জার্মানি-বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্পর্কে উন্নতির ধারা অব্যাহত
৭ মে ২০১৯বাংলাদেশে নানা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও বহির্বিশ্বে বাংলদেশের রপ্তানি বাণিজ্য বিগত দশ বছরে ক্রমশই বাড়ছে৷ ইউরোপ, তথা জার্মানি এখন বাংলদেশের অন্যতম রপ্তানি বাজার৷
জার্মানির পররাষ্ট মন্ত্রনালয়ের একটি সুত্র বলছে, এই মুর্হূতে বাংলাদেশের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি বাজার হচ্ছে জার্মানি৷ বিগত বছরগুলিতে জার্মানির সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের আয়তন ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে৷ ২০১৭ সালে যা সর্বমোট ৬৮০ কোটি ইউরোতে পৌঁছায়৷ বাংলাদেশ প্রায় ৫৪০ কোটি ইউরো মূল্যমানের পণ্য জার্মানিতে রপ্তানি করেছে আর জার্মানি থেকে বাংলাদেশ আমদানি করছে ৭০ কোটি ইউরো মূল্যমানের পণ্য৷ বাংলাদেশ থেকে জার্মানিতে রপ্তানি করা পণ্যের ৯০ শতাংশই হলো টেক্সটাইল সামগ্রী৷ এর বাইরে রয়েছে হিমায়িত খাবার এবং চামড়াজাত পণ্য৷ বাংলাদেশ জার্মানি থেকে আমদানি করেছে প্রধানত যন্ত্রপাতি ৫৫ শতাংশ এবং রাসায়নিক সামগ্রী ২০ শতাংশ এবং ইলেকট্রনিক পণ্য ৯ শতাংশ৷ এছাড়া জার্মান জাহাজ মালিকরা বহু বছর ধরে বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণ করছেন৷এ তো গেল জার্মানি-বাংলাদেশ বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে জার্মানির পররাষ্ট মন্ত্রনালয়ের বয়ান৷
অন্যদকে জার্মান সরকারের অধীনস্হ,জার্মানি ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্ট – কোম্পানি কী বলছে,এই দুটি দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে? তারা বাংলাদেশের অর্থনীতি বিষয়ে ২০১৮ সালে জানিয়েছে, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ক্রমশই বেড়ে চলেছে৷ বাংলাদেশ সরকার তার অর্থনৈতিক উন্নয়নকে আরো গতিশীল করতে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দুর্বল কাঠামোগুলিকে চিহ্নিত করে নতুন অবকাঠামো তৈরির দিকে দৃষ্টি দিয়েছে৷ অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য জ্বালানি ও যোগাযোগ ব্যবস্হার উন্নয়ন করেছে৷ ঢাকার পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে জার্মানি ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্ট জানিয়েছে, ২০১৭-১৮ অর্থনৈতিক বছরে বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের হার (জিডিপি) ৭ দশমিক ৭ শতাংশ৷ এই প্রবৃদ্ধির বিষয়ে ইতিপূর্বেই অর্থনীতিক বিশ্লেষকরা যে ধারণা পোষণ করেছিলেন, তার তুলনায় প্রবৃদ্ধি বেড়েছে আরো বেশি৷ বাংলাদেশ যে নতুন অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়ে তুলছে, তা দিয়ে দেশটি ২০২১ সাল নাগাদ মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে৷ এই লক্ষ্যমাত্রা যদি সত্যিই অর্জিত হয়, তবে বাংলাদেশ অচিরেই নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে বলে মনে করে জার্মানি ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্ট৷
বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশের পাশাপাশি আমরা লক্ষ্য করেছি, জার্মানি ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যের আয়তনও ক্রমশ বেড়েছে৷ তবে যে কথা উল্লেখ না করলেই নয়, জার্মানির অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধির হারও বিগত পাঁচ বছরে ক্রমশই বেড়েছে৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮ টি সদস্য দেশের মধ্যে অনেক দেশে যখন অর্থনেতিক মন্দা ও বেকারত্বের হার বেড়েছে, তখন জার্মানির অর্থনীতি আরো সমৃদ্ধ হয়েছে৷
