ক্যানসার মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট টিকা
৫ এপ্রিল ২০২১নির্দিষ্ট ব্যক্তির শরীরে নির্দিষ্ট টিউমারের জন্য আলাদা করে টিকা – তাও আবার দ্রুত, কার্যকর এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াবিহীন৷ ক্যানসার মোকাবিলায় মেসেঞ্জার আরএনএ প্রযুক্তি এমনই প্রতিশ্রুতি বয়ে আনছে৷
হামবুর্গ শহরের এক হাসপাতালের টিউমার সেন্টার সেই প্রযুক্তির জন্য অপেক্ষা করছে৷ ডিয়র্ক আর্নল্ড ও তার সহকর্মীরা কয়েক মাসের মধ্যেই সেই লক্ষ্যে এক ক্লিনিকাল স্টাডি শুরু করবেন৷ ইউরোপের অন্য কয়েকটি কেন্দ্রেও সেই পরীক্ষা চালানো হবে৷ প্রো. আর্নল্ড বলেন, ‘‘প্রতিপক্ষ, অর্থাৎ টিউমারের বিরুদ্ধে নিজস্ব ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে লড়াই করার জন্য ইমিউন সিস্টেমকে প্রস্তুত করে তোলা আধুনিক প্রচেষ্টার মধ্যে পড়ে৷''
সমস্যা হলো, আক্রান্ত টিউমার বহু বছর ধরে মানুষের ইমিউন সিস্টেমকে ফাঁকি দিতে পারে৷ ছদ্মবেশ ধারণ করে শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতার সামনে সেটি নিজেকে শত্রু হিসেবে চিনতে দেয় না৷ অথবা সেই প্রতিরোধ শক্তি এতই দুর্বল যে ক্যানসার কোষগুলিকে দমিয়ে রাখার ক্ষমতা নেই৷ ফলে টিউমার বিনা বাধায় বেড়ে উঠতে পারে৷
অপারেশনের মাধ্যমে টিউমার এবং মেটাস্টেসেস অপসারণ করা সম্ভব৷ কিন্তু নতুন করে টিউমারের মাথাচাড়া দেবার ঝুঁকি এড়াতে আরো কিছু পদক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে৷ এই ঝুঁকি ব্যাখ্যা করে অধ্যাপক ডিয়র্ক আর্নল্ড বলেন, ‘‘এমনকি বিশ্বের সেরা সার্জেনের ক্ষমতাও এ ক্ষেত্রে সীমিত৷ শরীরের কোনো এক অংশে টিউমার কোষ লুকিয়ে থাকলে, বংশবৃদ্ধি না করলে সেটি সহজে শনাক্ত করা যায় না৷ রোগের বায়োলজিও তিনি বদলাতে পারেন না৷ বায়োলজির অর্থ, ঘুমন্ত টিউমার কোষ অনেক সময় ধরে টিকে থাকতে পারে৷ তারপর ঘুম থেকে উঠে সেটি বংশবৃদ্ধি করতে পারে৷''
নতুন মেসেঞ্জার আরএনএ টিকার মাধ্যমে নিজস্ব ইমিউন সিস্টেমকে এতটা শক্তিশালী করে তোলার চেষ্টা চলছে, যাতে সেটি নিজস্ব ক্ষমতায় টিউমারের মোকাবিলা করতে পারে৷ প্রচলিত টিকার মতো এ ক্ষেত্রে শত্রুর মৃত অংশবিশেষ শরীরে প্রবেশ করানো হয় না৷ তার বদলে টিউমারের নির্দিষ্ট প্রোটিনের কাঠামো ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে পেশির কোষের মধ্যে চালান করা হয়৷
সেই কাঠামোর নির্দেশাবলী অনুযায়ী শরীর নিজস্ব ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে টিউমারের বিল্ডিং ব্লক তৈরি করে৷ শরীরের ইমিউন সিস্টেম তখন সেটিকে বহিরাগত হিসেবে শনাক্ত করে অ্যান্টিবডির জন্ম দেয়৷ প্রতিপক্ষকে চিনে নিয়ে সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়৷ জার্মান ক্যানসার গবেষণা কেন্দ্রের নিল্স হালামা বলেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে উৎপাদন প্রক্রিয়া বদলে দেওয়া হয়৷ ল্যাব অথবা জটিল প্রযুক্তির মাধ্যমে নয়, গোটা প্রক্রিয়া বরং রোগীর শরীরের মধ্যে স্থানান্তরিত করে সেখানেই উৎপাদন করা হয়৷ ফলে শরীর সেটি ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারে এবং ইমিউন সিস্টেমও সেটি একইভাবে চিনতে পারে৷''
সেইসঙ্গে গবেষকরা আশা করছেন যে, টিকার মাধ্যমে ইমিউন সিস্টেম আগে থেকেই রক্তে টিউমার কোষ চিহ্নিত করতে পারবে৷ ফলে অন্য কোথাও মেটাস্টেসেস তৈরির সময়ই থাকবে না৷ প্রোফেসর আর্নল্ড বলেন, ‘‘নিজস্ব ইমিউন সিস্টেমের মাধ্যমে টিউমারের অতি কম পরিমাণ অবশিষ্ট অংশ হয় নিয়ন্ত্রণে রাখা কিংবা ধ্বংস করাই হলো লক্ষ্য৷ এভাবে নিরাময়ের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে৷''
জার্মানির মাইনৎস শহরের বায়োনটেক কোম্পানি মেসেঞ্জার আরএনএ টিকা তৈরির কাজ করছে৷ সেই কোম্পানির কোভিড-১৯ টিকাও একই প্রযুক্তির ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে৷
জার্মানির ট্যুবিঙেন শহরের কিয়োরভ্যাক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না কোম্পানিও মেসেঞ্জার আরএনএ প্রযুক্তি কাজে লাগাচ্ছে৷ করোনা ভাইরাস ও ক্যানসার মোকাবিলার ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি যথেষ্ট কার্যকর হতে পারে৷ টিউমার রোগীদের জন্য ভবিষ্যতে আলাদা করে দ্রুত টিকা তৈরি করাই এই উদ্যোগের লক্ষ্য৷ নিল্স হালামা মনে করেন, ‘‘এটা সত্যি এক মাইলফলক৷ কারণ আমরা মাস অথবা বছর নয়, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে টিকা তৈরির কথা বলছি৷ ফলে তাৎপর্য এবং সম্ভাব্য কার্যকারিতার বিচারে সম্পূর্ণ নতুন এক ক্ষেত্র খুলে যাচ্ছে৷''
কয়েক বছরের মধ্যে এই উদ্যোগের সুফল পাওয়ার কথা৷ ক্যানসারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে নতুন এই প্রযুক্তি জোরালো হাতিয়ার হয়ে উঠবে বলে গোটা বিশ্বের টিউমার বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন৷
বির্গিট আউগুস্টিন/এসবি