গান্ধী পরিবার নিয়ে কংগ্রেসে তুলকালাম
২৪ আগস্ট ২০২০
দীর্ঘ রাজনৈতিক নাটক। তাতে সাসপেন্স আছে, চক্রান্তের অভিযোগ আছে, আবেগঘন ভাষণ আছে। একে অপরের দিকে আঙুল তোলা আছে, গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলে আবার তাঁদের কাছে আত্মসমর্পনের গল্প আছে। কিন্তু সাত ঘণ্টা বৈঠকের পরও গান্ধী পরিবারের বাইরে গিয়ে পরবর্তী সভাপতি বাছাইয়ের কাজটা করতে পারল না কংগ্রেস। অনেক অভিযোগ-অনুযোগের পর সোনিয়া গান্ধী শেষে জানিয়ে দিলেন, তিনি আহত হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তা মনে রাখতে চান না। যা হয়েছে তা অতীত। ঠিক হয়েছে, সোনিয়া এখন আরো কয়েকমাস সভানেত্রী থাকবেন। একটা কমিটি করা হবে তাঁকে সহায়তা করার জন্য। দ্রুত এআইসিসি বা কংগ্রেসের অধিবেশন ডেকে নতুন সভাপতি নিয়োগ করা হবে।
আসলে ২৩ জন প্রবীণ নেতা একটা চিঠি লিখেছিলেন দলনেত্রী সোনিয়া গান্ধীকে। সেখানে তাঁদের দাবি ছিল, কার্যকরী নয়, কংগ্রেসে একজন স্থায়ী সভাপতি নিয়োগ করা উচিত। আর তিনি একা সিদ্ধান্ত নেবেন না। সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত যৌথভাবে। এই চিঠি পাঠানো হয়েছিল এমন সময়ে যখন সোনিয়া গান্ধী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে। চিঠিটি লিখেছেন রাজ্যসভার নেতা গুলাম নবি আজাদ, উপ নেতা আনন্দ শর্মা, লোকসভা সাংসদ শশী থারুর, রাজ্যসভা সাংসদ বিবেক তনখা, কপিল সিবালের মতো প্রবীণ নেতারা। তারপর সেই চিঠি সংবাদমাধ্যমের কাছে ফাঁস করে দেয়া হয়।
ওয়ার্কিং কমিটির অনলাইন বৈঠক শুরু হয় বেলা এগারোটায়। প্রথমেই সোনিয়া গান্ধী বলে দেন, তিনি আর সভাপতি থাকবেন না। অন্য সভাপতি খুঁজে নিক দল। যাঁরা চিঠি লিখেছেন, তাঁদের প্রতিও কটাক্ষ করেন তিনি। তারপরের প্রশ্ন তুলে দেন রাহুল গান্ধী। চিঠি লেখার জন্য কেন এমন সময় বাছা হলো, যখন সোনিয়া হাসপাতালে? এরপরই রটে যায়, রাহুল অভিযোগ করেছেন, যাঁরা এই চিঠি লিখেছেন, তাঁরা বিজেপির হয়ে কাজ করেছেন। কপিল সিবাল টুইট করে বলেন, রাহুল গান্ধী বিজেপির কথায় চিঠি লেখার কথা বলেছেন, কিন্তু তিনি জীবনে কখনো বিজেপি-র পক্ষে একটা কথাও বলেননি। রাহুল তখন ফোন করেন সিবালকে। তিনি জানান, এরকম কোনো কথা তিনি বলেননি। তখন কপিল তাঁর টুইট প্রত্যাহার করেন।
গুলাম নবি আজাদও চিঠি লেখার জন্য যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছেন। তিনিও পরে জানান, রাহুল ওই ধরনের কোনো কথা বলেননি। তিনি বৈঠকে ইস্তফার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু মনমোহন সিং, এ কে অ্যান্টনি থেকে শুরু করে একের পর এক নেতা গান্ধী পরিবারের প্রতিই আনুগত্য দেখিয়েছেন। অম্বিকা সোনি তো গুলাম নবি সহ বাকিদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য শাস্তি দাবি করেন। তবে সেই দাবি মানা হয়নি।
