জার্মানিতে লুট করা শিল্পসামগ্রী
১৫ জানুয়ারি ২০১৪বেশ কিছু মিউজিয়ামের সমাহার বার্লিনের জাদুঘর দ্বীপটি বিশ্ব খ্যাত৷ ঠিক তার বিপরীতে ২০১৯ সালে যাত্রা শুরু করবে ‘হুমবোল্ট ফোরাম'৷ শোনা যাচ্ছে, শহরের এক প্রান্তে থাকা এথনোগ্র্যাফিক মিউজিয়াম বা মানবসভ্যতার বিবর্তন বিষয়ক সংগ্রহশালাটি স্থানান্তর করা হবে এই হুমবোল্ট ফোরামে৷ এটাই হবে তখন এই জাদুঘর দ্বীপের মূল আকর্ষণ৷ তবে বার্লিনের একটি জোটবদ্ধ উদ্যোগ ‘নো হুমবল্ট ২১'-এর তথ্য অনুযায়ী, সংগ্রহশালার বেশিরভাগ জিনিসই নাকি বিভিন্ন উপনিবেশ থেকে লুট করে আনা৷
লুট করা শিল্পের এক বিরাট ভাণ্ডার
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইয়োশুয়া আইকিন্স বলেন, ‘‘আমরা লুট করা শিল্পের এক বিরাট ভাণ্ডার এখানে লক্ষ্য করেছি৷'' এই সংগ্রহশালার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ এসেছে জার্মানির প্রাক্তন উপনিবেশ ক্যামেরুন থেকে৷ ঔপনিবেশিক আমলে অনেক কিছু ধ্বংস করা হয়েছে, এ কথা ঠিক৷ তবে এখানকার অসংখ্য জিনিস সহিংসতা ছাড়াই, যেমন উপহার হিসাবে, দাম দিয়ে বা বদলাবদলি করে আনা হয়েছে৷ ‘‘কিন্তু যেখানে ঔপনিবেশিক শাসকরাই ছিলেন হর্তাকর্তা, সেখানে বদলাবদলির তো প্রশ্নই ওঠে না৷ প্রায় ক্ষেত্রেই চৌর্যবৃত্তি কিংবা হুমকি বা লুট করে আনা হয়েছিল জিনিসগুলি'', বলেন ইতিহাসবিদ ক্রিস্টিয়ান কপ৷
বিষয়টি নাৎসি আমলের পুরানো সেই নেতিবাচক স্মৃতি জাগিয়ে তোলে: নাৎসি আমলে ইহুদিদের সম্পদ হিসাবে অনেক শিল্পসামগ্রী বাজেয়াপ্ত করা হয়৷ সেগুলি পরবর্তীকালে স্থান পায় জার্মান জাদুঘরগুলিতে৷
কয়েক দশকেও ঐ সব জিনিসের প্রকৃত মালিকের খোঁজ-খবর নেওয়ার ব্যাপারে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি৷ পরে অবশ্য, তা অনের দেরিতে হলেও এসব শিল্পকর্মের উৎপত্তি সম্পর্কে গবেষণার উদ্যোগ নেওয়া হয়, বিনিয়োগ করা হয় অর্থ৷ কিন্তু ঔপনিবেশিক আমলে আফ্রিকা থেকে আনা শিল্পসামগ্রীগুলির ব্যাপারে তেমন গরজই লক্ষ্য করা যায় না৷ অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রশক্তির নিয়ে যাওয়া জিনিসগুলি ফেরত দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে এবং হচ্ছে জার্মানির উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকেও৷
রাজা নোয়ার মুক্তা খঁচিত মুকুট
বার্লিনের এথনোগ্র্যাফিক মিউজিয়ামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটি হলো ক্যামেরুন থেকে আনা রাজা নোয়ার মুক্তা খঁচিত মুকুটটি৷
সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, এটা ১৯০৮ সালে রাজার তরফ থেকে দ্বিতীয় কাইজার ভিলহেল্মকে দেওয়া একটি উপহার৷ কিন্তু গবেষণায় জানা গেছে যে, এই উপহারের পেছনে কাজ করেছে প্রচণ্ড রাজনৈতিক চাপ৷ রাজা নোয়াকে ঔপনিবেশিক আমলে জার্মানদের সঙ্গে একত্রে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়৷ আর সে কারণেই তিনি উপহারের মাধ্যমে মর্যাদাপূর্ণ একটা সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করেন৷
ক্যামেরুন থেকে অবশ্য সরকারিভাবে মুকুটটিকে ফেরত চাওয়া হয়নি৷ বলা হয়েছে, এটা বার্লিনেই থাকতে পারে৷ এই রকমটাই জানিয়েছেন আজকের বামুম সুলতান৷ তবে ক্যামেরুনের কয়েকজন বুদ্ধিজীবী এটা মেনে নিতে নারাজ৷ এটাকে চৌর্যবৃত্তি বলে উল্লেখ করছেন লেখক প্যাটরিস গানান৷ তিনি ক্যামেরুনের ঔপনিবেশিক আমল নিয়ে গবেষণা করছেন৷ তাঁর মতে, ‘‘এই উপহারপ্রদান প্রতারণামূলক পরিস্থিতিতে ঘটেছিল৷''
