙে গেছে৷ তাঁর শব্দচয়নেই সেটা প্রকাশ পাচ্ছে৷ বলেছেন, তাঁর মোবাইল ফোনে আড়ি পাতা ‘একেবারে গ্রহণযোগ্য নয়' এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে ‘আস্থায় গুরুতর ফাটল' ধরেছে৷
কয়েক মাস আগে যখন অ্যামেরিকানদের আড়ি পাতার খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছিল, তখন এই আঙ্গেলা ম্যার্কেলই অত্যন্ত নরম সুরে এ বিষয়ে মুখ খুলেছিলেন৷ ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্যে তিনি বিষয়টি খোলসা করে দেবার মৃদু আবেদন জানিয়েছিলেন মাত্র৷ মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার প্রাক্তন কর্মী এডওয়ার্ড স্নোডেন যে কেলেঙ্কারি নাটকীয় ভাবে ফাঁস করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তা রাজনৈতিক ডামাডোলের আড়ালে তলিয়ে গেছে৷
সহ্যশক্তির সীমা লঙ্ঘন
জার্মান চ্যান্সেলর এবার বেজায় চটেছেন৷ বলা যেতে পারে, যে তিনি জার্মানির হাজার হাজার মানুষের উপর আড়ি পাতার অভিযোগের বিষয়টি লঘু করে দেখে শুধু নিজের মোবাইলে আড়ি পাতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড' দেখাচ্ছেন৷ না, আসলে এ ক্ষেত্রে আরও একটি সীমা লঙ্ঘন করা হয়েছে৷ জার্মান চ্যান্সেলর হিসেবে আঙ্গেলা ম্যার্কেল জার্মানির নীতি পরিচালনা করেন৷ তাঁর উপর গুপ্তচরবৃত্তি চালানো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শত্রুভাবাপন্ন পদক্ষেপের সমান৷ কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো শত্রু দেশ আড়ি পাতছে না, কাজটা করছে এক মিত্র দেশ৷ বিষয়টি এই কারণেই অত্যন্ত স্পর্শকাতর৷
গুপ্তচরবৃত্তি সম্ভবত বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীন পেশা৷ শীতল যুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এই ধরনের কার্যকলাপ৷ তবে পরিস্থিতি বদলালেও গুপ্তচরবৃত্তি এখনো বহাল তবিয়তেই রয়েছে৷ শুধু চালকের আসন বদলে গেছে৷ বন্ধুরাই আমার উপর আস্থা হারালে আর শত্রুর দরকার কী! মস্কো বা বেইজিং আজ আমাদের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কথা আগেভাগে জানার চেষ্টা করলে কেউ এমন উত্তেজিত হতো না৷ এমনটা যে সত্যি ঘটে চলেছে, নীরবে আমরা তা ধরেও নিচ্ছি৷ ওয়াশিংটনের আচরণ জার্মানদের অনেকগুলি কারণে আঘাত করেছে৷
প্রথমত, নাগরিকদের উপর ঢালাও গুপ্তচরবৃত্তি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূলে আঘাত করে৷ বিশেষ করে জার্মানিতে আমরা নাগরিক অধিকার ও তথ্য সংরক্ষণের উঁচু মানদণ্ড গড়ে তুলেছি ও আইন করে তা নিশ্চিত করেছি৷ তাই আড়ি পাতার এমন খামখেয়ালি আচরণ আমাদের এতটা ক্ষুব্ধ করেছে৷ দ্বিতীয়ত, জার্মানি অ্যামেরিকার ঘনিষ্ঠতম সহযোগীদের অন্যতম৷ তাই সেই অনুযায়ী প্রাপ্য মর্যাদার প্রত্যাশা করি আমরা৷ তৃতীয়ত, আমাদের দেশে ওবামার উজ্জ্বল ভাবমূর্তি এনএসএ-কেলেঙ্কারির ফলে গত কয়েক মাস ধরে একের পর এক ধাক্কা খেয়ে চলেছে৷ এবার অভিযোগ উঠেছে, যে ওবামার মতো ‘ভদ্রলোক' ম্যার্কেলের মোবাইল সংলাপের উপর নজর রাখতে বলেছেন৷
সীমাজ্ঞান হারিয়েছে এনএসএ
সাধারণত বন্ধুদের মধ্যে এই মাত্রায় আস্থাভঙ্গ হলে হয় বন্ধুত্ব শেষ হয়ে যায়, যা এক দুষ্ট রাজনৈতিক চাল হতে পারে৷ অথবা ক্ষোভে ফেটে পড়ে কড়া কথা শোনাতে হয়৷ বন্ধু বলেই তো কঠিন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায়, প্রয়োজনে কড়া উপদেশও দেয়া যায়! এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পরামর্শ দিয়ে বলতে হবে, যে নাইন ইলেভেনের পর থেকে তারা যে অস্বাভাবিক আতঙ্কে ভুগছে, এবার তার চিকিৎসার সময় এসে গেছে৷ সবচেয়ে ভালো হয় যদি পারস্পরিক সংলাপে স্বচ্ছতা আনা যায় এবং এনএসএ-র লাগামে রাশ টানা হয়৷ সাবেক পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট গোয়েন্দা পুলিস ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত যে সব উদ্ভট কাণ্ডকারখানা চালিয়ে এসেছিল, এনএসএ-র কার্যকলাপ অনেক ক্ষেত্রে তাকেও ম্লান করে দিয়েছে৷ এমনটাও সম্ভব, কেউ ভাবতে পেরেছিল!
সংবাদভাষ্য: ফল্কার ভাগেনার/এসবি
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