জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাবার চাপিয়ে দেয়া হয়েছে
৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ডয়চে ভেলে: জেনেটিক্যালি মডিফাইড পদ্ধতিতে খাদ্য উৎপাদন কেমন?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাবারের ব্যাপারে বিশ্বে খুবই বিতর্ক রয়েছে৷ বিতর্ক এ কারণে যে, জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্য মানবদেহে কী ধরনের ক্ষতি করতে পারে, সে সম্পর্কে আমরা এখনও অবগত না৷ একটা জিন আরেকটার মধ্যে ঢুকে কখন, কীভাবে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, তা আমরা জানি না৷ জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্য নিয়ে বিশ্বে যে বিতর্ক রয়েছে, তার কারণ বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই এটাকে নেতিবাচকভাবে দেখেন৷
বিজ্ঞান ও গবেষণা এই পদ্ধতি সম্পর্কে কী বলছে?
বিজ্ঞানীরা এক্ষেত্রে বিভক্ত৷ যেসব কোম্পানি অ্যাগ্রোকেমিক্যাল প্রোডাক্ট তৈরি করে, তাদের সঙ্গে যেসব বিজ্ঞানী কাজ করেন, তাঁরা বলেন জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাবার একেবারেই নিরাপদ৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাবার আর ননজেনেটিক্যালি মডিফাইড খাবারের কোনো তফাৎ করে না৷ কিন্তু ইউরোপে জেনেটিক্যালি মডিফাইড ফুড এবং ফিড অনেকদিন ধরে নিষিদ্ধ ছিল৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে আফ্রিকা এবং আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তানও জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাবারের ব্যাপারে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে৷ তারা বলছে, যতক্ষণ না বিজ্ঞান এটাকে একেবারে নিরাপদ বলছে, ততক্ষণ এটার অনুমতি দেওয়া যাবে না৷
এই পদ্ধতিতে তৈরি খাবার খেলে মূলত কী ধরনের রোগ হতে পারে?
যখন ইউরোপে ম্যাডকাউ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়, তখন বলা হচ্ছিল, আক্রান্ত গরুগুলো জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাবার খেয়েছে৷ তারা নাকি পাগলামি করছিল৷ আর যে গরুগুলো আক্রান্ত হয়নি বা পাগলামি করছিল না, সেগুলো জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাবার খায়নি৷ এই দু'ধরনের গরুর মধ্যে একটাই পার্থক্য ছিল – খাদ্যাভ্যাস৷ এই গরুগুলোর এক ধরনের প্রদাহ এবং প্রজনন ক্ষমতায় এর প্রভাব পড়ার কথাও বলা হয়েছিল৷
আপনি এই পদ্ধতিতে খাবারের পক্ষে, না বিপক্ষে?
আমি অবশ্যই এই পদ্ধতির খাবারের বিরুদ্ধে৷
তার কারণ কী?
কারণ হচ্ছে, এই পদ্ধতির বিরুদ্ধে যুক্তিগুলো৷ এই পদ্ধতি ব্যবহার করলে ফসল একটা বা দু'টো পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়৷ যেমন বেগুনের কথাই বলি – আমি কেন এই বেগুন খাবো না? কারণ এই বেগুনের মধ্যে যে জিনটা দেওয়া হয়েছে, সেটা ন্যাচারাল জিন না৷ ফলে এই জিনের কারণে ঐ বেগুন পরবর্তীতে কী ধরনের পরাগায়নে ভূমিকা রাখবে, সেটা আমরা জানি না৷ এই বেগুনটা যখন আমি খাবো, তখন আমার শরীরে সেটা কী ধরনের প্রভাব ফেলবে সেটাও আমি জানি না৷
আমাদের দেশে কি জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাবার উৎপাদন হয়?
আমাদের দেশে সরকার গত তিন বছর ধরে জেনেটিক্যালি মডিফাইড পদ্ধতিতে একটি বেগুনের বাণিজ্যিক চাষাবাদের অনুমতি দিয়েছে৷ বাংলাদেশ, ভারত ও ফিলিপাইন্স যৌথভাবে গবেষণা করেছে৷ ভারত ও ফিলিপাইন্স এটা পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছে৷ এটা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয় – এটা প্রমাণ করতে যে পরিমাণ গবেষণা হওয়া দরকার, সেটা করা হয়নি৷ এছাড়া যে সমস্ত দেশ তাদের গবেষণার ভিত্তিতে এটা বাতিল করেছে, বাংলাদেশ সেই সমস্ত দেশের গবেষণার সারপত্রের উপর ভিত্তি করেই এটার অনুমোদন দিচ্ছে৷ ফলে এখন বাংলাদেশে জেনেটিক্যালি মডিফাইড বেগুনের চাষ হচ্ছে বলে সরকার দাবি করলেও আমি খুব একটা দেখিনি৷ সরকার প্রথম দফায় ২০ জন কৃষককে অনুমোদন দিয়েছে৷ এর মধ্যে ১৮ জন কৃষক মার খেয়েছে৷ এরপর সরকার ঘটা করে ১০০ জনকে দিয়েছে৷ তারও পরের দফায় সরকার দাবি করেছে যে, ১ হাজার জনকে এই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু চারা নিয়ে গিয়ে কৃষকরা চাষাবাদ করছেন কিনা, তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে৷
আমাদের যে বিচি বেগুনের চাষাবাদ শুরু হয়েছে, সেটার রেজাল্ট কী?
