গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রেক্ষিতে মুসলমান-ইহুদী সম্পর্ক
১৬ জানুয়ারি ২০০৯গাজায় ইসরায়েলি আক্রমণের প্রতিবাদে গত দু'সপ্তাহে ফ্রান্সের বিভিন্ন নগরীতে অবস্থিত সিনাগগ বা ইহুদী উপাসনালয়ে তিনটি বিচ্ছিন্ন আক্রমণ হয়েছে৷ গাজায় আক্রমণের প্রতিবাদে সাপ্তাহিক ছুটির সময়ে গোটা ফ্রান্স জুড়ে প্রায় বিশটি শহর ও নগরে প্রায় এক লাখ বিশ হাজার মানুষ সমবেত হয়৷ অধিকাংশ এলাকায় বিক্ষোভকারীরা শান্ত ছিল তবে এ সময় আরব যুবকরা বিভিন্ন সড়কে অনেক ইসরায়েলি পতাকা পুড়িয়ে দেয়৷
ফ্রান্সের মন্ত্রী পরিষদ ইতিমধ্যে মুসলমান ও ইহুদী সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে জরুরী সভায় মিলিত হয়েছে৷
গিউম আইমে এর মতো কিছু সমালোচক অবশ্য বলছেন, ফ্রান্সে যা কিছু ঘটছে তা এখানকার স্বাভাবিক ঘটনা মাত্র৷ যারা ইহুদী উপাসনালয়ে হামলা করেছে তারা গাজায় ইসরায়েলী আক্রমণের পূর্বেও ইহুদীদের ঘৃণা করতো তারা এখন তাদের ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে এটিকে একটি সহজ ব্যাখ্যা হিসেবে দাঁড় করানোর সুযোগ পেয়েছে৷
১২ জানুয়ারি প্রায় ৯০ টি ফ্রান্স ভিত্তিক ফিলিস্তিনপন্থী সংগঠন প্যারিসে সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দিয়েছে যে, গাজায় ইসরায়েলী আক্রমণের সময় সংঘটিত যুদ্ধ অপরাধের বিরুদ্ধে তারা আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে মামলা করার পরিকল্পনা করছে৷ মানবাধিকার বিষয়ক আরব কমিশনের মুখপাত্র ড. হাইথাম মান্না বলেন, অভিযোগ দায়ের এর কাজে সম্পৃক্তদের এক-তৃতিয়াংশেরও বেশি ইহুদী আইনজীবী৷ তিনি বলেন, আমরা মুসলমান, ইহুদী এবং ধর্মনিরপেক্ষ সবাই একসাথে মানবাধিকার নীতিমালা রক্ষায় কাজ করতে যাচ্ছি৷
এদিকে বুধবার প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয়েছে, জার্মানরা গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণ বিষয়ে দ্বিধা-বিভক্ত৷ জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৩০ শতাংশ হামাসকে এবং ১৩ শতাংশ ইসরায়েলকে এ আক্রমণের জন্য দায়ী করেছে৷ অন্যদিকে ৩৫ শতাংশ জার্মান গাজায় এ সংঘাতের জন্য হামাস ও ইসরায়েল উভয়কেই দায়ী করেছে৷ জার্মান সাপ্তাহিক স্টার্ন এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এ জরিপের আওতায় ১০০০ মানুষকে প্রশ্ন করা হয়৷
জরিপের ফলাফলে আরো বলা হয়েছে, এদের ৪৯ শতাংশ ইসরায়েলকে একটি আগ্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছে৷ অন্য ১০ শতাংশ মন্তব্য করেছে যে, ইসরায়েল অন্য রাষ্ট্রসমূহের প্রতি কোন শ্রদ্ধা না দেখিয়ে কাজ করে চলেছে৷
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৩০ শতাংশ মনে করে যে, ইসরায়েল মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছে৷ এদের মধ্যে প্রতি ৮ জনে একজন খোদ এ ইহুদী রাষ্ট্রটির অস্তিত্বের ব্যাপারেই প্রশ্ন তুলেছে৷ অন্যদিকে, ৪৫ শতাংশ ইসরায়েলের প্রতি সহানুভূতিশীল মতামত ব্যক্ত করেছে৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান কার্যালয়স্থল এবং বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে রোববার হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয় ইসরায়েলী হামলার প্রতিবাদ জানাতে৷ এতে অংশ নেয় বেলজিয়ামের ট্রেড ইউনিয়ন এবং রাজনৈতিক দলগুলো৷ তারা গাজার নিরীহ জনগণের ওপর হামলা বন্ধের জন্য ইসরায়েলী সরকারের প্রতি আহবান জানায়৷ স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদ, জার্মানির রাজধানী বার্লিন সহ ইউরোপের আরো অনেক শহরে ইসরায়েলী হামলার প্রতিবাদে মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে৷ অনেক শহরে সমাবেশ হয়েছে ইসরায়েলের পক্ষেও৷