বিক্ষুব্ধদের চিঠি পেয়েই ক্ষুব্ধ সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেস ওার্কিং কমিটির বৈঠক ডাকেন। সেই বৈঠকে তিনি সাফ জানিয়ে দেন, ''আপনারা দ্রুত সভাপতি খুঁজুন। আমি আর সভাপতি থাকব না।'' যাঁরা চিঠি লিখেছিলেন, তাঁদের অনেকেই এক বছর আগে সোনিয়াকে কার্যকরী সভাপতি হওয়ার জন্য প্রায় হাতেপায়ে ধরেছিলেন। এঁদের অনেকেই গান্ধী পরিবারের অনুগামী বলে খ্যাত। নিজ রাজ্যে ধারভারহীন এই নেতাকুল কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় স্তরে গুরুত্ব পান গান্ধী পরিবারের জন্যই। যাঁরা রাজ্যে এখনো লড়াই করছেন, তাঁদের বাদ দিয়ে এই সব নেতাদের রাজ্যসভার সদস্য করা হয়। লোকসভা হেরে যাওয়ার পরও তাঁদের রাজ্যসভায় নিয়ে এসে পুরস্কার দেয় গান্ধী পরিবার।
তবে তাঁরা যে প্রশ্নগুলো তুলেছেন, তা যে অসঙ্গত, তা বলা যায় না। গত ছয় বছরে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি-র ঠিক যতটা উত্থান হয়েছে, কংগ্রেসের ঠিক ততটাই নির্মম রাজনৈতিক পতন হয়েছে। এই অবস্থায় কর্মীদের আশার আলো দেখাতে পারছে না গান্ধী পরিবার। সনিয়ার শরীর খারাপ। আগে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে কংগ্রসের নেতৃত্বাধীন জোটকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছিলেন। এখন পরিস্থিতি আলাদা। তাঁর ছেলে রাহুল গান্ধী একবার ব্যর্থ হয়ে আর দায়িত্ব নিতে চান না। তিনি দায়িত্ব না নিয়ে ক্ষমতা ভোগ করতে চান। দলের ক্ষেত্রে শেষ কথা বলতে চান। প্রিয়ঙ্কার ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য। রাহুল দায়িত্ব নেয়ার পরই কংগ্রেসের প্রবীণ ও তরুণ নেতাদের মধ্যে যে গণ্ডগোল শুরু হয়েছে, তার জের এখনো চলছে। বরং সেই ফাটল আরো বাড়ছে।
বিজেপিতে দীর্ঘদিন কাটানোর পর কংগ্রেসে দুই বছর হলো এসেছেন বলিউড তারকা শত্রুঘ্ন সিনহা। তাঁর দাবি, ''চিঠি লেখা কোনো অপরাধ নয়। দলের ভালোর জন্য লিখেছেন। রাস্তা একটা বেরবে। লম্বা যাত্রা একটা পদক্ষেপ থেকেই শুরু হয়। এই পরিবার দেশকে গড়েছে। এই পরিবার ভোট জোগাড় করে কংগ্রেসের জন্য। দলের লোক এই পরিবারের সঙ্গে জড়িত। পরিবারকে বাদ দিয়ে কিছু হবে না।''
তবে কংগ্রেসে এই আলোড়নের একটা ভালো দিক আছে। দলের ভিতরে গণতান্ত্রিক পথে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা হচ্ছে। এটা ভারতের রাজনৈতিক দলগুলিতে খুব একটা দেখা যায় না। দলের অধিকাংশ কংগ্রেস কর্মী ও নেতা মনে করেন, গান্ধী পরিবার ছাড়া কংগ্রসকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। তারাই কংগ্রেসের কাছে ফেভিকলের মতো, যা কংগ্রেসকে একজোট করে রেখেছে। কিন্তু মুশকিল হলো, রাহুল বা প্রিয়ঙ্কা দলের দায়িত্ব নিতে চান না। এ বার কি তাঁরা মত বদল করবেন না কি, গান্ধী পরিবারের বাইরে থেকে কাউকে সভাপতি করা হবে? সেটাই সব চেয়ে বড় প্রশ্ন। বৈঠকের পর আবার রাহুলকে সভাপতি করার দাবি জানাতে শুরু করেছেন বিভিন্ন রাজ্যের কংগ্রেস নেতারা। বিশেষজ্ঞদের মতে, বোঝা যাচ্ছে জল ছাড়া যেমন মাছ বাঁচে না, তেমনই পরিবার ছাড়া কংগ্রেসও সম্ববত বাঁচবে না।
জিএইচ/এসজি(এনডিটিভ, এএনআই)