ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কাদের পক্ষে যাবে?
৮ অক্টোবর ২০১৮গত সপ্তাহে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সংসদে পাস হওয়া বিলগুলো সম্মতির জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠান৷ সংবিধানের ৮০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদে কোনো বিল গৃহীত হলে তা সম্মতির জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করতে হবে৷ রাষ্ট্রপতি ওই বিলে ১৫ দিনের মধ্যে সম্মতি প্রদান করবেন৷ তিনি চাইলে পুনর্বিবেচনা বা সংশোধনীর বিবেচনা অনুরোধ করে একটি বার্তাসহ সংসদে ফেরত পাঠাতে পারেন৷ তবে সংসদ থেকে আবার ওই বিল রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠালে তিনি ১৫ দিনের মধ্যে সম্মতি না দিলে, সম্মতি দিয়েছেন বলে ধরে নেয়া হবে৷
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে শুরু থেকেই সাংবাদিকসহবিভিন্ন মহলের আপত্তি ছিল৷ আপত্তি ছিল মানবাধিকার সংগঠন ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদেরও৷ এ নিয়ে সম্পাদক পরিষদ, আইনমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী ও সংসদীয় কমিটির সঙ্গে বৈঠক করে কিছু সুপারিশ দেয়৷ কিন্তু সেসব সুপারিশ বিবেচনায় না নিয়েই সংসদে বিলটি পাশ হয়৷ বিলটি পাশ হওয়ার পর সরকারের সংশ্লিষ্ট তিন মন্ত্রী সম্পাদক ও সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে বিষয়টি মন্ত্রিসভায় তোলার কথা বলেন৷
কিন্তু ৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট করে দেন যে, ডিজিটাল আইনে আপাতত কোনো পরিবর্তন আসছে না৷ সংসদ যে বিল পাশ করেছেন, তা-ই আইনে পরিণত হবে৷ তিনি তখন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘যাদের অপরাধী মন, তারাই ডিজিটাল আইন নিয়ে ভয় পায়, তারাই উদ্বিগ্ন৷ অপরাধী মন না থাকলে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই৷ যারা সঠিক সাংবাদিকতা করবেন, তাদের ভয় পওয়ার কোনো কারণ নেই৷ যদি কেউ জঙ্গি তৎপরতা চালায়, তাকে চিহ্নিত করার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করা না গেলে কেমন হবে? ওয়ারেন্টের জন্য অপেক্ষা করলে তো আর তাকে পাওয়া যাবে না৷ আর যারা নির্বাচনের আগে প্রস্তুত হয়ে আছে আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালানোর জন্য, তারা এই আইনে উদ্বিগ্ন৷ সাংবাদিকরা তো উদ্বিগ্ন৷ আমাদের উদ্বেগ কে দেখবে? আমি যতক্ষণ আছি, ততক্ষন সাংবাদিদের কোনো সমস্যা হবে না৷''
গত ২৯ জানুয়ারি ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮'র খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা৷ ৯ এপ্রিল এই আইনের খসড়া সংসদে উত্থাপন করেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার৷ ওইদিনই বিলটি আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়৷ ১৭ সেপ্টেম্বর সংদীয় কমিটি সংসদে প্রতিবেদন জমা দেয়৷ ২০ সেপ্টেম্বর সংসদে বিলটি পাশ হয়৷
সংসদীয় কমিটিতে সম্পাদক পরিষদ প্রস্তাবিত ডিজিটাল আইনের ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ধারার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল৷ ৩২ ধারা নিয়ে সাংবাদিকদের সবচেয়ে বেশি আপত্তি ছিল৷ প্রস্তাবিত আইনের ওই ধারায় সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের তথ্য-উপাত্ত, যেকোনো ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে এবং এ অপরাধে ১৪ বছর কারাদণ্ড ও ২৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছিল৷
এটা পরিবর্তন করে আইনে বলা হয়েছে, ‘‘যদি কোনো ব্যক্তি ‘দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন-১৯২৩' এর আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত করে বা করতে সহায়তা করে, তাহলে তিনি সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷''
এই আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধের অধিকাংশই জামিন অযোগ্য৷ আর পুলিশকে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে৷
আইনে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেয়ার পর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘‘দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন আরো চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য সকল আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে৷ এর অংশ হিসেবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যক্রর করা হয়েছে৷ দেশের সব মানুষকে এর বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা এই সরকারের কোনো আইন মানি না৷ কারণ, যে সংসদ তা পাশ করেছে, তাদের বৈধতা নেই৷ এটি একটি প্রতারক সরকার৷''
বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন দৈনিক ‘সংবাদ'-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ডিজিটাল আইন কার্যকর হওয়ার ফলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাসহ পুরো সাংবাদিকতাই বাধার মুখে পড়বে৷ মুক্ত সাংবাদিকতার সামনে সব সময়ই একটা খড়গ ঝুলতে থাকবে৷ এটা কখনোই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য ভালো না৷ বাস্তবে আর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা থাকবে না৷ এর ফলে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা থাকবে না৷ দুর্নীতি সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশ অসম্ভব হয়ে পড়বে৷ অনিয়ম নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা অসম্ভব হয়ে যাবে৷ ফলে যারা দুর্নীতিবাজ আছে, যারা অনিয়ম করছে, যারা ব্যাংক লুট করছে, তাদের সম্পর্কে রিপোর্ট করা না গেলে, এখনই তারা বেপরেয়া, তারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে৷ একটা লুটপাটের রাজত্ব তৈরি হবে৷''
এত আশঙ্কার পরও সরকার এই আইনে সংশোধনী কেন আনলো না- এ বিষয়ে তাঁর ধারণা জানাতে বললে তিনি বলেন, ‘‘আমার কাছে মনে হয়েছে তিনটি কারণে এই আইন করা হয়েছে৷ প্রথমত, দুর্নীতির বিষয়গুলো প্রকাশ হতে না দেয়া, যাতে সরকারের ইমেজ বজায় থাকে বা ক্ষুন্ন না হয়৷ দ্বিতীয়ত, গুম. নিখোঁজ, হত্যা, বিচার বহির্ভূত হত্যা নিয়ে সাংবাদিকরা রিপোর্ট করেন৷ এখন সরকার যে আইন করেছে তাতে অকাট্য প্রমাণ ছাড়া এগুলো লেখা যাবে না৷ এখন অকাট্য প্রমান রেখে কেউ খুনও করে না, কেউ এনকাউন্টারও করে না, কেউ কাউকে মারে না৷ দুর্নীতিও কেউ প্রমাণ রেখে করে না৷ সুতরাং, প্রমাণও সংগ্রহ করা যাবে না, কিছু লেখাও যাবে না৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেভাবে বলেছেন, সকলেরই মান সম্মন আছে, এদেরও মান-সম্মান রক্ষা হবে৷ আর তৃতীয় কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে যে, নির্বাচন সামনে৷ সাংবাদিকরা সরকারের সাফল্যগুলো লিখবে৷ আবার যেখানে ব্যর্থতা আছে, প্রতিশ্রতি ভঙ্গ আছে, অনিয়ম আছে, তা-ও লিখবে৷ আমলারা, মন্ত্রীরা যেখানে যেখানে অনিয়ম করেছে সেগুলোও লিখবে৷ সেগুলো লেখা থেকে বিরত রাখাও এই আইনের উদ্দেশ্য বলে আমার মনে হয়৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘সাইবার ক্রাইমের বিরুদ্ধে আইন হওয়া উচিত৷ কিন্তু সেই আইন যদি সংবিধানে দেয়া স্বাধীন সাংবাদিকতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে কন্ঠরোধ করে, তাহলে তা দিয়ে সাইবার অপরাধ দমন হবে না৷কন্ঠরোধই হবে৷ আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় যেমন ডিজিটাল অপরাধীদের কন্ঠরোধ হয়নি, কন্ঠরোধ হয়েছে স্বাধীন সাংবাদিকতার, কন্ঠরোধ হয়েছে সংখ্যালঘুদের৷ সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হয়েছে, হামলার শিকার হয়েছে৷ যে উদ্দেশ্যে ওই আইনটি করা হয়েছিল, ফল হয়েছে উলটো৷ ডিজিটাল আইনেও তাই হবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘এই যে অফিশিয়াল সিক্রেটস আইন, যেটা ডিজিটাল আইনে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, এটা ঔপনিবেশিক শক্তি নিজেদের রক্ষায় করেছিল৷ সারা দুনিয়ায় এ ধরনের আইন এখন পরিত্যক্ত, বাতিল৷ সেই আইন আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে সরকারি প্রশাসনের অনিয়ম. দুর্নীতি রক্ষা করার জন্য৷''
আর মানবাধিকার কর্মী এবং মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মানুষ কিভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছে, আমরা তা দেখেছি৷ এই আইনে আরো বেশি নিপীড়নের আশঙ্কা করছি৷ এই আইনে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেয়ার পর মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতির সঞ্চার হয়েছে৷ সবার আবেদন, আশা উপেক্ষা করে এই আইনটি পাশ করা হয়েছে৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যতই বলুন না কেন যে, যারা অপরাধ করবে না তাদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই, কিন্তু ডিজিটাল আইনটি যারা প্রয়োগ করবেন, তারা যে-কোনো মানুষকে হয়রানি করতে পারবেন৷ ৫৭ ধারায়ও তাই হয়েছে৷ ডিজিটাল আইন আরো খারাপ হবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘ভয়ার্ত পরিবশ সৃষ্টি হবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ কথা বলতে ভয় পাবে৷ প্রতিবাদ করার সাহস হারাবে৷ খবর প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হবে৷''
তিনি মনে করেন, ‘‘আর আগামী নির্বাচনে এই আইনের একটা প্রভাব পড়বে৷ সে কারণেই হয়তো আইনটি নির্বাচনের আগে তড়িঘড়ি করে পাশ করা হয়েছে৷''