একা লড়ছেন কেজরিওয়াল
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০দক্ষিণ দিল্লির গোবিন্দপুরির বাজার এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল অরবিন্দ কেজরিওয়ালের রোড শো৷ হলুদ রঙা গাড়ির মাথায় কেজরিওয়াল৷ কখনও বাঁ হাত তুলে নাড়ছেন, পরের মুহূর্তেই উঠছে ডান হাত৷ দোকান থেকে লোকে রাস্তায় নেমে পড়েছেন৷ দোকানের ওপরে বাড়ির বারান্দায়, ছাদে জড়ো হয়েছেন অনেকে৷ কেজরিওয়াল তাঁদের দিকে হাত নাড়তেই, তাঁরাও অভিবাদন জানাতে শুরু করলেন মুখ্যমন্ত্রীকে৷ কেজরিওয়ালের গাড়ির সামনে ব্যান্ড বাজছে৷ পিছনের একাধিক গাড়ি থেকে তারস্বরে গান বাজছে, ‘আচ্ছে বিতে পাঁচ সাল, লাগে রহো কেজরিওয়াল’, সহজ বাংলায় যার অর্থ, 'গত পঁচ বছর খুব ভালো কেটেছে, কেজরিওয়াল আপনি এভাবেই লেগে থাকুন’৷
জনসমর্থন দেখে কেজরিওযালের মুখে মৃদু হাসি৷ গলায় মার্কামারা মাফলার৷ দিল্লির শীতে গলা যাতে খারাপ না হয়, তার ব্যবস্থা৷ গতবারের তুলনায় ফরাক হল, নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি। মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ির ওপরে ভিড় করে নিরাপত্তারক্ষীরা৷ প্রার্থী অতিশি কোনওরকমে একটু জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে৷ গাড়ি ঘিরে বা পুরো রোড শোতে অসংখ্য পুলিশ৷ কেজরিওয়ালের মুখের হাসি আরেকটু চওড়া হল, যখন তিনি দেখতে পেলেন, বেশ কিছু লোক তাঁর গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছেন, তাঁকে ভালো করে দেখার জন্য৷
কেজরিওয়ালের পিছনে চলেছে প্রায় দেড় কিলোমিটার লম্বা মিছিল৷ আপ সদস্য ও সমর্থকদের৷ তার মধ্যে প্রচুর ব্যাটারি চালিত অটো, দিল্লিতে যাকে বলা হয় টোটো৷ গতবার আম আদমি পার্টির বাহন ছিল অটো, এ বার তা বদলে হয়েছে টোটো৷ 'লাগে রহো কেজরিওয়াল' গানের সঙ্গে হাততালি দিতে দিতে চলেছেন দলের কর্মী, সমর্থকরা৷ রীতিমতো বিশাল মিছিল৷ পাঁচ বছর আগে এই ধরনের প্রচারে বা আপের অফিসে দেখা মিলত দেশ এমনকি, বিদেশ থেকে আসা সমর্থকদের৷ বহুজাতিক সংস্থার চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে তাঁরা এসেছিলেন কেজরিওয়ালকে জেতাতে৷ এ বার তাঁরা কেউ নেই৷ নেই প্রশান্ত ভূষণ, দেবেন্দ্র যাদব, মায়াঙ্ক গান্ধী, সন্তোষ হেগড়ে, কুমার বিশ্বাসরা৷ গত পাঁচ বছরের সব চেয়ে বড় পরিবর্তন হল, আপ মানে এখন শুধুই কেজরিওয়াল৷ দেশের এক নেতা বা নেত্রী শাসিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আপও একই সারিতে দাঁড়িয়ে৷
গোবিন্দপুরির ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে কেজরিওয়ালের রোড শো চলে গেল৷ গত সাত-আট বছর ধরে ভোট এলেই রোড শো হয়ে দাঁড়িয়েছে জনসংযোগের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার৷ কয়েক ঘন্টার মধ্যে হাজার হাজার লোকের কাছে পৌঁছনোর সুযোগ। তবে এখানে নেতা বা নেত্রীর ভাষণ সচরাচর থাকে না। শুধু তাঁদের ক্ষণিকের দর্শন মেলে৷ কেজরিওয়ালের দর্শনের জন্য দৌড় লাগিয়েছিলেন বছর পঁয়ত্রিশের অমিতাভ৷ বাজারে নিজের দোকান ফেলে৷ কেন