তালেবান আতঙ্ক: ভারতে ফিরছেন আফগান শরণার্থীরা
৪ আগস্ট ২০২১মাজার-ই-শরিফের বাসিন্দা নাসির খান। বছর তিরিশের নাসির একসময় আফগান সেনাবাহিনীর জওয়ান ছিলেন। এখন আশ্রয় নিয়েছেন দিল্লিতে। ১৯ দিন তালেবানের হাতে বন্দি থাকার পরে বিপুল অঙ্কের মুক্তিপণের বিনিময়ে রেহাই পেয়েছেন। তারপরই চলে এসেছেন ভারতে। হাতে কাজ নেই। কোনোমতে শুকনো ফলের ব্যবসা করে দিন কাটছে। তবু স্ত্রী-বাচ্চাকে নিয়ে আফগানিস্তান ফিরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। গেলেই ফের তালেবানের হাতে ধরা পড়বেন, এই আশঙ্কায়।
দিল্লিতে ডিডাব্লিউয়ের সঙ্গে কথা বলার সময় বার বার চোখে জল চলে আসছিল নাসিরের। বার বার বলছিলেন, সবচেয়ে বড় লড়াই খিদের সঙ্গে। ভারতে এসে প্রত্যেক মুহূর্তে সেই লড়াইটাই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। "কখনো কখনো মনে হয়, মরতেই যদি হয়, দেশের মাটিতে মরি। অন্তত সামান্য সম্মানের সঙ্গে মরতে পারব। কিন্তু তারপরেই মনে হয়, দেশে ফেরা মানে, গোটা পরিবারকে তালেবানের হাতে তুলে দেওয়া।"
নাসিরের বাবা-মা এখনো মাজার-ই-শরিফে। কখনো ফোনে পাওয়া যায়, কখনো লাইন পাওয়া যায় না। কথা হলে বৃদ্ধা মা আতঙ্কিত গলায় শোনাতে থাকেন, কীভাবে তালেবান ঘিরে ফেলেছে শহর। বাড়িতে এসে নাসিরের খোঁজ নিয়ে গেছে। বলতে বলতে নাসিরের মনে পড়ে যায়, কীভাবে রাস্তা থেকে তাকে বাইকে তুলে নিয়েছিল তালেবান। নিয়ে গেছিল নিজেদের ডেরায়। ১৯ দিন ধরে চলেছে অকথ্য অত্যাচার। "মেরেই ফেলত। বাবা কয়েকজন পাশতুন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে বিরাট অঙ্কের মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে ছিলেন। তারপর আর আফগানিস্তানে থাকার সাহস পাইনি।"
নাসিরের মতো বহু আফগান শরণার্থীকে নিয়ে এখন ব্যস্ত ভারতে আফগান শরণার্থীদের সংগঠনের প্রেসিডেন্ট আহমেদ জিয়া গনি। কয়েক দশক আগে তিনিও তালেবানের হাতে বন্দি হয়েছিলেন। বছরকয়েক আগে তার ছেলেকেও অপহরণ করেছিল তালেবান। ছেলে আর বেঁচে নেই। জার্মানি, ইরান, রাশিয়া সহ বিশ্বের বহু জায়গায় শরণার্থীর জীবন কাটিয়েছেন পেশায় চিকিৎসক আহমেদ। এখন দিল্লিতে থাকেন। ডিডাব্লিউকে আহমেদ বলছিলেন, "করোনার সময় ভারতে বসবাসকারী বহু আফগান শরণার্থী দেশে ফেরার চেষ্টা করছিলেন। কারণ, ভারতে তারা কোনোরকম স্বাস্থ্যপরিষেবা পাচ্ছিলেন না। অনেকে চলেও গেছিলেন। কিন্তু আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে ফিরে আসছেন অনেকে। ভয়ে, আতঙ্কে।"
ভয়ের বাতাবরণ নিজামুদ্দিনের মুখে। পেশায় শিক্ষক নিজামুদ্দিন এখন দিল্লির রাস্তায় আফগানি নান বিক্রি করেন। তালেবান তুলে নিয়ে গেছিল তার বাবাকে। এখনো পর্যন্ত বাবার কোনো খবর মেলেনি। বাড়ির দুই বোনের নাম খাতায় লিখে নিয়ে গেছিল তালেবান নেতারা। জানিয়ে গেছিল, তাদের বিয়ে দিতে হবে তালেবান যোদ্ধাদের সঙ্গেই। এরপরই দিল্লিতে পালিয়ে আসেন নিজামুদ্দিন। বোনরাও তার সঙ্গেই থাকছেন।
সত্তর-আশির দশক থেকে ভারতে শরণার্থী হিসেবে আসতে শুরু করেন আফগানরা। দিল্লিতে এই মুহূর্তে প্রায় ২১ হাজার আফগান শরণার্থী থাকেন। করোনার সময় তাদের অনেকেই দেশে ফিরছিলেন বা ফেরার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন পরিবারকে ভারতে আনার চেষ্টা করছেন তারা।
আশির দশকে ভারতে এসেছিলেন ফাহিম। পড়াশোনা করেছেন দিল্লিতেই। এখন বৈধ কাগজ নিয়ে ভারতে থাকেন। একটি রেস্তোরাঁ চালান। কথায় কথায় ফাহিম বলছিলেন, "আফগানিস্তান আসলে একটা যুদ্ধের প্রকল্পভূমিতে পরিণত হয়েছে। আপাতত প্রজেক্ট তালেবান চলছে। বিভিন্ন দেশের যুদ্ধব্যবসা জড়িয়ে আছে তাদের সঙ্গে। তালেবানরা ক্ষমতায় চলে এলে আবার একটা নতুন প্রকল্প শুরু হবে। তালেবান বিরোধীদের হাতে তখন অস্ত্র দেওয়া হবে। টাকা দেওয়া হবে।" ক্ষুব্ধ ফাহিমের বক্তব্য, এভাবেই দশকের পর দশক ধরে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে দেশে। সাধারণ আফগান নাগরিকরা বিরক্ত, হতাশ। তাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।
দিল্লির আফগান পাড়া বরাবরই ঝকঝকে। নানা কিসিমের ব্যবসায় শোভিত। রাস্তায় দেখা যায় নানা রঙের মানুষ। সেই আফগান পাড়ায় এখন কান পাতলেই বিষাদের সুর। থমথমে। বড্ড থমথমে। ভিড় কেবল ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলির সামনে।