‘ঐ সময় যাদের জন্মও হয়নি তাদেরও মুক্তিযোদ্ধা...’
১২ ডিসেম্বর ২০১৭ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধারা এখন কেমন আছেন?
আ ক ম মোজাম্মেল হক: আমি মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দেখি তাঁদের৷ আমার দৃষ্টিতে ইনশাল্লাহ তাঁরা ভালো আছেন৷
বাংলাদেশে এখন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাজেট কত?
মুক্তিযোদ্ধাদের ‘ওয়েলফেয়ার'-এর জন্য বাজেট তিন হাজার কোটি টাকার উপরে৷ তবে আমরা আরো কিছু পরিকল্পনা নিয়েছি, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা লাগবে৷ যত জায়গায় পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছে, সেগুলো সংরক্ষণ করা৷ যতগুলো বদ্ধভূমি আছে, সেগুলোরও সংরক্ষণ করা প্রয়োজন৷ প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স গঠন করা, মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘর তৈরি করে দেয়া৷ এছাড়া সোহরাওয়ার্দি উদ্যানকে মুক্তিযুদ্ধের সুতিকাগার হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছি এবং সেটা প্রধানমন্ত্রী অনুমোদনও করেছেন৷
এখন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কত বাংলাদেশে?
বাংলাদেশে এখন ২ লাখ ৩৮ হাজারের মতো মুক্তিযোদ্ধা আছেন৷
মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কেন কমে-বাড়ে?
এখন বাড়ার কারণ হচ্ছে আমরা কিছু ‘ক্রাইটেরিয়া' যোগ করেছি, যেমন বীরাঙ্গনা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যাঁরা কাজ করেছেন, মুজিবনগর সরকারে যত কর্মচারী ছিল এবং যতজন মেডিকেল কোর-এ মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিয়েছেন, তাঁদের সবাইকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করায় এই সংখ্যা বাড়ছে৷ এর সঙ্গে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দিন দিন কমছে৷ অনেকেই সত্যি সত্যি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, তাদের বাদ দেয়া হচ্ছে৷ তবে এ মুহূর্তে আদালতের নির্দেশের কারণে অনেকগুলো কাজ আটকে আছে৷ আমরা এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছি না৷
আপনি কয়েকদিন আগে সংসদে বলেছেন যে আদালত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাঁদের নাম তালিকাভুক্ত করতে বলেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের অনেকের বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর৷ বিষয়টা একটু ব্যাখা করবেন?
শুধু পাঁচ বছর না, যাদের জন্মই হয়নি তাদেরও করতে বলেছে৷ এ বিষয়ে আমি শিগগিরই কথা বলব৷ এটা কোনোভাবেই ১০২ নম্বর আর্টিকেলে পড়ে না৷ সংবিধানের ১০২ নম্বর আর্টিকেলে বলা আছে, মানুষের মৌলিক অধিকার বা জন্মগত অধিকারের কথা৷ কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হওয়া কোনো মৌলিক অধিকার না, এটা অর্জিত অধিকার৷ ১০২ ধারায় মামলা যেভাবে নেয়া হচ্ছে, আমি মনে করি এটা এই ধারায় পড়ে না৷ আসলে এটার অপপ্রয়োগ হচ্ছে৷ এ ব্যাপারে আমরা আইনজীবীদের মতামত নিচ্ছি৷ পরবর্তীতে বিষয়টা আমরা জাতির সামনে তুলে ধরব৷
জাল সার্টিফিকেট নিয়ে কয়েকজন সচিবও ধরা পড়েছেন৷ এদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
তাদের চাকরি চলে গেছে৷ তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে৷ তাদের ‘প্রভিডেন্ট ফান্ড' আটকে গেছে৷ আমরা তাদের চাকরিচ্যুত করতে পারি, আর্থিক দণ্ড দিতে পারি....সেই কাজগুলোই করেছি৷
মুক্তিযোদ্ধাদের জাল সার্টিফিকেট রোধে মন্ত্রণালয় কী ব্যবস্থা নিয়েছে?
