ঢাকার মশা কবে মরবে, কেন মরবে
১২ মার্চ ২০২১প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে শপথ পাঠ করালেন, তারপর তাদের উদ্দেশ্যে, তাদের দায়িত্ব, আশু করণীয় সম্পর্কে কিছু কথা বললেন৷ তার বক্তব্যের ভাষাটা ছিল এরকম, ‘‘আপনাদেরকে এখন মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ আপনাদের এখানে মনোযোগ দিতেই হবে৷ তা নাহলে মশা আপনাদের ভোট খেয়ে ফেলবে৷ আপনারা অবশ্যই এটি দেখতে পাবেন৷ আপনাদের মনে রাখতে হবে যে, মশা ছোট (পোকামাকড়) হলেও খুব শক্তিশালী৷’’
দেশের প্রধানমন্ত্রীর উচ্চারিত এমন সতর্কবাণী কি রাজধানীর দুই মেয়র সর্বোচ্চ বিবেচনায় নিয়েছিলেন? নিয়ে থাকলে তার প্রতিফলন কি নগরবাসী উপলব্ধি করতে পেরেছে? মশা নিয়ে এই যে সাম্প্রতিক হইচই, সেটা প্রমাণ করে যে ছোট্ট এই প্রাণীটিকে নিয়ন্ত্রণে তারা তখন থেকেই ব্যবস্থা নেননি, নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি৷
কিন্তু কেন নেননি? কেন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকেও গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি? কী ভেবেছিলেন তারা তখন? নিশ্চয়ই কিছু একটা চিন্তা করেছিলেন৷ তাদের চিন্তাকে কি আমরা অনুরসরণ করতে পারবো? আমরা ছোট মানুষ, সাধারণ জনগণ; মাননীয় মেয়রের তুলনায় ছোট্ট মশকের চেয়েও ক্ষুদ্র৷ তাই শত চেষ্টাতেও হয়ত ওনাদের মনের কথা ঠিকঠাক ধরতে পারবো না৷ তারপরও, নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে স্মরণে রেখেও, কিছু ধারণা হয়তো করতে পারবো৷ কী সেই ধারণা? সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বরং মশা নিয়ে বর্তমানে যে সকল নাটক চলছে- এ বিষয়ে কিছু বলে নিই৷
মশা নিয়ে নাটকে অবশ্য খুব বেশি একটা বৈচিত্র্য নেই৷ প্রতি বছর প্রায় একই ঘোষণা, একই সংলাপ, এবং একই ব্যর্থতা৷ প্রথম ঘোষণাটি আসে জুলাই মাসে, বাজেট ঘোষণার সময়৷ মজার ব্যাপার হলো, মশার জীবনধারার নিয়ম অনুসারে বছরের এই সময়টিতেই নগরীতে মশার উপদ্রব থাকে সবচেয়ে কম৷ এই রকম সুবিধাজনক সময়ে, বাজেটে মশক নিয়ন্ত্রণে বরাদ্দের কথা বলা হয়৷ দেখা যায় আগের বছরের চেয়ে বরাদ্দ বেড়েছে৷ নতুন নতুন প্রতিজ্ঞা উচ্চারিত হচ্ছে৷ মেয়র সাহেবদের কথা শুনে মনে হয়- এবার নিশ্চিতভাবেই মশা মরবে, নয়তো নিদেনপক্ষে পালাবে৷ কিন্তু বাস্তবে সেরকম কিছুই ঘটে না৷ মশার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য কোনো প্রস্তুতি আর দেখা যায় না৷ সবাই যেন সবকিছু বেমালুম ভুলে যায়৷
