কলকাতার কিছু ব্রিজ বিপজ্জনক, কেন মিটছে না সমস্যা
৯ ডিসেম্বর ২০২১মাঝেরহাট ব্রিজ ভেঙে পড়ার পরে কলকাতার একাধিক ফ্লাইওভার এবং সেতুর স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত কমিটি। সব মিলিয়ে শহরের প্রায় ২০টি সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার কথা বলেছিলেন তারা। জানিয়েছিলেন, ওই ২০টি সেতুর অবস্থা বিপজ্জনক। যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। মাঝে কেটে গেছে তিন বছর। পুরসভা নির্বাচনের আগে কী অবস্থায় আছে কলকাতার একাধিক সেতু এবং ফ্লাইওভার, তা সরেজমিন ঘুরে দেখেছে ডিডাব্লিউ। আমাদের অনুসন্ধানে বেশ কিছু সমস্যা যেমন উঠে এসেছে, তেমনই বেশ কিছু সদর্থক দিকও চোখে পড়েছে। তবে ঘটনা হলো, এখনো বেশ কয়েকটি ব্রিজের অবস্থা খারাপ।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
কলকাতার বেশ কয়েকটি ব্রিজ বিপর্যয়ের তদন্ত করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক এবং ব্রিজ বিশেষজ্ঞ সোমনাথ ঘোষ। মাঝেরহাট ব্রিজ ভেঙে পড়ার পরে তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, কীভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেতুটি দুর্বল হয়ে পড়েছিল। বছরখানেক আগে কলকাতার বউবাজারে মেট্রো রেলের কাজে দুর্ঘটনার পরেও তিনি তদন্ত করেছিলেন। পুরনির্বাচনের আগে ডিডাব্লিউকে তিনি জানিয়েছেন, সরকারকে তারা একাধিক বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তার বেশ কিছু রূপায়ণ হয়েছে। তার কথায়, ''আমরা যে পরামর্শগুলি দিয়েছিলাম, তার বেশ কয়েকটি কাজ ইতিমধ্যেই হয়েছে। কিছু কাজ করতে সময় লাগবে। তবে দৃশ্যত কলকাতার ব্রিজ এবং উড়ালপুলের স্বাস্থ্য আগের চেয়ে ভালো হয়েছে।''
কলকাতার একাধিক ব্রিজের দায়িত্বে থাকা কেএমডিএ-র এক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গেও কথা বলেছে ডিডাব্লিউ। সরকারি চাকরির কারণে তার নামপ্রকাশের অনুমতি নেই। ডিডাব্লিউকে তিনি জানিয়েছেন, ''বেশ কয়েকটি ব্রিজের মেরামতি শেষ হয়েছে। টালার মতো কয়েকটি ব্রিজের কাজ এখনো চলছে। আগামী কয়েকবছরের মধ্যে পুরনো ব্রিজগুলির অধিকাংশই সারিয়ে ফেলা যাবে।''
সমস্যার দিকগুলি
একাধিক সেতুতে যে কাজ চলছে, তা আমাদের ক্যামেরাতেও ধরা পড়েছে। কিন্তু ব্রিজের রক্ষণাবেক্ষণে এখনো যে কিছু সমস্যা আছে, তাও উঠে এসেছে আমাদের ক্যামেরায়। উল্টোডাঙা ব্রিজে ক্ষত তৈরি হয়েছে। বছরকয়েক আগে এই ব্রিজ ভেঙে পড়েছিল। প্রাণহানিও হয়েছিল। বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকার পর সেই ব্রিজ খুললেও এখনো সেখানে ফাটল আছে। যা যে কোনো সময় বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। যে ব্রিজে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানে এই ধরনের ফাটল রক্ষণাবেক্ষণ ও নিয়মিত নজরদারি নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয়।
কলকাতার দীর্ঘতম উড়ালপুল 'মা'তে বট গাছ গজিয়েছে। চিংড়িহাটা উড়ালুপলেও ফাটল তৈরি হয়েছে। এছাড়াও শিয়ালদহ উড়ালপুলের মতো পুরনো ব্রিজগুলির অবস্থাও খুব ভালো নয়। কোথাও বটগাছ গজিয়েছে, কোথাও বড় ফাটল চোখে পড়েছে।কোনো কোনো ব্রিজে গাড়ির লোড সেতুর বহনক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি।
কেন সমস্যা মিটছে না
কেএমডিএ-এর ইঞ্জিনিয়ারের বক্তব্য, একসঙ্গে সবকটি ব্রিজে কাজ করা মুশকিল। বিশেষ করে ব্যস্ত ব্রিজগুলি দীর্ঘদিনের জন্য বন্ধ করে কাজ করা কঠিন। টালা ব্রিজ বন্ধ রেখে কাজ করার জন্য উত্তর কলকাতায় গাড়ি চলাচলে সমস্যা হচ্ছে। মাঝেরহাট ব্রিজ তৈরির সময় দক্ষিণ কলকাতায় যানজট তৈরি হয়েছে। ফলে সব দিক মাথায় রেখে এক একেকটি করে ব্রিজ ধরা হচ্ছে। সমস্ত কাজ শেষ হতে সময় লাগবে।
ব্রিজ বিশেষজ্ঞ ইন্দ্রনীল রায় ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''বিপজ্জনক ব্রিজগুলির মেরামত করতেই হবে। কারণ, যে কোনো সময় বড় বিপদ ঘটতে পারে। তবে তার চেয়েও জরুরি সব সময়ের জন্য একটি মনিটারিং কমিটি তৈরি রাখা। যারা নিয়মিত ব্রিজগুলির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবে এবং ব্রিজগুলির রক্ষণাবেক্ষণ বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দেবে।'' ইন্দ্রনীলের মতে, বড় কোনো ঘটনা ঘটলে তখন মনিটারিং কমিটি তৈরি করা হয়। তারপর তা নিয়ে আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়। যে ব্রিজে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেই ব্রিজই তখন ফোকাসে চলে আসে। অন্য ব্রিজগুলি আলোচনার বাইরে চলে যায়। এই মানসিকতা বদলানো দরকার।
ইন্দ্রনীলের সঙ্গে সহমত সোমনাথ ঘোষ। তিনিও মনে করেন, নিয়মিত ব্রিজগুলির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মনিটারিং কমিটি তৈরি রাখা দরকার। তবে ব্রিজগুলির অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে বলেই মত সোমনাথের।
ইন্দ্রনীল এবং সোমনাথ দুইজনেই মনে করেন, ব্রিজের বহন ক্ষমতার দিকেও নজর দেওয়া দরকার। বেশ কয়েকটি ব্রিজে হাইটবার লাগিয়ে বড় গাড়ির যাতায়াত বন্ধ করা গেলেও সব সেতুতে তা সম্ভব হয়নি। দ্রুত সেই কাজটি করে ফেলা দরকার।
কলকাতা পুলিশ অবশ্য জানিয়েছে, ব্রিজে দুর্ঘটনা কমানোর জন্য কয়েকটি জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বহু উড়ালপুল রাতের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এখন বন্ধ রাখা হয়। ওই সময়ে সেতুর রক্ষাণাবেক্ষণের কাজও হয়। তবে বেশ কিছু ব্রিজ যে এখনো বিপজ্জনক তা মেনে নিয়েছে পুলিশ এবং কেএমডিএ। নতুন পুর-প্রশাসন এলে সে দিকে নজর দেয় কি না, সেটাই এখন দেখার।