করোনা-সংকটে বাংলাদেশের ক্রিকেট
৩১ জুলাই ২০২০আট বছর পর টোয়েন্টি টোয়েন্টিতে এসে চ্যাপেলদের বড় ভাইয়ের সেই কথাটা খুব মনে পড়ছে৷
কথাটা বলেছিলেন ২০১২ সালে শ্রীলঙ্কায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময়৷ সংক্ষিপ্ততর হওয়ার আগে টি-টোয়েন্টি তখন টোয়েন্টি-টোয়েন্টি নামেই পরিচিত ছিল৷ বিশ্ব ক্রিকেটে রীতিমতো যেটির দামামা বাজছে৷ দেশে দেশে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ শুরু হয়ে গেছে৷ আইসিসিও সোনার ডিম পাড়া হাঁসের সন্ধান পেয়ে ছয় বছরের মধ্যে টি-টোয়েন্টির চতুর্থ বিশ্বকাপ নামিয়ে ফেলেছে৷ এসব দেখেই ওই স্টোরির চিন্তাটা মাথায় এসেছিল৷ ২০২০ সাল, অর্থাৎ টোয়েন্টি টোয়েন্টিতে ক্রিকেট কি তাহলে শুধুই টোয়েন্টি-টোয়েন্টির হয়ে যাবে? বিশেষজ্ঞরা কী বলেন? সেটি জানতেই ওয়াসিম আকরাম, ডেভ হোয়াটমোর, ইয়ান চ্যাপেলদের শরণাপন্ন৷ চ্যাপেলের উত্তরটাই ছিল সবচেয়ে ব্যতিক্রমী এবং কী আশ্চর্য, ২০২০ সালে এসে তাঁর কথাটা কেমন ভিন্ন একটা তাৎপর্য নিয়েই না দেখা দিচ্ছে! যখন সব কিছু ছাপিয়ে বেঁচে থাকাটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মানবজাতির সামনে বড় এক চ্যালেঞ্জ৷
বিশ্বযুদ্ধ ছাড়া এমন বিশ্বজনীন চ্যালেঞ্জের মুখে মানুষ আর কখনো পড়েছে বলে মনে হয় না৷ বিশ্বযুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধও কি বিশ্বের প্রতিটি কোণকে এভাবে স্পর্শ করতে পেরেছিল! ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অদৃশ্য এক শত্রু সবকিছুকেই যেখানে বদলে দিয়েছে, খেলা আর সেটির বাইরে থাকে কিভাবে! পজ বাটন টিপে দিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকা খেলাধুলার পৃথিবীকেও স্থবির করে দিয়েছে করোনা৷ স্থগিত হয়ে যাওয়া অলিম্পিক গেমস ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চলে গেছে বেজোড় বর্ষে, অলিম্পিকের মতোই এক বছর পিছিয়ে গেছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, বাতিল হয়ে গেছে টেনিসের গ্র্যান্ড স্লাম, সাইক্লিংয়ের ট্যুর ডি ফ্রান্স, আরো কত কী....! বড় বড় কয়েকটা ক্রীড়া আসরের কথাই শুধু বললাম৷ অপমৃত্যুর পুরো তালিকা করতে গেলে সেটি আর শেষ হবে না৷
কোমায় চলে যাওয়া বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন অবশ্য আবার চোখ মেলেছে৷ চোখ মেলেছে নিউ নরম্যাল যুগে৷ টেলিভিশন রাজস্বের অমোঘ টানে শূন্য গ্যালারিতে ফুটবল শুরু হয়েছে, ‘বায়ো-সিকিউর এনভায়রনমেন্ট’ শব্দবন্ধের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে ক্রিকেট শুরু করে দিয়েছে ইংল্যান্ড৷ বদলে যাওয়া পৃথিবীতে কীভাবে ক্রিকেট সম্ভব, তার একটা মডেলও দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ক্রিকেট বিশ্বের সামনে৷ এখন খেলতে চাইলে এভাবেই খেলতে হবে৷ ক্রিকেটার-আম্পায়ার-মাঠকর্মীদের বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন রেখে শূন্য গ্যালারির সামনে খেলাটাই হয়তো নিয়ম হতে যাচ্ছে আগামী কিছুদিনের জন্য৷ কিন্তু এই ‘আগামী কিছুদিন’ মানে কতদিন? আসলে তো সেটি অনির্দিষ্টকাল৷ সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, চাইলেই কি এই 'ইংলিশ মডেল' অনুসরণ করতে পারবে বাকি দেশগুলো?