বিভিন্ন জাতির আত্মনির্ধারণের অধিকার
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক প্রফেসর ইমানুয়েল পোন্ডি এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের চার্টারের প্রতি দৃষ্টি আকর্যণ করে বিভিন্ন জাতির আত্মনির্ধারণের অধিকারের কথা বলেন৷ এতে উত্তরাধিকারের বিষয়টিও রয়েছে৷ এই কারণে বলা যায় যে, এই শিল্প সামগ্রীগুলি জার্মানি, ফ্রান্স কিংবা যুক্তরাজ্যের নিজস্ব জিনিস নয়৷ তাই এগুলি তাদের আয়ত্তে রাখাও আইনসিদ্ধ নয়৷
মুকুট কিংবা দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিস, মাস্ক কিংবা ভাস্কর্য – যাই হোক না কেন, ইউরোপীয় এথনোগ্র্যাফিক মিউজিয়ামগুলি যে সব জিনিস পেয়ে থাকে, প্রায়শই সেগুলি ঔপনিবেশিক আমলের এবং আফ্রিকা থেকে আনা৷
সে সময়কার ইউরোপীয়ান ঔপনিবেশিক শক্তিদের আরোপিত আইন অনুযায়ী বিষয়টি আইনসিদ্ধও বটে৷ তাছাড়া আজও এটা বেআইনি নয়৷ বলেন ‘প্রাশিয়ান কালচারাল হেরিটেজ ফাউন্ডেশন'-এর বিশেষজ্ঞরা৷
বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন ‘আন্তর্জাতিক মিউজিয়াম কাউন্সিল'-এর নীতি-নির্ধারণ কমিটির সদস্যরাও৷ যথাযথভাবে দেখলে জিনিসগুলি সে সময়ের আইন অনুযায়ী বৈধভাবেই কলোনিগুলি থেকে ইউরোপে আনা হয়েছিল৷ বলেন এই কমিটির প্রেসিডেন্ট মার্টিন শ্যাফার৷
এই প্রেক্ষাপটে যে সব দেশ থেকে সংগ্রহশালার জিনিসগুলি আনা হয়েছে, মিউজিয়ামগুলি সেসব দেশের সহকর্মীদের সঙ্গে সহযোগিতামূলক কাজকর্ম করতে ইচ্ছুক৷ এর মধ্য রয়েছে বিষয়টি নিয়ে গবেষণামূলক কাজকে আরো জোরদার করা ও পারস্পরিক সহযোগিতামূলক প্রদর্শনীর আয়োজন করা৷ বার্লিনে ৩০০টি ব্রোঞ্জের জিনিস রয়েছে, যেগুলি নাইজেরিয়ার শহর বেনিন থেকে আনা৷ ১৮৯৭ সালে বৃটিশ সেনাবাহিনী কর্তৃক এগুলি লুট করা হয় এবং শিল্প বাজারে নিয়ে আসা হয়৷
সহযোগিতামূলক কর্মসূচি
মানবসভ্যতার বিবর্তন বিষয়ক এই জাদুঘরের আফ্রিকা শাখার প্রধান জানান, ‘‘নাইজেরিয়ার প্রতিনিধিদের সাথে আমরা একমতে পৌঁছেছি যে, জিনিসগুলির বৈধতা নিয়ে আর আলোচনা করা হবে না, কেননা এর কোনো শেষ নেই৷ আমরা পরিকল্পনা করেছি, নাইজেরিয়ার প্রদর্শনীতেও এগুলি দেখানো হবে৷ ব্রোঞ্জের জিনিসগুলির উৎস সুস্পষ্টভাবে নথিভুক্ত করা আছে৷ সেজন্য সহযোগিতামূলক কর্মসূচিটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব৷ তবে খুব অল্পসংখ্যক সামগ্রীর ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য৷ অর্থাৎ, এগুলির উৎস সম্পর্কে প্রামাণ্য দলিলপত্র নেই৷
মাঝেমধ্যে অবশ্য মিউজিয়ামের জিনিসগুলি প্রকৃত মালিককে ফেরত দেওয়া হয়৷ যেমন বার্লিনের এথনোগ্রাফিক মিউজিয়াম থেকে ২০০৩ সালে আধ্যাত্মিক দিকে দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘বার্ড ফিগারটি' ফেরত পেয়েছে জিম্বাবোয়ে ৷
তবে ‘নো হুমবোল্ট ২১' উদ্যোগটি মনে করে, এটাই যথেষ্ট নয়৷ তারা ‘প্রাশিয়ান কালচারাল হেরিটেজ ফাউন্ডেশন'-কে চাপ দিচ্ছে, সংগ্রহশালার জিনিসগুলির উৎপত্তি সম্পর্কে গবেষণা করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বিনিয়োগ করতে এবং বিষয়টিতে স্বচ্ছতা আনতে৷