প্রথম দু'বছর আমরা মনিটরিং করেছি৷ তখন সংখ্যা ছিল ২০ জন এবং ১০০ জন৷ প্রথম দফার ২০ জনের ১৮ জনই মার খেয়েছে৷ একজন বলেছেন তাঁর ভালো ফলন হয়েছে৷ তবে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণে তিনি ভালোভাবে বিক্রি করতে পারেননি৷ তারপরের ১০০ জনের অধিকাংশই বলেছেন যে, তাঁরা সরকারের কাছ থেকে চারা নিলেও চাষাবাদ করেননি৷ এরপর সরকার যে ১ হাজারের কাছে চারা দিয়েছে তাঁদের তালিকা আমরা চেয়েছি৷ কিন্তু সরকার আমাদের সেই তালিকা দেয়নি৷ এ থেকে আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে, সরকার মুখে বলছে এর চাষাবাদ হচ্ছে৷ কিন্তু আমাদের কাছে যে তথ্য, তাতে এর বাণিজ্যিক কোনো চাষাবাদ হচ্ছে না৷
এই বেগুন নিয়ে আপনারা কি কোনো গবেষণা করেছেন?
এটা করা তো আর আমাদের কাজ নয়৷ তবে আমরা জেনেছি, যে মিটিং থেকে সরকার এই বিচি বেগুনের অনুমোদন দিয়েছে, সেই মিটিংয়ে বসেই অনেক সরকারি কর্মকর্তা এর প্রতিবাদ করেছেন৷ কৃষি মন্ত্রণালয় গায়ের জোরেই এই প্রস্তাবটি পাশ করিয়ে নিয়েছে৷ আমাদের আগে ভারত ও ফিলিপাইন্সে এটা নিয়ে গবেষণা হয়েছে৷ তারা তো বলেই দিয়েছে যে, এটা নিয়ে যে পরিমাণ গবেষণা হওয়া দরকার সেটা হয়নি৷
বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বারি-র সঙ্গে জেনেটিক্যালি মডিফাইড জায়ান্ট কোম্পানি মনসান্টোর চুক্তিটা কতটা যুক্তিসঙ্গত?
এটা একেবারেই যুক্তিযুক্ত নয়৷ আপনি যদি জীববৈচিত্র সংক্রান্ত আইনটা পড়েন, তাহলে দেখতে পাবেন যে, আপনি যদি কমিউনিটির মানুষকে কাজে লাগান, তাহলে তাঁদের সবাইকে বিষয়টা আগে জানাতে হবে৷ তাঁদের মতামত নেবেন৷ সরকারের একটা মেকানিজম থাকতে হয়৷ আমাদের তো চার প্রজাতির বেগুনের মধ্যে এটা ঢোকানো হয়েছে৷ কনভেনশন অফ বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটির (সিবিডি) মধ্যে একটা মোডারিটি সরকারকে ঠিক করতে হয়৷ কোনো দেশ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ নিতে চাইলে আবেদন করবে৷ এর কোনো কিছুই করা হয়নি৷ ফলে এর অনুমোদনটাই আমার বিবেচনায় অবৈধ৷ সিবিডিতে আরো বলা হয়েছে যে, আমার বেগুন নিয়ে যদি কেউ গবেষণা করে এবং সেটার যদি বাণিজ্যিক চাষাবাদ হয়, তাহলে লাভের অংশ ভাগাভাগি করা হবে৷ চুক্তির সবচেয়ে খারাপ দিক হলো এই জিনটার মালিকানা দাবি করে মনসান্টো৷ আপনার বেগুনটার মধ্যে যখন মনসান্টোর জিন ঢুকে যায়, তখন এর মালিকানা কিন্তু আর আপনার না৷ তখন এটার মালিকানা মনসান্টো দাবি করতে পারে৷
এটা নিয়ে এই মুহূর্তে তাহলে বাংলাদেশের অবস্থান কী?
বাংলাদেশের এই মুহূর্তে অবস্থান হলো, তারা জেনেটিক্যালি মডিফাইড ধান আনবে, আলু আনবে৷ আর বেগুন তো চালু করেছেই৷ আমাদের সরকার এই মুহূর্তে অত্যন্ত ভ্রান্ত একটা অবস্থান নিয়েছে জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাদ্যের ব্যাপারে৷ সরকার যেটা করছে তা প্রতিবেশী দেশ থেকে বারবার প্রত্যাখান করা হয়েছে৷ এটা জনগণের সঙ্গে আলোচনা না করেই করা হয়েছে৷ আমি এর তীব্র বিরোধিতা করি৷ এর কোনো যৌক্তিক ভিত্তি আছে বলে আমি মনে করি না৷ আপনি যদি কাটাহেনা প্রটোকল দেখেন, তাহলে দেখবেন যে সেখানে জেনেটিক্যালি মডিফাইড খাবারের লেভেলিংয়ের বিধান রাখা হয়েছে৷ আমাদের সরকারের আইনেও লেভেলিংয়ের বিধান রাখা হয়েছে৷ এটা আইনগতভাবেও সমর্থনযোগ্য না৷ শেষ কথা হলো – সরকার আমাদের কী খাওয়াচ্ছে সেটাও আমাদের জানানো হচ্ছে না৷
আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