এরপর নভেম্বর ডিসেম্বর নাগাদ ঢাকা মহানগরী পূর্ব ও পশ্চিম এলাকায় প্রথমে মশার প্রকোপবাড়তে থাকে৷ তখন থেকে আস্তে আস্তে মানুষের বিরক্তির কথা শোনা যায়৷ জানুয়ারি ফেব্রুয়ারিতে যখন পুরো ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ে মশার উপদ্রব, তখন যেন হুঁশ হয় সিটি কর্পোরেশনের কর্তাদের৷ তারা বলেন, ‘‘আমরা মশা মারার জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছি, আমাদের মশক নিধন কর্মীরা সকালে লার্ভিসাইডিং আর বিকালে ফগিং করছে৷'' নগরবাসী লার্ভিসাইডিং অবলোকনের তেমন একটা সৌভাগ্য অর্জন না করলেও মাসে এক-দুবার ফগিংটা দেখতে পায়৷ কিন্তু সব মিলিয়ে মশা আর কমে না৷ প্রশ্নের মুখে পড়লে তখন কর্তারা বলেন, ‘‘এবার আমরা ক্রাশ প্রোগ্রাম চালাবো৷'' ক্রাশ প্রোগ্রাম বিষয়টা আসলে কী তা সিংহভাগ মানুষই বোঝে না৷ কিন্তু এতটুকু হয়তো বোঝে যে, কিছু একটা হতে যাচ্ছে৷
ক্রাশ প্রোগ্রামের প্রস্তুতি শুরু হতে হতে মার্চ মাস চলে আসে৷ এপ্রিলের শুরু অথবা মাঝামাঝি ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়৷ এর প্রথম ঝাপটাতেই মশক উড়ে যায়, বৃষ্টির পানির তোড়ে ভেসে যায় তাদের লার্ভা৷ কমে যায় মশা৷ মানুষ ভুলে যায় ক্রাশ প্রোগ্রামের কথা, কর্তা ব্যক্তিরাও আবার চলে যান মৌসুমী ঘুমে৷
মশা নিয়ে এই নাটক অনেক বছর ধরেই চলছে, খুব একটা পরিবর্তন নেই৷ মাঝে অবশ্য দু-একবার কীটনাশকের বিষয়টি আলোচনায় আসে৷ কীটনাশকের মজুত নেই, কীটনাশকের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, কিংবা কীটনাশকের কার্যকারিতা নেই- মশা মরছে না, এমন সব কথা শোনা যায়৷
কীটনাশক নিয়ে অবশ্য এবারও আলোচনা হচ্ছে৷ প্রথমেই আলোচনায় এসেছে নোভালুরন নামের ওষুধটি৷ শুরুতে বলা হয়েছিল, মশা নিয়ন্ত্রণে এটি মারাত্মক কার্যকর৷ যেসকল জলাশয়ে মশা জন্ম নেয়, সেখানকার পানিতে আগে থেকেই নোভালুরন ছড়িয়ে দিতে হবে, ওষুধের প্রভাবে মশার লার্ভাই নষ্ট হয়ে যাবে, ফলে মশার বংশবৃদ্ধি আর সম্ভব হবে না৷ জন্মের আগেই মশা মেরে ফেলার এমন চমকপ্রদ কথা বলে উত্তর সিটি কর্পোরেশন ৪৫ লাখ টাকা খরচ করে ইংল্যান্ড থেকে ৪৮০ কেজি নোভালুরন কিনে নিয়ে আসে৷ তারা দাবি করে, গুলশান, বনানী, উত্তরা, মিরপুর এলাকার বিভিন্ন লেক ও জলাশয়ে তারা এই ওষুধ অক্টোবর মাসেই প্রয়োগ করে৷ জলাশয়ে এই ওষুধের কার্যকারিতা থাকার কথা তিন মাস৷ এই সকল দাবি সত্য হলে পুরো সিটিতে না হলেও অন্তত ওই এলাকাগুলোতে মশার প্রকোপ কম হওয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু বাস্তবে হয়েছে উল্টোটা৷ ওই সকল এলাকা থেকেই মশার বাড়তি উপদ্রবের অভিযোগ পাওয়া গেছে৷ কাজ যখন হলো না, তখন অবশ্য নানা হাইপোথিসিস পাওয়া যাচ্ছে৷ কেউ বলছেন, ওষুধটি ভালো, কিন্তু এটিকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয়নি৷ আবার আরেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, নোভালুরন আমাদের পরিবেশের জন্য উপযোগী নয়, আমাদের পানিতে ময়লা-আবর্জনা বেশি, তাই পানিতে দেওয়ার পর এটি চারদিকে বেশিদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারেনি৷ এর মধ্যে কোন যুক্তি ঠিক তা বলা কঠিন, তবে সাধারণ মানুষের ৪৫ লাখ টাকা যে মোটামুটি জলেই গেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই৷
দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন করেছে আরেক বিচিত্র কাজ৷ আগে থেকেই মশার লার্ভা নিঃশেষ করার লক্ষ্যে তারা রমনা পার্কের লেকসহ বেশ কিছু জলাশয়ে পাতি হাঁস ছেড়ে দিয়েছে৷ কোথাও কোথাও ছেড়েছে তেলাপিয়া মাছ৷ তাদের আশা ছিল, হাঁস ও মাছ মশার সব লার্ভা খেয়ে ফেলবে৷ কিন্তু বাস্তবে তাদের এ আশাবাদ পূর্ণতা পায়নি, ফলে মশাও কিছুমাত্র কমেনি৷ এ ব্যাপারে একজন প্রখ্যাত কীটতত্ত্ববিদ বলেন, লার্ভার ধ্বংসে বিভিন্ন দেশে গাপ্পি মাছ ব্যবহারের উদাহরণ রয়েছে৷ কিন্তু হাঁস ও তেলাপিয়া দিয়ে মশার লার্ভা ধ্বংসের পরিকল্পনা নিতান্তই হাস্যকর৷ হাঁস লার্ভা নয়, শামুক খায়৷ আর তেলাপিয়া মাছ মূলত বটম ফিডার, এরা জলাশয়ের তলদেশের খাবার খেয়ে অভ্যস্ত৷ তবে কর্পোরেশনের মেধাবী কর্তারা মোটেই দমে যাননি৷ এবার তারা মশা নিয়ন্ত্রণে কুনোব্যাং আমদানী ও ব্যবহারের চিন্তা করছেন! পরিকল্পনাটা হচ্ছে- হাজার হাজার কুনোব্যাং নগরীর জলাশয়গুলোতে ছেড়ে দেওয়া হবে আর কর্পোরেশনের নামীদামী কর্তাদের মানসম্মান রক্ষা করতে করতে ব্যাংগুলো অতি আন্তরিকতার সঙ্গে তাদের স্বাভাবিক খাদ্য কীটপতঙ্গ বাদ দিয়ে মশার লার্ভা খেতে থাকবে!
সেদিন কথা হচ্ছিল ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে৷ আজ থেকে ২২/২৩ বছর আগে এই ভদ্রলোকের সঙ্গে যখন প্রথম পরিচয়, তখন থেকেই তাকে চিনি একজন কীটতত্ত্ববিদ হিসাবে৷ কীটপতঙ্গ নিয়ে গবেষণা করতেন, এসব দমন নিয়ে কাজ করতেন৷ এর মাঝে কিছুদিন বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সমিতির সভাপতি হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন৷ মশা এবং এটি দমনে দুই সিটি কর্পোরেশনের তৎপরতার প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি বললেন, "আসলে এদের সকল কার্যক্রম চলছে কমনসেন্সের ওপর ভিত্তি করে৷ একেকবার একেকজন দায়িত্ব পান, পেয়েই কিছু আনাড়ির মতামতের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন৷ এতে অর্থ ও সময়-দুইই নষ্ট হয়, মশা আর কমে না৷”
তিনি বলেন, "মশা নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হলে সেই টিম হতে হবে কীটতত্ত্ববিদদের সমন্বয়ে৷ ডাক্তার, পক্ষীবিশারদ, কিংবা ফিশারিজের লোক দিয়ে হবে না৷ কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, এই কাজের গুরুত্বপূর্ণ যে পদগুলো, তার সবকটিতেই ওই রকম ভিন্ন খাতের লোকজন বসে আছে৷ আর সে কারণেই নানা আবোল-তাবোল প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে, টাকা ব্যয় হচ্ছে, কিন্তু মশা মরছে না৷”
তার মতে, ঢাকা মহানগরকে একেবারে মশামুক্ত করা প্রায় অসম্ভব৷ কিন্তু মশার উপদ্রবকে সহনীয় পর্যায়ে আনা অবশ্যই সম্ভব৷ সেজন্য দরকার লাগসই পরিকল্পনা গ্রহণ, এবং নিয়মিত মশক নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাওয়া৷
