কুলভূষণের মৃত্যুদণ্ড নিয়ে বিতর্ক
১৪ মে ২০১৭গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগে ভারতীয় নৌ-সেনার প্রাক্তন অফিসার কুলভূষণ যাদবকে পাকিস্তানের সামরিক আদালত গোপন বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ায় হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে বিষয়টি তোলে নতুন দিল্লি৷ তা না হলে যে কোনোদিন তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে পারতো৷ কিন্তু আন্তর্জাতিক আদালত কুলভূষণের মৃত্যুদণ্ডের ওপর অন্তর্বতী স্থগিতাদেশ দেয়৷ ভারতের পক্ষে সওয়াল করেন অ্যাটর্নি জেনারেলের নেতৃত্বে বাঘা বাঘা কয়েকজন আইনজীবী৷ ভারতের বক্তব্য, কুলভূষণকে গ্রেপ্তার করা হয় ২০১৬ সালের মার্চ মাসে৷ ইরান থেকে তাকে অপহরণ করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়৷ কুলভূষণ ইরানে গিয়েছিলেন তার ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক কাজে৷ যদিও পাকিস্তান বলেছে কুলভূষণকে গ্রেপ্তার করা হয় বালুচিস্তান থেকে৷ তাদের কথায়, সেখানে চরবৃত্তি এবং নাশকতামূলক কাজে জড়িত ছিল সে৷
এদিকে ভারতের অভিযোগ, কুলভূষণের গ্রেপ্তারের খবর দিল্লিকে জানানো হয়নি৷ দিল্লি ঘটনাটা জেনেছিল অনেকদিন পর, এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি থেকে৷ কূটনৈতিক নিয়মানুসারে ভারত কনসুলেট স্তরে কুলভূষণের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে পাকিস্তান সরকার তার অনুমতি দিতেও অস্বীকার করে৷ অন্তত ১৫ বার এই আবেদন নাকচ করে দেওয়া হয়৷ এমনকি কুলভূষণের মা ছেলের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে তাঁকেও ভিসা দেয়নি ইসলামাবাদ৷ এটা ভিয়েনা কনভেনশন এবং আন্তর্জাতিক আইনের খেলাপ৷ তাই এর প্রেক্ষিতে, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত, আইসিজে-র প্রেসিডেন্ট রনি আব্রাহাম কুলভূষণের মৃত্যুদণ্ডের ওপর অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ জারি করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে চিঠি দিয়ে জানান যে, আন্তর্জাতিক আদালতের চূড়ান্ত রায় সাপেক্ষে এই ফাঁসির আদেশ যেন কার্যকর করা না হয়৷ প্রধানমন্ত্রী শরিফ যেন সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন৷
এই স্থগিতাদেশে পাকিস্তানের উপর কিছুটা হলেও চাপ সৃষ্টি করতে পারায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং কুলভূষণের পরিবারে আপাতত স্বস্তি৷ কিন্তু ভূমিগত বাস্তবতা নিরিখে দিল্লির উদ্বেগ কমেনি৷ প্রশ্ন হলো, আন্তর্জাতিক আদালতের এই নির্দেশ পাকিস্তান আদৌ মানবে কিনা এবং মানলে কতটা? কারণ আন্তর্জাতিক আদালতের রায় কোনো সার্বভৌম দেশের কাছে বাধ্যতামূলক নয়৷ পাকিস্তান সেই জমি শক্ত করে ধরে রেখে বলেছে, দেশের অভ্যন্তরিণ কিংবা জাতীয় নিরাপত্তার মতো ইস্যুগুলি আন্তর্জাতিক আদালতের এক্তিয়ারে পড়ে না৷ এখনও পর্যন্ত স্থগিতাদেশের বিষয়ে পাকিস্তানের যে সুর শোনা যাচ্ছে, তাতে মনে হয় না এই স্থগিতাদেশ ইসলামাবাদ মানবে৷ দ্বিতীয়ত, দিল্লির কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও একটা কারণে৷ পাকিস্তান কি এই সুযোগে কাশ্মীরে মানবাধিকারের ইস্যু নতুন করে বিশ্ব মঞ্চে তুলতে পা? যেটা দ্বিপাক্ষিক ইস্যু বলে তৃতীয়পক্ষের মধ্যস্থতায় ভারত গোড়া থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসছে৷ হালে দিল্লিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ানকেও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সেটা জানিয়ে দেওয়া হয়৷
দিল্লির প্রথম সারির এক সংবাদপত্রের অভিজ্ঞ সাংবাদিক ইন্দ্রানী বাগচি ডয়চে ভেলেকে এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘পাকিস্তানের মতিগতি দেখে তো মনে হচ্ছে না যে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় পাকিস্তান মানবে৷ তবে হ্যাঁ, কনসুলার যোগাযোগের অনুমতি দিতে হতে পারে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে৷ আগামী সোমবার আন্তর্জাতিক আদালতে দু'পক্ষেরই সওয়াল-জবাব হবে৷ তাতে পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক ইস্যুর যুক্তি হয়ত টিকবে না৷ কারণ ভারত ভিয়েনা কনভেনশনের যে ধারার উল্লেখ করেছে, তাতে কনসুলার যোগাযোগের ওপর জোর দেয়া হয় এবং ২০০৮ সালে এবিষয়ে ভারত-পাক একটা চুক্তিও হয়৷ কাজেই আদালত হয়ত দ্বিপাক্ষিকতার ভিত্তিতে কনসুলার সুবিধা দেবার নির্দেশ দিতে পারে আন্তর্জাতিক আদালত এবং পাকিস্তানের পক্ষে সেটা না মেনে উপায় থাকবে না৷''
তৃতীয়ত, অতীতে ১৯৭১ সালে লাহোরগামী ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের একটি বিমান ছিনতাই হলে আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিল ভারত৷ সেটাও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে৷ ভারতের আকাশে পাকিস্তানের অসামরিক বিমান উড়ানের অধিকার নিয়ে, আন্তর্জাতিক অসামরিক বিমান উড়ান সংস্থা (আইসিএও)-এর বিরুদ্ধে. পাকিস্তানের বক্তব্য ছিল, ভারত একতরফাভাবে এটা বন্ধ করতে পারে না৷ বিশ্ব আদালতে ভারতের যুক্তি ধোপে টেকেনি৷ সৌরভ কালিয়া মামলাতেও ভারতের কৌশলগত অবস্থান ছিল এটি ভারত-পাক দ্বিপাক্ষিক বিষয়, আইসিজের এক্তিয়ারের বাইরে৷ কারণ ১৯৪৮ সালে কাশ্মীরে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর আগ্রাসন নিয়ে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি তোলায় আজ পর্যন্ত তার ফল ভুগতে হচ্ছে ভারতকে৷ পরবর্তীকালে জম্মু-কাশ্মীরের সালাল জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও তুলবুল প্রকল্প নিয়ে বিবাদ আপোষে মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে৷ সিন্ধু নদের জলপ্রবাহ নিয়ে অবশ্য বিশ্বব্যাংকের প্রকৌশলগত সহায়তা মেনে নিয়েছে৷ কারণ এতে বিশ্বব্যাংকের অর্থ সাহায্য রয়েছে৷
প্রতিবেদনটি কেমন লাগলো বন্ধু? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