জার্মানির ড্রেসডেনে কেন ডানপন্থার উত্থান?
১৬ জুলাই ২০১৭জার্মানির বড় শহরগুলোর মধ্যে কেবলমাত্র এই ড্রেসডেনে বামপন্থার চেয়ে ডানপন্থার আধিপত্য দেখা যায়৷ ঐতিহাসিক ও পুরনো এই শহরের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে রাজকীয় মহিমা৷ এখানে সেখানে যেন এককালের সমৃদ্ধ অতীত নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছে৷ একইসঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার করুণ স্মৃতির ক্ষতও যেন এখনো দগদগ করছে৷
জার্মানির স্যাক্সনি রাজ্যের এই রাজধানী শহরে ডানপন্থার উত্থানের পেছেন এই সবকে কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন ইতিহাসবিদ এবং বিশ্লেষকরা৷
ডানধারার উগ্রতা যেন পুরো অঞ্চলকেই ধীরে ধীরে ছেয়ে ফেলছে৷ ২০১৫ সালে যখন প্রায় ১ মিলিয়ন অভিবাসী এবং উদ্বাস্তু জার্মানিতে পৌঁছে, এরপর এই ধারাটি হঠাৎ করে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে৷ আশ্রয়প্রার্থী এবং স্থানীয়দের মধ্যকার উত্তেজনা আরো বেড়ে গেছে৷
ড্রেসডেন থেকে মাত্র ২০ মিনিটের দূরত্বের শহর ফ্রাইটাল৷ যেখানে ন'জনের একটা দলের বিচার হচ্ছে৷ যাদের বিরুদ্ধে উদ্বাস্তুদের পাঁচটি ক্যাম্পে হামলার অভিযোগে রয়েছে৷
জার্মানি জুড়ে উদ্বাস্তুদের স্বার্থ এবং এমনকি সরাসরি উদ্বাস্তুদের উপর হামলার ঘটনা বাড়ছে৷ ফেডারেল ক্রিমিনাল পুলিশ দপ্তরের (বিকেএ) মতে, ২০১৫ সালে এই হামলার পরিমাণ বেড়েছে৷ যার মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে স্যাক্সনি রাজ্য৷
পেগিডার কেন্দ্র ড্রেসডেন
জার্মানির ইসলাম বিরোধী আন্দোলন পেগিডা৷ সাম্প্রতিক সময়ে জার্মানিতে গড়ে উঠা ডানপন্থি এই আন্দোলন কেন্দ্রীভূত হয়েছে এই শহরেই৷ পেগিডা, এই শব্দটি যে জার্মান কথাগুলির অর্থ হচ্ছে, প্রতীচ্যের ইসলামীকরণের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমী ইউরোপীয়রা৷
তাঁরা ২০১৪ সালে ১০ হাজার মানুষকে এই শহরের রাস্তায় আনতে সক্ষম হয়েছিল৷ যদিও সে সময় অন্য শহরগুলোতে তেমন একটা আবেদন সৃষ্টি হয়নি৷ তবে শরণার্থীরা আসার পর এই আন্দোলনে মানুষের অংশগ্রহণ আরো বেড়েছে৷
এখানকার মানুষ এমনিতে বিনয়ী হলেও গর্বিত৷ ডানপন্থি চিন্তা ধারণ করলেও আন্দোলনের মাঠে ব্যবহার করে বামপন্থিদের কলাকৌশল৷
অবশ্য সেখানে এমন মানুষও রয়েছেন, যারা নতুনকে স্বাগত জানাতে চান৷ একটি বহুত্ববাদী সমাজ গড়ে সেটার অংশ হতে চান৷
ডান-বাম যাইহোক, এখানকার মানুষের মাঝে রাজনীতি ও সরকার নিয়ে ক্রমেই হতাশা বাড়ছে৷ কয়েট্শগ্রাবেন জেলার সিটি সেন্টারের কাছে একটি ম্যাজেস্টিক ভিলা থেকে কয়েক মিনিটের পথ পার হলে ৬-৭ তলা বিশিষ্ট অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক দেখা যাবে৷ ৭০ ও ৮০'র দশকে এগুলো ছিল ঝকঝকে তকতকে৷ তখন এ রকম হাজার হাজার অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদা ছিল৷
কয়েট্শগ্রাবেনকে এখন সংগ্রাম করতে হয় দারিদ্রের সঙ্গে৷ রয়েছে উচ্চ বেকারত্ব, বাড়ছে ছোট ছোট অপরাধও৷ অনেকেই বলেছেন, ক্রমবর্ধমান এই অসন্তোষই ডানপন্থার বিস্তারকে ত্বরান্বিত করছে৷
ডয়চে ভেলের দুই প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা হয়, মিশেল হোনাওয়ার সাথে৷ তিনি খেলা মাঠের পাশে একটি আইসক্রিমের দোকান তৈরিতে কাজ করছেন৷
