ভারতে কৃষক বিক্ষোভ
১৮ জুন ২০১৭কৃষিঋণ মকুবের দাবিতে কৃষক বিক্ষোভের আগুন ছড়ালো বিজেপি-শাসিত মধ্যপ্রদেশে৷ সেখানে বিক্ষোভ থামাতে গিয়ে মন্দসৌরে গত মঙ্গলবার পুলিশের গুলিতে মারা গেল পাঁচজন কৃষক৷ আত্মহত্যা করেছে ঋণভারে জর্জরিত আরও চারজন কৃষিজীবী৷ এই নিয়ে রাজ্যে মোট নয় জন আত্মহত্যা করল৷ কেন তাঁরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিল, তার সদুত্তর মেলেনি শাসক শিবির থেকে৷ এর আঁচ ছড়িয়ে পড়ে উত্তরপ্রদেশ মহারাষ্ট্র, গুজরাট, রাজস্থান, তেলেঙ্গানা, পাঞ্জাবসহ অন্যান্য রাজ্যগুলিতেও৷ নিখিল ভারত কিষাণ সভার নেতৃত্বে কৃষক সংগঠনগুলি গত বৃস্পতিবার দিল্লিতে বিক্ষোভ দেখায়৷ একজোট হয়ে দেশ জুড়ে আন্দোলনের কথা ঘোষণা করে৷ পথ অবরোধ চলছে বিভিন্ন রাজ্যে৷
নিহত কৃষক পরিবারগুলিকে সমবেদনা জানাবার সুযোগ দেয়নি রাজ্য প্রশাসন৷ কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা মন্দসৌরে যাবার চেষ্টা করলে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়৷ বিজেপি মনে করে, সমবেদনা নয়, কৃষকদের প্ররোচনা দেওয়াই মূল উদ্দেশ্য৷ কৃষক সংগঠনগুলি এবং সরকারের মধ্যে আলোচনাই সমাধানের প্রকৃষ্ট পথ৷
উৎপাদিত ফসলের দাম পাচ্ছে না চাষিরা৷ আর মূলত এ কারণেই কৃষক বিক্ষোভ৷ এতো বেশি উত্পাদন হয়েছে যে, বাজারে বিভিন্ন ফসলের দাম এসে তলানিতে ঠেকেছে৷ যেমন, পেঁয়াজের দাম এক টাকা কিলো, আলুর দাম ৮০ পয়সা কিলো, হলুদ ৫০ পয়সা কিলো, সয়াবিনের দাম অর্ধেক৷ কৃষকরা বলছেন, এতে উত্পাদন খরচই ওঠে না৷ সংসার চালানো কঠিন৷ ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ করা অসম্ভব৷ এ অবস্থায় আগামী বছর ফসল চাষের কথা ভাবাবেন কী করে? চাষিদের দাবি সরকার মোটামুটি দামে তাঁদের ফসল কিনে নিক, অথবা ঋণে ছাড় দেওয়া হোক৷ ক্ষোভটা অমূলক নয় মেনে নিয়েও এর অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিচার করলে দেখা যাবে, দেশে কৃষি ঋণের মোট পরিমাণ প্রায় তিন লক্ষ কোটি টাকা৷ এত টাকা যদি ঋণদানকারী ব্যাঙ্কগুলি মকুব করে তাহলে ব্যাঙ্কে তালা পড়বে৷ গত বুধবার কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কেন্দ্রের পক্ষে তা বহন করা সম্ভব নয়, বহন করলে রাজ্যকেই করতে হবে৷ সেক্ষেত্রে তাদের বাজেট ঘাটতি বেড়ে যাবে৷ পরিস্থিতি সামাল দিতে একদিন পরেই মোদী মন্ত্রিসভা স্বল্প মেয়াদি কৃষিঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার কম করার জন্য ভর্তুকি দেবার সিদ্ধান্ত নেন৷ তিন লক্ষ টাকা পর্যন্ত কৃষিঋণে সুদ হবে বার্ষিক ৪ শতাংশ৷ অবশ্য এটা সাময়িক সমাধান হয়ত হবে, তবে স্থায়ী সমাধান নয়৷
এই প্রসঙ্গ নিয়ে কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ডক্টর মধুসূদন দত্ত ডয়চে ভেলেকে বললেন, সরকারি তহবিল থেকে ২ লক্ষ বা ৪ লক্ষ টাকা দিতে হবে সন্দেহ নেই, কিন্তু তার থেকে বড় কথা, ঋণ গ্রহীতাকে বুঝতে হবে ঋণ নিলে তা শোধ করা জরুরি৷ এই বোধ বা এই চেতনা বা সংস্কৃতি না থাকলে দেশের ব্যাঙ্কিং সিস্টেম ভেঙ্গে পড়বে৷ একই সঙ্গে সরকারের উচিত হবে সহায়ক দামে চাষিদের ফসল কিনে নেওয়া৷ তবে স্থায়ী সমাধানের জন্য কৃষি অবকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন৷ ফসল মজুত রাখবার মতো যথেষ্ট হিমঘর থাকলে বাজারের গতিপ্রকৃতি বুঝে ফসল ছাড়া যাবে৷ দ্বিতীয় প্রয়োজন ফসল বিমা৷ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কারণে ফসল নষ্ট হলে কৃষকরা যাতে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পায়, সেটা সুনিশ্চিত করা যায়৷ পাশাপাশি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পকেও এরসঙ্গে জুড়তে হবে৷
কৃষি বিপণনে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিযোগ সম্পর্কে ডক্টর দত্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, এই ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ স্বাগত, কিন্তু নিঃশর্তে নয়৷ চোখ বুঁজে ছাড়পত্র দেওয়া উচিত হবে না৷ বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলি সবকিছু বিদেশ থেকে এনে ভারতের বাজারে বিক্রি করবে, তা হয় না৷ ভারতের কৃষিপণ্য কিনে দেশেই বিক্রি করতে হবে৷ তাতে কৃষকরা যেমন ন্যায্য দাম পাবেন, ক্রেতাদেরও সাশ্রয় হবে৷ একই সঙ্গে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের হাত ধরে দেশে আসবে আধুনিক টেকনোলজি এবং ম্যানেজমেন্ট৷ দেশীয় কোম্পানিগুলি প্রতিযোগিতায় শঙ্কিত নয়৷
এখন দেশীয় কোম্পানিগুলি এতটাই উন্নত যে, তারা সমান তালে পাল্লা দিতে পারবে৷ এর আগে খুচরো বিপণনে বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল৷ যদিও কৃষি বিপণনে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিযোগের বিরোধিতা আসতে পারে মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির দিক থেকে৷
কৃষক আন্দোলনের রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিরোধিরা একজোট হবার চেষ্টা করছে৷ মোদী সরকারকে চাপে রাখতে চাইছে৷ কংগ্রেস নেতারা শুরু করেছেন সত্যাগ্রহ৷ বিজেপি নেতৃত্ব যে সেটা বুঝতে পারছে না, তা নয়৷ মহারাষ্ট্র সরকার এবং উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সরকার ইতিমধ্যেই আর্থিক সাহায়তা মঞ্জুর করেছেন৷ কারণ, উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা ভোটের আগে বিজেপির নির্বাচনি প্রচারে এই রকমই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল৷ আগামী বছর কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন এবং ২০১৯ সালে সাধারণ নির্বচনের কথা মাথায় রেখে মোদী তাই সতর্কতার সঙ্গেই পা ফেলতে চাইছেন যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙ্গে৷