এগুলো অধিকাংশই নিজেরা তৈরি করে নিয়েছে৷ অবিকল মন্ত্রণালয়ের কাগজ জাল করে সার্টিফিকেট তৈরি করে নিয়েছে এরা৷ আবার আমাদের কেউ-ও তাদের এই কাগজ ‘সাপ্লাই' দিয়ে থাকতে পারে৷ এখন আমরা পুরো তালিকা ওয়েবসাইটে দিয়েছি৷ যাদের নাম বাদ গেছে, তারা অবেদন করলে যাচাই-বাছাই করে আমরা তাদের নাম যুক্ত করে দেবো৷ এর বাইরে আর কোনো তালিকা নেই৷ অন্য যারা আছে, তাদেরগুলো আমরা বাতিল বলে ঘোষণা করেছি৷
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেটের মাধ্যমে অনেক ছেলে-মেয়ের চাকরি হয়েছে৷ তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে?
এ ব্যাপারে আমরা সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে নোট দিয়েছি যে, এমন কেউ থাকলে তাকে যেন চাকরিচ্যুত করা হয়৷ শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় এবং ফৌজদারি মামলা করার জন্যও অনুরোধ করেছি আমরা৷
সরকার তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে কাজ করছে৷ কিন্তু চেতনাবিরোধী শক্তিই তো মনে হচ্ছে শক্তিশালী৷ এর কারণ কী?
মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে শতকরা ৩০ ভাগ লোক ১৯৭০ সালেও ছিল৷ তখন কিন্তু এই ৩০ ভাগ মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়নি৷ সেই ৩০ ভাগ জামায়াতে ইসলাম, আল-বদর, আল-শামস, মুসলিম লীগে রয়ে গেছে৷ তারা তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না৷ তাই তারা রয়ে গেছে৷ দুঃখের বিষয়, এদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে এমন কিছু লোকও দলে ঢুকেছে৷ তিনভাগের এক ভাগ লোক তো সবসময় ছিল, এখনো আছে৷ তবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কতভাগ মানুষ সেটা ব্যালটের মাধ্যমে ঠিক হয়৷ মিছিল-মিটিং করে কতভাগ নাগরিক? এক বছরের মধ্যে তো নির্বাচন৷ তখন জাতিই প্রমাণ করবে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে না বিপক্ষে৷
এখনো পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী লেখা পাওয়া যাচ্ছে কেন?
এটা স্বাধীন দেশ, আদালত তো আরো স্বাধীন৷ দুর্নীতিবাজরা আদালতে গেলেই প্রথম শুনানিতে যে সুবিধা পায়, সেটা হলো – আইনের কথা অনুযায়ী ধরে নিতে হবে যে অভিযুক্ত ব্যক্তি নিদোষ৷ আইন ব্যবস্থার কারণে এটা প্রমাণ করাও কঠিন৷ পত্রিকায় লেখা যেমন সহজ, প্রমাণ করা ততটাই কঠিন৷ আমাকে কেউ ঘুস দিলে সে কি প্রমাণ রেখে কাজটা করবে?
এখনো অনেক স্কুল ও মাদ্রাসায় জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয় না, মন্ত্রণালয় কি এটা জানে?
আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ বিষয়ে তাগিদ দিয়েছি৷ বলেছি বিষয়টার দিতে লক্ষ্য রাখতে৷ প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় সংগীত গাওয়া, জাতীয় পতাকা উড়ানো প্রাক ঐতিহাসিক যুগ থেকে চলে আসছে৷ তাই কেউ যদি জাতীয় পতাকা না তোলে তাহলে সেটা আইনবিরোধী কাজ৷ এখন মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটিতেও সরকারের লোক আছে৷ তাঁরা নিশ্চয় বিষয়টা দেখবে৷ আগে মাদ্রাসাগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল না৷ এখন সরকার তাদের অনুদান দিচ্ছে, অনুমোদনও দিচ্ছে৷ তাই কেউ সংবিধান অমান্য করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে সরকারই৷
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রসারে সরকার কী করছে?
এটা করতে হবে একেবারে শিশুকাল থেকে৷ কারণ একবার শিশুদের মগজে অন্যকিছু ঢুকে গেলে, তা বের করা কঠিন৷ এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে আমি সরকারকে পরামর্শ দেব, একেবারে শিশুকাল থেকে যেন প্রতিটি নাগরিক মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বড় হয়ে উঠে৷ আমাদের দুর্ভাগ্য যে দেশে এমন মানুষও আছে, যারা রাষ্ট্রের সৃষ্টিই মানে না৷ যেমন জামায়াতে ইসলামী কখনও বলেনি মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল৷ কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তো ভুল হতে পারে৷ কিন্তু এখনও সুযোগ পেলে তারা বলে যে, তাদের সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল৷ দেশের স্বাধীনতা, স্বার্বভৌমত্ব এখনো তারা মেনে নেয়নি৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