উত্তর মেরু সাগরে বরফের রহস্য
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০অভিযানের মাঝেই ক্রিস্টিয়ান হাস বিপুল পরিমাণ সংগৃহিত তথ্য নিয়ে মূল ভূখণ্ডে ফিরে এসেছেন৷ সেই সব তথ্য বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত জরুরি৷ উত্তর মেরু অঞ্চলে বরফের পরিবর্তনের রহস্য উন্মোচনের লক্ষ্যে তিনি এরই মধ্যে কিছু প্রাথমিক উত্তর পেয়েছেন৷ হাস বলেন, ‘‘সেই অঞ্চলে পৌঁছনোর পর বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করলাম, যে অক্টোবর মাসে বরফ মাত্র ৩০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার পুরু ছিল৷ শীতকালে, অর্থাৎ, এর পরের পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যে সেই স্তর বেড়ে প্রায় ২ মিটার ছুঁয়েছে৷ মোটকথা বরফের চাদর প্রায় চার গুণ বড় হয়েছে৷ এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ৷’’
এতদিন জানা ছিল, যে শুধু বরফের উপরিভাগ ছোট হচ্ছে৷ বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তোলা ছবিতে দেখা গেছে, যে গত ৪০ বছরে বরফের অংশ প্রায় অর্ধেক কমে গেছে৷ তবে স্যাটেলাইট বরফের গভীরতা মাপতে পারে না৷ নতুন আবিষ্কার সম্পর্কে ক্রিস্টিয়ান হাস বলেন, ‘‘আমরা এখন যা দেখলাম, তা হলো গ্রীষ্মের শেষে মরসুমের শুরুতে বরফ বেশ পাতলা ছিল৷ ৩০ বছর আগে নব্বইয়ের দশকে সাইবেরিয়ার মেরু অঞ্চলে পরিমাপ করে পাওয়া তথ্যের তুলনায় অনেক বেশি পাতলা হয়ে গেছে৷ তবে বরফ এত বেড়ে গেছে দেখে আমরা বেশ অবাক হয়েছি৷ অর্থাৎ, শীতের শেষে বরফের চাদরে তেমন কোনো পরিবর্তন হয় নি বলা চলে৷ গ্রীষ্মে শুধু বরফের উপরিভাগে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন চোখে পড়ে না, বরফের গভীরতার ক্ষেত্রেও সেটা দেখা যায়৷ শীতকালে বরফ সেই ধাক্কা বেশ ভালোভাবেই সামলে নেয়৷’’
গ্রীষ্মের শেষে বরফ এত পাতলা হয়ে যাবার কারণে শীতে যে আবার পুরু হতে সাহায্য করে, সেটা বেশ অদ্ভুত বিষয়৷ হাস মনে করেন, ‘‘অপেক্ষাকৃত পাতলা বরফ মহাসাগরকে আরও দ্রুত ও আরও সহজভাবে উত্তাপ হারাতে বাধ্য করে৷ এর ফলে আবার আরও বরফ সৃষ্টি হয়৷ শীতের শেষে বরফের পুরুত্ব তিরিশ বছর আগের মতোই হয়ে যায়৷’’
এমন প্রবণতা সত্ত্বেও গ্রীষ্মে পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে৷ সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী ২০৫০ সালে উত্তর মেরু অঞ্চলে সম্ভবত কোনো বরফই দেখা যাবে না৷
জার্মানির ব্রেমারহাফেন শহরে আলফ্রেড ভেগেনার ইনস্টিটিউটের বরফ ল্যাবে মাইনাস ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার স্থিতিশীল শীতল পরিবেশ রাখা হয়৷ এরই মধ্যে সেখানে উত্তর মেরু অভিযানে সংগৃহিত বরফের কিছু নমুনা আনা হয়েছে৷ পোলারাইজড লাইটের নীচে বরফের স্ফটিক চমচক করছে৷ সমুদ্রবিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান হাস বলেন, ‘‘একমাত্র এমন পাতলা স্তর প্রস্তুত করলেই বরফের বিবর্তনের প্রক্রিয়া চোখে দেখা যায়৷ শান্ত পরিবেশে ধীরে ধীরে উপর থেকে নীচে বরফ সৃষ্টি হয়েছে কি না, তা জানা যায়৷ সে ক্ষেত্রে এমন লম্বা থামের মতো ক্রিস্টাল সৃষ্টি হয়৷ বর্তমানে শক্তিশালী ঢেউ ও পানির আলোড়নের কারণেও বরফ সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে৷ সে ক্ষেত্রে ছোট, গোল ক্রিস্টাল তৈরি হয়৷’’
ভবিষ্যতে উত্তর মেরু সাগর আরও উত্তাল হয়ে উঠবে বলে ক্রিস্টিয়ান হাস মনে করেন৷ তখন আর লম্বা থামের মতো বরফের স্ফটিক তৈরির উপায় থাকবে না৷ কারণ পরিবর্তনশীল বরফের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর মেরু সাগরের অবস্থাও বদলে যাচ্ছে৷
সে ক্ষেত্রে দানাদার বরফ আরও বেশি দেখা যাবে৷ সে কারণেও উত্তর মেরু অঞ্চলকে আরও ভালো করে বোঝা প্রয়োজন৷ হাস বলেন, ‘‘ছোট ক্রিস্টাল আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যে বড় কোনো কাঠামো আসলে ছোট ছোট উপাদান দিয়ে তৈরি৷ পৃথিবী, মহাকাশ ও ছোট অণু থেকে সেগুলির উৎপত্তি৷ সে সবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে৷’’
বিশাল পরিমাণ বরফ থেকে ছোট ও চকমকে এক জগত পৃথিবীর উত্তরতম প্রান্তে বিকশিত হচ্ছে৷
লেয়া আলব্রেশট/এসবি
২০১৮ সালের ডিসেম্বরের ছবিঘরটি দেখুন...