জার্মানি একটি উন্নত সামাজিক বাজার অর্থনীতির দেশ৷ ইউরোপের সর্ব বৃহৎ জাতীয় অর্থনীত এবং বিশ্বে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি সূচকে জার্মানির স্থান পঞ্চম৷ ২০১৬ সালে সারা বিশ্বের মধ্যে জার্মানি তার রপ্তানি বাণিজ্যে রেকর্ড পরিমাণ আয় করে৷ সে বছর জার্মানির রপ্তানি বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত ছিল ৩১০ বিলিয়ন ডলার৷ বিশ্ব রপ্তানি বাজারে জার্মানির অবস্হান তৃতীয়৷
২০১৮ সালের মে মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল তাদের দেশভিত্তিক প্রতিবেদনে দারিদ্র্য নিরসনে বাংলাদেশের সাফল্যের প্রশংসা করেছে৷ তবে বাংলাদেশের অর্থনীতির ঝুঁকি হিসাবে অনাদায়ী ঋণ, বেসরকারি ব্যাংক খাতে অব্যবস্হা, রাজনৈতিক অস্হিরতার কথা উল্লেখ করেছে৷ তথাপি বিগত সময়ে বাংলাদেশ এই সমস্যাগুলি কাটিয়ে অর্থনেতিক উন্নয়ন ঘটিয়েছে৷
গত ৪ এপ্রিল বিশ্বব্যাংক ঢাকাতে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রকাশ করেছে৷ সেখানে তারা জানিয়েছে, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী পাঁচ দেশের একটি হবে বাংলাদেশ৷বাকি চার দেশের মধ্যে আছে ভারত, ভুটান, রুয়ান্ডা ও ইথিওপিয়া৷ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি টেকসই রাখতে সংস্কারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার জন্য কিছু উপদেশ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক৷ বিশ্বব্যাংক মনে করে, ব্যাংক খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম দুর্বল খাত৷ এছাড়া আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া ও রাজস্ব আদায়ে জোর দেবার কথা বলা হয়েছে৷
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রকাশ করবার আগের দিন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)-র প্রবৃদ্ধি হবে আট শতাংশ৷এডিবি জানিয়েছে, ব্যাপক ভোগ চাহিদা ও সরকারি বিনিয়োগের কারণে এই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে৷এছাড়া রপ্তানি খাতের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধিতে বাড়তি অবদান রাখছে৷এর পাশাপাশি শিল্প খাতের সম্প্রসারণ প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে৷
অর্থাৎ, জার্মানির অর্থনৈতিক বিষয়ক নানা সংস্থা,আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক সবাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রসঙ্গে আশার কথা বলছেন৷ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক উন্নয়ন আগামীতে জার্মানিসহ তার অন্যান্য বাণিজ্যিক অংশীদার দেশ সমূহের সাথে বাণিজ্যকে আরো সুদৃঢ় করবে৷
রপ্তানি খাতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সব থেকে বড় জনসংখ্যার ও অর্থনীতিতে সবল দেশ জার্মানি ,বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের দ্বিতীয় দেশ হলেও বাংলাদেশ ইইউভুক্ত অনান্য দেশেও শুল্কমুক্ত রপ্তানি বাণিজ্য করে থাকে৷ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তাদের অর্থনৈতিক প্রতিবেদন ও পরিসংখ্যানে জানিয়েছে, ২০১৫ সালে ইইউভুক্ত দেশগুলিতে রপ্তানির সূচকে বাংলাদেশের অবস্হান ৩৫ নম্বরে৷ তারা জানিয়েছে, ২০০৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাণিজ্যের হার ক্রমান্বয়ে ৫৪৬ কোটি ইউরো থেকে ১৫১৪ কোটি ইউরোতে গিয়ে পৌঁছেছে৷
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলির মধ্যে বড় বাজার বা অর্থনীতির ভাষায় বড় ভোক্তার দেশ হলো জার্মানি৷ আর জার্মানির বাজার দখল করবার জন্য সব সময় রপ্তানিকারক দেশগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা লেগেই থাকে৷ ২০১৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলি, বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকে সাড়ে তিন লাখ কোটি ইউরোর পণ্য আমদানি করেছে৷ তবে বাংলাদেশ থেকে এসেছে মাত্র ৩৭৮ কোটি ইউরোর পণ্য৷
