জীবের উপর নয়
১০ মে ২০১৪জার্মানির একদল গবেষক জীবজন্তুর পরিবর্তে মানবকোষ, অর্থাৎ ‘সেল কালচারের' উপর রাসায়নিকের প্রভাব পরীক্ষা করার পন্থা আবিষ্কার করেছেন৷
মাতৃগর্ভেই শিশু ডায়ক্সিন, পারদ, আর্সেনিক কিংবা পরিবেশের অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে আসে৷ এর মধ্যে কোন পদার্থগুলি ভ্রূণের মস্তিষ্কের বিকাশের পক্ষে ক্ষতিকর, এবং মাতৃদেহে সেই বিষের অনুপাত কোন পর্যায়ে পৌঁছলে তা ক্ষতিকর হয়ে ওঠে, সাধারণত জীবজন্তুর উপরেই তা পরীক্ষা করে দেখা হয়৷ কিন্তু জীবজন্তুদের উপর পরীক্ষা করা নিয়ে যেমন নৈতিক দ্বিধা রয়েছে, তেমনই সে পরীক্ষার ফলাফল সবসময়ে মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না৷
নতুন প্রক্রিয়া
জার্মানির হানোফার শহরের ভেটারিনারি কলেজে জীববিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গ্যার্ড বিকার-এর নেতৃত্বে একদল গবেষক কোষ পরীক্ষার একটি নতুন প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছেন৷ মানব মস্তিষ্কের উপর, বিশেষ করে শিশুদের মস্তিষ্কের উপর বিভিন্ন রাসায়নিক কী ধরনের প্রভাব ফেলে, প্রক্রিয়াটিতে স্নায়ুকোষ ব্যবহার করে তা সিমিউলেট, অর্থাৎ অনুকরণ করে দেখা হয়৷ জীবজন্তুর উপর পরীক্ষা করার আর কোনো দরকার পড়ে না৷ প্রফেসর বিকার বলেন, ‘‘জীবজন্তুর উপর পরীক্ষা না করার একটা বড় সুবিধে, জীবজন্তু পালতে হয় না৷ অর্থনৈতিক সাশ্রয়ের সঙ্গে রয়েছে নৈতিক দিকটা: পরে ঐ সব জীবজন্তুর দেহে বিষক্রিয়া পরীক্ষা করতে হবে না৷ শেষমেষ বিশ্লেষণের জন্য ঐ সব জীবজন্তুকে মেরেও ফেলতে হবে না৷''
গবেষকরা মানবকোষ কালচার করে তার স্নায়ুকোষে পরিবর্তন করেন৷ প্রফেসর বিকারের ভাষ্যে, ‘‘প্রক্রিয়াটা এক নয়, একাধিক৷ প্রক্রিয়াগুলি এমনভাবে সৃষ্ট যে তাতে মস্তিষ্কের বিকাশের বিভিন্ন পর্যায় প্রতিফলিত হয়, যেমন কোষ বিভাজন, সেল মাইগ্রেশন, নয়রাইটের বৃদ্ধি এবং শেষমেষ একটি কর্মক্ষম নিউরন নেটওয়ার্কের সৃষ্টি৷''
বিষক্রিয়া
বাড়ন্ত স্নায়ুকোষের পক্ষে কোন পদার্থ ক্ষতিকর, তা পরীক্ষা করার জন্য গবেষকরা বিভিন্ন পর্যায়ের সেল কালচারগুলিতে নানা বিষাক্ত পদার্থ যোগ করে থাকেন৷ এ ভাবে তারা দেখতে পান, ঐ বিষ প্রধানত মস্তিষ্কের কোষগুলির ‘অভিবাসনে' ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে, নাকি পূর্ণাঙ্গ স্নায়ুকোষগুলির পারস্পরিক যোগাযোগে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে৷ বিষের পরিমাণ বেশি হলে স্নায়ুকোষগুলি মরে যায়৷ প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে শিশুদের বাড়ন্ত স্নায়ুকোষগুলি আরো বেশিভাবে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷
দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা থেকে দেখা গেছে, কম পরিমাণ বিষ প্রাপ্তবয়স্কদের স্নায়ুকোষগুলিকে মেরে ফেলতে পারে না বটে, কিন্তু তা মাতৃগর্ভে শিশুর মস্তিষ্কে প্রাক-স্নায়ুকোষ পর্যায়ের কোষগুলির পূর্ণাঙ্গ স্নায়ুকোষে পরিণত হওয়া থেকে বিরত করে৷
গবেষকরা আগামীতে নিউরাইট নেটওয়ার্ক বিকাশের প্রক্রিয়াটা আরো খুঁটিয়ে দেখতে চান৷ স্নায়ুকোষের দৈর্ঘ্যই কি সংশ্লিষ্ট পদার্থটির বিষক্রিয়ার পরিচয় দেয়? যতো জোরালো বিষ, ততোই ছোট হবে স্নায়ুকোষের দৈর্ঘ্য – এই হল গবেষকদের বিশ্বাস৷ এছাড়া সেল কালচারের আরো একটি সুবিধা আছে, স্মরণ করিয়ে দিলেন প্রফেসর বিকার৷ তিনি বললেন, ‘‘এই প্রক্রিয়ার মজাটা হল এই যে, আমরা তো বাস্তবিক মানবদেহের স্নায়ুকোষ ব্যবহার করছি৷ অর্থাৎ এক প্রজাতির জীব থেকে আরেক প্রজাতির জীবের যে ফারাক, পরীক্ষার ফলাফলে সেই তফাতটা বিবেচনা করতে হচ্ছে না৷ আমার আরো যেটা ভালো লাগে, সেটা হল, আমরা সরাসরি দেখতে পাচ্ছি, স্নায়ুকোষের উপর রাসায়নিকের কী প্রভাব পড়ে৷''
এই সেল কালচার পরীক্ষা থেকে ভবিষ্যতে আরো দ্রুত এবং সহজ পদ্ধতিতে বিষাক্ত রাসায়নিকগুলি শনাক্ত করা সম্ভব হবে – যে সব রাসায়নিক মাতৃগর্ভে শিশুর ক্ষতি করতে পরে, যেগুলো থেকে ক্যানসার হতে পারে৷ কাজেই জীবজন্তুর উপরে পরীক্ষা করার আর কোনো প্রয়োজন নেই৷