কেবল ইউরোপ নয় এশিয়ার অনেক দেশেও প্রতিবাদ হয়েছে৷ ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় প্রায় ২০ হাজার লোক গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে৷ হংকংয়ে এক যুদ্ধবিরোধী সমাবেশে অংশ নেয় প্রায় এক হাজার ছাত্রছাত্রী৷ তারা গাজা এলাকায় সকল প্রকার সংঘর্ষ বন্ধের আহবান জানায়৷ পাকিস্তানের অনেক শহরে রোববার ইসরায়েল বিরোধী মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে৷ লাহোরে কয়েক হাজার লোক মিছিল করে এবং ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী স্লোগান দেয়৷ তারা এসময় ইসরায়েলী পতাকা পুড়িয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে৷ লেবাননের রাজধানী বৈরুতেও প্রায় আড়াই হাজার লোক প্যালেস্টাইনের সমর্থনে শান্তিপূর্ণ মিছিলে অংশ নেয়৷ এসময় তাদের সঙ্গে চিকিৎসকদের একটি দল ইসরায়েলী হামলায় নিহত নারী ও শিশুদের ছবি তুলে ধরে৷ এদিকে গাজাবাসীদের প্রতি সমর্থন জানাতে তুরস্কের আংকারা থেকে ২০০ গাড়ির একটি বহর সিরিয়ার দিকে যাত্রা করেছে বলে জানিয়েছে সেখানকার সলিডারিটি ফাউন্ডেশন৷ মিশরেও ইসরায়েল বিরোধী মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে৷
এদিকে গাজার বর্তমান পরিস্থিতিকে আতংকজনক আখ্যায়িত করে সেখানে হামলা বন্ধ করার আহবান জানিয়েছে বৃটেনের ইহুদিদের সংগঠন বৃটিশ জিউস৷ এক বিবৃতিতে তারা ইসরায়েলে হামাসের রকেট হামলাকে যুদ্ধাপরাধ বলেও মন্তব্য করেছে৷
ম্যানচেস্টারে বসবাসকারী ৩৪ বছর বয়স্ক সাইমন লেডার বলেন, ৯/১১ এর পরে ব্রিটিশ মুসলমানরা যেমন অন্যায়ভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল, ব্রিটিশ ইহুদীরাও এখন গাজায় ইসরায়েলি আক্রমণের কারণে অন্যায়ভাবে নির্যাতনের শিকার হতে পারে৷
হাদাসা ফিডলার, যিনি সম্প্রতি তৃতীয় সন্তানের মা হয়েছেন, গাজায় ইসরায়েলি আক্রমণের সংবাদ ও দৃশ্যকে দুঃখজনক বলে আখ্যায়িত করে বলেন, অনেক নিরপরাধ ফিলিস্তিনী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে৷ তবে তিনি বিশ্বাস করেন যে, বছরের পর বছর হামাসের রকেট হামলার জবাবে ইসরায়েলের জন্য এটা করার প্রয়োজন ছিল৷
তিনি বলেন, ইসরায়েলের হামলায় ধ্বংসযজ্ঞের পরিমান অনেক ব্যাপক৷ তবে তিনি এও বলেন যে, হামাস ছোট একটি পদক্ষেপ নিলেই আক্রমণ থেমে যেতে পারে৷
বৃহস্পতিবার রাতে বার্মিংহাম নগর কেন্দ্র থেকে চার মাইল দূরে সিংগারস হিলস উপাসনালয়ে এক বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয় যেখানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ একসাথে গাজায় ইসরায়েলি আক্রমণের শিকার সবার শান্তি ও মুক্তি কামনা করে৷
বার্মিংহামে বসবাসরত মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীরা মনে করে, গাজায় ইসরায়েলি আক্রমণ বন্ধে জাতিসংঘের পদক্ষেপ খুবই নগণ্য এবং বিলম্বিত৷ এদের একজন জানায় যে ২৪ ঘন্টা আগে ইসরায়েলি হামলায় তার নানী নিহত হয়েছে৷ সম্প্রতি রামাল্লা থেকে সুলিহালে চলে আসা নিলি আবু রাকাব জানান, তার এক বোন এখনও গাজায় রয়ে গেছে কিন্তু সে তার সাথে এক সপ্তাহ ধরে যোগাযোগ করতে পারছে না৷ নিলি‘র চার বছরের ভাগ্নে এতটাই সন্ত্রস্ত হয়ে গেছে যে, তার কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে৷ নিলি জানায়, আমি যখন শেষবার আমার বোনের সাথে কথা বলি তখন ফোনে শুনতে পাচ্ছিলাম গোলা বর্ষনের শব্দ৷ আমার বোন কাঁদছিল এবং অল্পই কথা বলতে পারছিল৷