এই যে ‘নিয়মিত কাজ করে যাওয়া,' বাস্তবে ঢাকা মহানগরীতে এই বিষয়টারই অভাব সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়৷ দুই সিটি কর্পোরেশনেই কিন্তু মশক নিধন কর্মী হিসাবে কয়েক শ' নিয়মিত কর্মচারী রয়েছেন৷ সেই সঙ্গে আছে খণ্ডকালীন আরো কয়েক শ'৷ কিছু সুপারভাইজারও আছেন৷ সারা বছর এরা কী করেন? মশা মারার জন্য সারা বছরই যে কর্পোরেশনের কাছে ওষুধপত্র মজুদ থাকে তা-ও নয়৷ কেবল মশার মওসুম এলেই ওষুধ সংগ্রহ এবং ছিঁটানোর তোড়জোর শুরু হয়৷ তাই বছরের ওই কয়েকটা মাস এই কর্মী ও তাদের সুপারভাইজারদের আসল কাজে কিছুটা ব্যস্ত থাকতে হয়৷ বাকি সময় তারা বসে বসে কিংবা কর্পোরেশনে অন্য কাজে কিংবা তদবির কর্মে ব্যস্ত থাকেন৷
বিশেষজ্ঞদের মতে, মশা নিয়ন্ত্রণ আসলে সারা বছরের কাজ৷ এর জন্য কামান দাগানোর দরকার নেই, কামান বা গোলাবারুদ কেনারও দরকার নেই৷ জলাশয়গুলোতে বছরজুড়ে সকল এলাকায় নিয়মিত লার্ভিসাইডিং করা হলে, এমনিতেই মশা কমে যাবে৷ আর মওসুমের সময়, বিশেষ করে সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে মার্চের শেষ অব্দি একটু জোরেশোরে অভিযান চালালে নগরবাসী মশার উপদ্রব বলতে গেলে টেরই পাবে না৷ কিন্তু সে কাজটি কখনোই করা হয়নি, এবারও করা হয়নি৷ মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ যখন চিৎকার চেঁচামেচি করে, তখনই মেয়র কমিশনারদের কানে পানি যায়৷ তখন তারা নানা নাটকীয় কর্মকাণ্ড শুরু করেন৷ এখন যা কিছু হচ্ছে সেটা ওই ধারাবাহিক নাটকেরই সাম্প্রতিকতম এপিসোড মাত্র৷
তবে নাগরিকদের অনেকেই কিন্তু এবার অন্যরকম কিছু আশা করেছিল৷ তাদের মধ্যে এই আশাবাদটির জন্ম হয়েছিল, শুরুতে যে কথাটা বলেছিলাম, প্রধানমন্ত্রীর হুশিয়ারি- তারই কারণে৷ লেখার শুরুতেই কৌতূহল প্রকাশ করেছিলাম, প্রধানমন্ত্রীর কথার প্রেক্ষিতে দুই মেয়র আসলে কি ভেবেছিলেন? আমার ধারণা, তারা আসলে প্রধানমন্ত্রীর কথাকে মোটেই সিরিয়াসলি নেননি৷ হয়তো নিতেন, কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভোটের কথাটা বলেই বিষয়টিকে হালকা করে দিয়েছিলেন৷ বলেছিলেন, "মশায় ভোট খেয়ে ফেলবে!” এটা হয় নাকি? বাংলাদেশে তো আরো হয় না৷ এই দেশে ভোট কারা খেয়ে ফেলে সেটা ভোটাররা জানেন, ভোটের নাটকের মাধ্যমে যারা ‘নির্বাচিত' হন, তারা তো আরো বেশি জানেন৷
কাজেই প্রধানমন্ত্রীর হুশিয়ারীকে দুই মেয়র সম্ভবত সেদিন রসিকতা হিসাবেই নিয়েছিলেন৷ আর সেই রসিকতার মূল্য দিতে হচ্ছে জনগণকে৷ শতাধিক কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে, বিচিত্র সব পরীক্ষানিরীক্ষা হচ্ছে, আকাশে ড্রোন উড়ছে, লেকে পাতিহাঁস জলকেলি করছে, কুনোব্যাং আসি আসি করছে, কিন্তু মশার কিছু হচ্ছে না৷ কয়েল, স্প্রে, মশারি ইত্যাদির ব্যবসা হচ্ছে৷ অর্থের লেনদেন বাড়ছে, অর্থনীতি অধিকতর গতি পাচ্ছে৷ আর এসবের বিপরীতে মশা কামড়ে চলেছে, মানুষের অর্থ যাচ্ছে, রক্ত যাচ্ছে৷