ইইউ বা জার্মানির বাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বা রপ্তানিকারকরা মূলত বস্ত্রখাতকে অগ্রাধিকার দিলেও গত অর্থ বছরে চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত মাছ, প্রকৌশল পণ্য, প্লাস্টিক পণ্য এবং ঔষধ রপ্তানি করেছে৷ তবে রপ্তানির বিপরীতে জার্মানি থেকে বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ বেশ নগণ্য৷ জার্মানি থেকে আমদানি করা পণ্যের মধ্যে রয়েছে পোশাক ও বস্ত্র খাতের যন্ত্রপাতি, গাড়ি এবং গাড়ির যন্ত্রাংশ ইত্যাদি৷ খুবই অবাক করা ব্যপার, এই বছর বাংলাদেশের পাট পাতাও জার্মানিতে রপ্তানি হয়েছে৷ জার্মানির স্টুটগার্ট শহরের স্টুটগার্টার সাইটুং নামের একটি পত্রিকা গত ১১ মার্চ লিখেছে, পাট এবং অন্যান্য কৃষিপণ্য বিষয়ক সংস্হা ‘ইন্টারট্রপ' জার্মানির বাজারে পাট পাতা দিয়ে তৈরি চা বাজারজাত করণের জন্য অতি সম্প্রতি ২ টন চা পাতা জার্মানিতে এনেছেন তিনজন তরুণ উদ্ভাবক৷ পাট ও পাট শিল্পে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা অনেক পুরোনো৷ জার্মানির পরিবেশ সচেতন ভোক্তাকূলের জন্য পাট জাতীয় সামগ্রীর নতুন বাজার হতে পারে জার্মানি৷
বহু বছর থেকেই ইউরোপে পরিবেশবাদী আন্দোলন ক্রমশই জোরদার হচ্ছে৷ আর এই আন্দোলন থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে এখানকার জনগণ বা ক্রেতারা পরিবেশবান্ধব সামগ্রী, বস্ত্রখাত থেকে কৃষি সামগ্রী বা ভেষজ বা আয়ূর্বেদীয় ঔষধের দিকে ঝুঁকছে৷ এইসব নতুন নতুন ক্ষেত্রগুলি বা পণ্য, জার্মানিতে বাংলাদেশের রপ্তানি তালিকায় আসতে পারে৷
বিকল্প পরিবেশবান্ধব জ্বালানি তৈরির ক্ষেত্রে জার্মানি পৃথিবীর অন্যতম দেশ৷ জার্মানিতে একসময় কয়লা ও আণবিক চুল্লি থেকে উৎপাদিত জ্বালানির ব্যাপক ব্যবহার হলেও পরিবেশবাদীদের চাপের মুখে এই দুটি খাতনির্ভর জ্বালানি ব্যবস্থা থেকে তারা বের হয়ে আসছে৷ আগামী ২০৩৮ সালের মধ্যে ক্রমান্বয়ে কয়েক ধাপে কয়লা উৎপাদিত জ্বালানি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে৷ ইতিপূর্বে জার্মান সরকার জ্বালানি উৎপাদনের জন্য তৈরি ১৭টি আণবিক চুল্লি আগামী ২০২২ সালের মধ্যে বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ বিকল্প জ্বালানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার অন্যতম বাণিজ্য সহযোগী জার্মানির অভিজ্ঞতা ও সম্পর্ক কাজে লাগাতে পারে৷
জার্মানি, বাংলাদেশের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি বাজার ও বস্ত্রখাতের বড় ক্রেতা হলেও রানা প্লাজা, তাজরিন প্রভৃতি কারখানায় দুর্ঘটনা,স্বল্প মজুরি বা জার্মানির কিছু প্রতিষ্ঠান, যারা সব সময় শ্রমিক সুরক্ষার বিষয়টি এড়িয়ে স্বল্প মূল্যে পণ্য আমদানীতে আগ্রহী, এই সব অনাচারের বিষয়ে জার্মানির নানা মানবিক সংগঠন বা ‘ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন' সদস্যরা আন্দোলন করছেন৷
জার্মানি-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আগামীতে আরো বড় পরিসরে নিতে হলে, নতুন নতুন রপ্তানি খাত খুঁজে বের করাসহ পরিবেশ ও শ্রমিক বান্ধব উৎপাদনের বিষয়টি মনে রাখতে হবে৷ তবে আশা ও গৌরবের কথা, ইউরোপ ও জার্মানির মিডিয়াতে ‘সর্বদা ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বন্যাপীড়িত দেশ' বলে বিবেচিত দেশটিতে নানা রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অনাচার থাকলেও, বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমেই বলীয়ান হচ্ছে৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