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ইংল্যান্ডের টেস্ট সিরিজ হয়েছে শুধুই দুটি মাঠে৷ সাউদাম্পটনের অ্যাজিয়াস বোওলে প্রথম টেস্টের পর পরের দুটি টেস্টই ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ডে৷ এক সিরিজের পরপর দুটি টেস্ট একই মাঠে, এটাও তো মনে হয় অদৃষ্টপূর্বই৷ ইংল্যান্ডে আরও টেস্ট ভেন্যু থাকার পরও দুই মাঠেই তিন টেস্ট হওয়ার একটাই কারণ৷ এই দুটি স্টেডিয়ামেই পাঁচ তারকা হোটেল আছে৷ হোটেল থেকে সরাসরি মাঠে নেমে যাওয়ার সুবিধাই ওই বায়ো সিকিউরিটির জন্য কোনো হুমকি হতে পারেনি৷ কিন্তু আর কোন দেশে এই সুবিধা আছে? অন্তত বাংলাদেশে যে নেই, এটা তো আমাদের জানাই৷ পুরো ক্রিকেট বিশ্বের জন্যই সর্বজনীন এই সংকট বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য তাই আরো অনেক বড়৷
সেটিতে আসার আগে চলুন, রিওয়াইন্ড করে একটু ৬ মার্চের সিলেট ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামে ফিরে যাই৷ বাংলাদেশের ক্রিকেটের মহানায়ক মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা অধিনায়ক হিসাবে শেষ ম্যাচ খেললেন৷ বিদায়ী অধিনায়ককে মধ্যমণি করে জিম্বাবোয়েকে ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করার আনন্দ গায়ে মেখে মাঠ থেকে বেরোচ্ছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা৷ তখন তাঁরা কিভাবে কল্পনা করবেন, আবার মাঠে নামার জন্য কেমন হাপিত্যেস করে মরতে হবে!
এখন ভাবলে কেমন অবাস্তব বলে মনে হয়, তখন চিন্তাটা ছিল একেবারেই ভিন্ন৷ সামনে একের পর এক সিরিজ, এই বছর তো দম ফেলার ফুসরতও পাওয়া যাবে না! অসমাপ্ত টেস্ট সিরিজ শেষ করতে কিছুদিন পরই আবার পাকিস্তানে যাওয়ার কথা, সঙ্গে ছিল একটা ওয়ানডেও৷ শ্রীলঙ্কা সফর নির্ধারিত হয়ে ছিল, দেশে আতিথ্য দেওয়ার কথা ছিল নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াকে৷ এর সঙ্গে আবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ৷ সেই টানা খেলার সূচির বদলে এখন যে পরিস্থিতি, তাতে এ বছর বাংলাদেশ দলের আর মাঠে নামা নিয়েই সংশয়৷ স্থগিত হয়ে গেছে সব কটি সিরিজই৷ সেসব কবে হবে, আদৌ আর হবে কিনা, ফণা তুলছে এই প্রশ্নটাও৷ এই করোনাকাল একদিন না একদিন শেষ হবেই, কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটে সেটি নিশ্চিতভাবেই রেখে যাবে দীর্ঘস্থায়ী এক ছাপ৷ খেলার চেয়ে বাণিজ্যটাই মুখ্য হয়ে ওঠায় 'বড় দল'গুলো এমনিতেই বাংলাদেশের বিপক্ষে না পারতে খেলে৷ করোনাসৃষ্ট জটের কারণে সেটি চলে যাবে অগ্রাধিকার তালিকার আরো অনেক পেছনে৷ টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর প্রায় বিশ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট সিরিজ খেলতে পেরেছে মাত্র একটি, ইংল্যান্ড আমন্ত্রণ জানিয়েছে মাত্র দুইবার৷ পাশের দেশ ভারতে পর্যন্ত দুবারের বেশি টেস্ট খেলতে যাওয়ার সুযোগ মেলেনি৷ আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ তাই একটা আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল বাংলাদেশের জন্য৷ নিয়মিত টেস্ট খেলার নিশ্চয়তা দেওয়া সেই চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু হতে না হতেই এই বিপর্যয়৷ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পুরো সূচিই আবার হয়তো নতুন করে সাজানো হবে৷ নামআইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ হলে কি হবে, খেলার সূচি তো আগের মতোই দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার ওপর নির্ভরশীল৷ করোনায় হারিয়ে যাওয়া সময়টার ক্ষতিপূরণ করতে স্বাভাবিকভাবেই সবাই সবার নিজেদের স্বার্থ আগে ভাববে৷ বাংলাদেশের ভালো-মন্দ নিয়ে বাকি দেশগুলো মাথা ঘামাবে, এমন প্রত্যাশা করলে বুঝতে হবে, আপনি এই দিনদুনিয়ার বাইরের মানুষ৷
সফরে যাওয়ার পূর্বশর্ত স্বাগতিক দলের আগ্রহ, সেটি তাই পুরোপুরি বাংলাদেশের হাতে নেই৷ নিজেরা স্বাগতিক হয়ে কাজটা একটু কম কঠিন করা যায়, কিন্তু সে জন্য তো বাংলাদেশের পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হতে হবে৷ নিকট ভবিষ্যতে সেটি হবে কি না, এটা এখন কোটি টাকার প্রশ্ন৷ করোনা এখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই দেশে৷ প্রায় চার মাস গৃহবন্দি থাকার পর ক্রিকেটাররা সম্প্রতি স্টেডিয়ামে ঢোকার অনুমতি পেয়েছেন৷ মিরপুর, চট্টগ্রাম ও খুলনায় পাঁচ-ছয়জন ক্রিকেটার ট্রেনিং করতে শুরু করেছেন৷ সেই ট্রেনিংয়েরও আসলে শুধুই শরীরের জং ছাড়ানোর চেয়ে বেশি উপযোগিতা নেই৷ দল বেঁধে ট্রেনিং করার অনুমতি দিতে অনুমিতভাবেই ভয় পাচ্ছে বিসিবি৷ হাতে গোনা যে কজন ক্রিকেটার ট্রেনিং করছেন, তাঁদেরকে সেটি করতে হচ্ছে একা একাই৷
অতীতে অনেকবারই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, বিশেষ করে টেস্ট ক্রিকেটে লম্বা বিরতি পড়েছে বাংলাদেশের খেলায়৷ কেউ বলতেই পারেন, সেই তুলনায় এবারের বিরতি আর এমন কী! মাত্রই তো সাড়ে চার মাস৷ কিন্তু আগের সব বিরতির সঙ্গে এবারেরটা মেলানোর চেষ্টা করাটাই বোকামি৷ তখন ইচ্ছামতো ট্রেনিং করা যেত, সুযোগ ছিল ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলার...তার চেয়েও বড় পার্থক্য, তখন বাংলাদেশের ক্রিকেটারেরা জানতেন, এরপর কবে আবার টেস্ট বা ওয়ানডে খেলতে নামবেন৷ এখন তো তাঁরা সেটিই জানেন না৷
কেউই কি তা জানে?