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাঁকে অনেক উত্থান পতনের মাঝ দিয়ে যেতে হয়েছে৷ মায়ের অসুস্থতা, কোনো কাজে স্থির হতে না পারা, পরিবারের প্রয়োজন ঠিকমতো মেটাতে না পারার ঘটনা ঘটেছে৷ একটা সময়ে গিয়ে তিনি প্রতিবেশী তরুণদের একটি দলে যোগ দিয়েছিলেন৷
অভিবাসীদের প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি বলেন, তাঁদের মানসিকতা একেবারেই ভিন্ন৷ তাঁরা এক ধরনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গেছেন৷ যেটা তাদের প্রাত্যহিক জীবনেরও অংশ হয়ে গেছে৷
‘‘অবশ্যই আমাদের উচিত তাদের সাথে ভালো আচরণ করা৷ কিন্তু তাঁদেরও এটা মনে রাখতে হবে, তাঁরা এখানে অতিথি হিসেবে এসেছেন৷ যখন আপনি অন্য কারো বাড়িতে অতিথি হিসাবে যাবেন, তখন আপনাকে অতিথি হিসাবেই আচরণ করতে হবে৷’’
‘‘একজন অতিথি কেমন থাকে? তাঁকে বন্ধুত্বপূর্ণ থাকতে হবে, প্রয়োজনে বাড়িয়ে দিতে হবে সহায়তার হাত৷ অন্যের প্রতি কর্তব্যনিষ্ঠ হতে হবে৷ কিন্তু এখানেই সমস্যা৷ তাঁরা এভাবে আচরণ করে না৷
রাজনীতি নিয়ে কিছুটা আগ্রহ রয়েছে তাঁর, রয়েছে হতাশাও, যেটা অকপটেই জানিয়েছেন ২৬ বছরের এই যুবক৷ তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো নানা অঙ্গীকার করে৷ ক্ষমতায় এসে এমন সব কাজ করে, যেটা তাদের নির্বাচনি অঙ্গীকারে ছিল না৷ সুতরাং কে ক্ষমতায় আসলো, তাতে কিছুই যায় আসে না৷
কয়েট্শগ্রাবেনের এই দিকে এখন উদ্বাস্তুরাও আসছে৷ বাড়ছে চাপা ক্ষোভ৷ বিশেষ করে যখন তাঁরা এসেই সাজানো গোছানো একটা অ্যাপার্টমেন্ট পেয়ে যান৷ অন্যদিকে এখানে বসবাসকারীদেরকে চার রুমের একটা বাসার জন্য মাসে গড়পড়তা ৬০০ ইউরো খরচ করতে হয়৷
এ রকম একটি ফ্ল্যাটেই বাস করেন কারমেন নামে চার সন্তানের একজন মা৷ তিনি বলেন, আমার বাসাটি ছেড়ে দিলে মালিক এটি সাজিয়ে গুছিয়ে ভাড়া আরো দেড়শ' ইউরো বাড়িয়ে দেবেন৷ তিনি বলেন, আমি এখনো এখানেই বাস করতে চাই৷ সমাজে বিভেদ বাড়ছে৷ এরপরও আমি বিশ্বাস করি, একটি সহিষ্ণু সমাজের জন্য আমাদেরকে আরো অনেকদূর যেতে হবে৷
খেলার মাঠে বিভিন্ন ধরনের শিশুদের দেখিয়ে তিনি বলেন, এখানে (উদ্বাস্তুরা আসায়) আরো রং হচ্ছে৷ এটা একটা ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতারও বিষয়৷ কিন্তু অনেকেই বিষয়টাকে এভাবে দেখেন না৷
কয়েট্শগ্রাবেনের খেলার মাঠে মায়েদের ভিড়ে আমাদের দেখা হয় আবদুল কাদির আহাদি এবং তাঁর চার কন্যার সাথে৷ উত্তর আফগানিস্তানের মাজার-ই-শরিফে আহাদি জার্মান সেনাবাহিনীর অনুবাদের কাজ করতেন৷ এই কাজের ফলে দ্রুত তাঁর জীবন অনিরাপদ হয়ে উঠে৷ তিনি জার্মানির ভিসার জন্য আবেদন করেন৷ ২০১৪ সালে জার্মানি এসে পৌঁছেছেন৷
পরিবার নিয়ে এখানে ঘর বাঁধতে এবং সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে তাঁকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে৷ আফগানিস্তান থেকে আসা নবাগতদের তিনি এখন সহায়তা দিচ্ছেন৷ কিন্তু এই নবাগতদের অনেকের আবেদন খারিজ হয়ে যাচ্ছে৷ তিনি বলেন, আফগানিস্তান নিরাপদ নয়৷
যাদের প্রয়োজন তাদের জন্য দুয়ার খোলা রাখতে তিনি জার্মানির প্রতি আহ্বান জানান৷ তিনি বলেন, আমি আশা করি, জার্মান সরকার, বিশেষ করে স্যাক্সন সরকার, এই সব মানুষদের সহায়তায় এগিয়ে আসবে৷ এই মুহূর্তে বিশ্বের সব দেশের মধ্যে জার্মানিতে এমন প্রচুর মানুষ রয়েছে, যারা অন্যদেরকে, বিশেষ করে অভিবাসীদেরকে সহায়তা করতে চায়৷
সুমি সমাস্কান্দা, নিনা হাসে/এসএন