ভোটাররা কেন কৌতুকাভিনেতাকে ভোট দিলেন?
৮ এপ্রিল ২০১৯সেই চরিত্র দেখেই কি তাঁকে বাস্তবের প্রেসিডেন্ট হিসেবে পেতে চাইছেন ইউক্রেনের ভোটাররা?
২০০১ সালে অনীল কাপুর অভিনীত ভারতের ‘নায়ক' চলচ্চিত্রটি হয়তো অনেকেই দেখেছেন - যেখানে সাংবাদিক থেকে রাতারাতি মুখ্যমন্ত্রী বনে যান অনীল কাপুর৷ অনেকটা এমন পরিণতির গল্প নিয়েই আবর্তিত ইউক্রেনের জনপ্রিয় টিভিশো ‘সার্ভেন্ট অব দি পিপল'৷ এর কেন্দ্রীয় চরিত্র ভাসিলি হলোবরোদকো ইতিহাসের একজন শিক্ষক৷ তাঁর দুর্নীতি বিরোধী বক্তৃতা একসময় বেশ ভাইরাল হয়ে ওঠে, যার পথ ধরে শেষ পর্যন্ত তিনি প্রেসিডেন্ট বনে যান৷ কৌতুকধর্মী চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন ভলোদিমিয়ের জিয়েলইয়েনস্কি৷ এর আগে রাজনীতির সাথে যার কোনো পরিচয়ই ছিল না৷ ইউক্রেনজুড়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় তাঁর অভিনীত টিভি শোটি, জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ভলোদিমিয়েরও৷ সার্ভেন্ট অব দি পিপল নামে তিনি একটি রাজনৈতিক দলই গঠন করে ফেলেন৷ অংশ নেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে৷
প্রথম দফায় বিজয়ী হয়ে পর্দার চরিত্রকে বাস্তবে রূপ দেয়ার অপেক্ষায় এখন ভলোদিমিয়ের৷ নির্বাচনে তাঁর অন্যতম স্লোগান ছিল ‘আমিই হলোবরোদকো'৷ প্রশ্ন হলো কেবল কৌতুকাভিনয় দিয়েই কি মানুষের হৃদয় জয় করেছেন ভলোদিমিয়ের জিয়েলইয়েনস্কি, নাকি আরো অনেক কিছুই কাজ করেছে তাঁর বিস্ময়কর এই রাজনৈতিক উত্থানের পেছনে? সেটি বিশ্লেষণ করেছেন ডয়চে ভেলের রোমান গনচারেঙ্কো৷
পর্দার প্রতিচ্ছবি বাস্তবে
জিয়েলইয়েনস্কির নির্বাচনি প্রচারের ওয়েবসাইটে ব্রিফকেস হাতে তাঁর যে ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছে সেটি সার্ভেন্ট অব দ্যা পিপলের হলোবরোদকো চরিত্রটির একটি মুহূর্ত থেকে নেয়া৷ একই ছবি ব্যবহার করা হয়েছে প্রার্থীর ফেসবুক পেজেও৷ ক্যাম্পেইনে সার্ভেন্ট অব দ্যা পিপল কথাটি প্রচুর ব্যবহার করা হয়েছে৷ তবে এটি ২০১৫ সালে শুরু হওয়া টিভি শোটির নাম, নাকি তার দুই বছর পর তৈরি হওয়া তাঁর রাজনৈতিক দলটির শিরোনাম, তা পরিষ্কার নয়৷ নির্বাচনের আগে টিভি চ্যানেলে অবশ্য শোটি পুনঃপ্রচারিত হয়৷ আর এর সবশেষ তৃতীয় সিজনটির প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হয় মার্চে, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার আগেই৷
জিয়েলইয়েনস্কির সাফল্যের পেছনে তাঁর অভিনীত চরিত্র কতটা ভূমিকা রেখেছে? ‘কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব স্যোসিওলজি'র প্রধান এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভলোদিমেয়ার পানিয়োত্তো বলেন, পশ্চিমা আরেকটি টিভি অনুষ্ঠান তার আগেই এ ধরণের নজির তৈরি করেছে৷ ড্যানিশ টিভি শো বরগান বা দুর্গ প্রচারিত হয় ২০১০ সালে৷ একজন রাজনীতিবিদকে ঘিরে এর গল্প আবর্তিত হয়েছে, যিনি পরে ডেনমার্কের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন৷ এটি প্রচারের মাত্র ১ বছরের মাথায় ২০১১ সালে বাস্তবের একজন নারী রাজনীতিবিদ হ্যালে থর্নিং স্মিট দেশটির সত্যিকারের সরকারপ্রধান বনে যান৷