দৌড় লাগালেন? প্রশ্নের জবাব আসতে দেরি হল না। আবেগতাড়িত অমিতাভ বললেন, ‘‘গরিবদের জন্য প্রচুর করেছেন কেজরিওয়াল৷ বিদ্যুৎ, জলের জন্য তো পয়সা লাগে না। মহল্লা ক্লিনিকে চিকিৎসা, ওষুধ ফ্রি৷ আমার ছেলে সরকারি স্কুলে পড়ে৷ একবার গিয়ে দেখে আসবেন, সেই স্কুলকে কী বানিয়ে দিয়েছেন তিনি৷ তাঁকে ভালো করে দেখব না?'' পাশে দাঁড়ানো জনা পাঁচেক লোক সম্মতিসূচক মাথা নাড়তে থাকলেন৷ গরিব মানুষের এই মনোভাব হল কেজরিওয়ালের শক্ত জমি, যার জোরে তিনি তৃতীয়বার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন৷ যার জোরে বলতে পারছেন, ‘‘৭০ বছরে প্রথমবার কোনও সরকার শুধু নিজের সাফল্যের প্রচার করছে ভোটে৷’’
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর এই দাবি কি ঠিক? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনও সন্দেহ নেই, শুধু সাফল্যের প্রচার দিয়েই শুরু হয়েছিল কেজরিওয়াল তথা আপের প্রচার৷ পুরোপুরি ইতিবাচক৷ কিন্তু বিজেপি দিল্লিতে মেরুকরণের লক্ষ্যে যতই সুর চড়িয়েছে, ততই তার প্রভাব পড়েছে জনমানসে, ততই বদলে গিয়েছে কেজরিওয়ালের প্রচারের ধরণ. কথাবার্তাও৷ যার পরিষ্কার ছবি দেখা গেল, বুধবার রাতে কেজরওয়ালের নির্বাচন কেন্দ্র নয়াদিল্লিতে৷ দিল্লি জুড়ে প্রচারের পর নিজের কেন্দ্রে এসেছেন কেজরিওয়াল৷ সামনে ঠাসা ভিড়৷ মঞ্চে উঠতেই বিশাল মালা পরানো হল তাঁকে৷ হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল গদা৷ যা শোভা পায় রামভক্ত হনুমান বা বজরঙ্গবলীর হাতে৷ গদা ওপরে তুলে ধরলেন কেজরিওয়াল৷ তাঁর কথায় এখন হামেশাই উঠে আসছে হনুমান চালিশার কথা৷ তিনি বুধবারও বলেছেন, ''আমি হনুমান চালিশা পড়ি৷ মন শান্ত হয়৷ আমি তো বিজেপি নেতাদের বলব, হনুমান চালিশা পড়তে৷ পড়লে তাঁরা কুকথা বলা বন্ধ করবেন৷'' এমনকী কেজরিওয়ালের মুখে এখন উঠে আসছে শাহিনবাগের কথাও৷ তিনি বলছেন, ''বন্ধ রাস্তা খুলে দিন অমিত শাহ৷ চাইলে তিনি পনেরো মিনিটেই তা করতে পারেন৷ আধঘন্টায় যে জায়গায় যাওয়া যেত, রাস্তা বন্ধ থাকায় স্কুল বাস, অ্যাম্বুলেন্স থেকে শুরু করে সব ধরনের বাহন যেতে সময় লাগছে তিন ঘন্টা৷’’
বোঝা যাচ্ছে, বিজেপির প্রচারের জবাব দিতে বাধ্য হচ্ছেন কেজরিওয়াল৷ নিজের সাফল্যের বাইরে গিয়ে বজরঙ্গবলীর গদা হাতে তুলতে হচ্ছে৷ নয়াদিল্লির জনসভায় এসেছিলেন, বিজেপির সমর্থক রমেশ৷ বরাবর তাঁর ভোট পড়ে পদ্মে৷ কেজরিওয়ালের হাতে গদার প্রসঙ্গ তুলতেই তাঁর জবাব, ‘‘লড়াই অত সহজ নয়৷ বিজেপির প্রচার গতি পেতেই দেখুন কী অবস্থা হয়েছে৷ হাতে হনুমানের গদা, মুখে হনুমান চালিশা৷ কেজরিওয়ালের হলটা কী? এই প্রথম রীতিমতো কঠিন লড়াইয়ের মুখে পড়েছেন কেজরিওয়াল৷ কথাটা মিলিয়ে নেবেন৷’’
একদিকে মোদী-শাহ, ৭০ জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, ২৪০ জন সাংসদ, দশজন মুখ্যমন্ত্রী, অন্য রাজ্য থেকে আসা কর্মীদল, মেরুকরণ, অন্যদিকে কার্যত একা কেজরিওয়াল৷ এরপরেও দিল্লি দখলের লড়াইয়ে যদি জিততে পারেন এই ছোটখাট চেহারার আপ নেতা, তা হলে তঁর রাজনৈতিক উচ্চতা বেড়ে যাবে অনেক গুণ৷