ড্যানিশ টিভি শোটির গল্প বাস্তবে রূপ নিয়েছিল৷ জনতাও প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল এর মাধ্যমে৷'' বলেন পানিয়োত্তো৷
কৌতুকাভিনয়ের বাইরে
কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব স্যোসিওলজি জিয়েলইয়েনস্কির ভোটারদের উপর একটি জরিপ চালিয়েছিল৷ তাদের ৫৪ ভাগই তাঁকে সমর্থনের কারণ হিসেবে বলেছেন, ‘‘তিনি বিদ্যমান ব্যবস্থার বাইরে থেকে এসেছেন, রাজনীতিতে নতুন মুখ৷'' মাত্র ছয় ভাগ বলেছেন, ‘‘টিভি শোতে তিনি যেভাবে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন সেটি পছন্দ ছিল৷'' পানিয়োত্তো বলেন, এই ফলাফল অনুযায়ী বলা যায় টিভি শোটি সহযোগিতা করলেও জিয়েলইয়েনস্কির রাজনৈতিক সাফল্যের পেছনে সেটি প্রধান কারণ নয়৷ সার্ভেন্ট অব দ্যা পিপলের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্টুডিও কেভারতাল নাইনটি ফাইভও এখানে বড় ধরণের প্রভাব রেখেছে৷ ১৫ বছর ধরে কোম্পানিটি ইউক্রেনের জনপ্রিয় সব হাস্য রসাত্মক টিভি শো দর্শকদের উপহার দিয়ে আসছে৷ যার বেশ কয়েকটি জিয়েলইয়েনস্কি অভিনয় করেছেন৷
‘‘কেভারতাল সবসময় রাজনীতিবিদদের নিয়ে মজা করে৷ এর মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে এক ধরণের রাজনৈতিক বোদ্ধা হিসেবেও হাজির করেছে,'' বলেন পানিয়োত্তো৷ এজন্য রাজনীতির ময়দানে নতুন আসা জিয়েলইয়েনস্কিকেও অযোগ্য মনে হয়নি দর্শকদের কাছে৷
আরেক বিশ্লেষক আন্দ্রি বিশেঙ্কোও একই অভিমত পোষণ করেছেন৷ তাঁর মতেও জিয়েলইয়েনস্কির নির্বাচনি ফলাফলে টিভি শোটি প্রভাব ফেললেও তা নির্ধারণমূলক ছিল না৷ তিনি বলেন, ‘‘জিয়েলইয়েনস্কি জনতার কাছে সরকারবিরোধী মনোভাবের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছেন৷ বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতি তাদের অনাস্থাকে তিনি ধারণ করেছেন৷''
পর্দা আর বাস্তবের চরিত্রের ব্যবধান
‘ইউক্রেনিয়ান ইনস্টিটিউট অব মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিক্যাশনস'এর প্রধান ডায়ানা ডুসিক পর্দার কাল্পনিক চরিত্র আর বাস্তবের একজন রাজনীতিবিদকে মিলয়ে দেখার দর্শকদের যে প্রবণতা, সেটি তুলে ধরেন৷ বলেন, ‘‘আমরা যখন বলছি সার্ভেন্ট অব দ্যা পিপলের প্রেসিডেন্ট বাইসাইকেলে ঘুরেন, তখন সেটি আসলে আরোপিত একটি ধারণা৷ কেননা বাস্তবের জিয়েলইয়েনস্কি কখনো সাইকেলে চড়েননি৷ তিনি দেহরক্ষীদের নিয়ে ব্যয়বহুল গাড়িতে করে যাতায়াত করেন৷'' জিয়েলইয়েনস্কির পরিবারের কাছে ২০১৬ সালের একটি ল্যান্ড রোভার আছে বলে নির্বাচনের আগে সম্পত্তির ঘোষণায় জানিয়েছিলেন তিনি৷ ডুসিক বলেন, ‘‘নিশ্চিতভাবেই বলা যায় প্রেসিডেন্ট হবার পরে তিনি নতুন করে সাইকেল চালাতে শুরু করবেন না৷''
তাঁর মতে, সামনের দিনে দেশটির নির্বাচনি প্রচার সংক্রান্ত আইন পরিবর্তন করতে হবে৷ যাতে নির্বাচনের আগে প্রার্থীর জনপ্রিয় কোনো শো টিভিতে প্রচারের ঘটনা না ঘটে৷
রোমান গনচারেঙ্কো/এফএস