আমিও সুপারম্যান!
১৯ মে ২০১৪না, ‘আমিও সুপারম্যান' কোনো ব্যক্তি নয়, একটা নাটক৷ যার প্রথম দৃশ্যটার বর্ণনা দেওয়ার লোভ সামলানো যাচ্ছে না৷ কারণ, খুব কম নাটকেই এরকম হয় যে একেবারে প্রথম দৃশ্য থেকেই নাটকের মূল বিষয়বস্তু এমন বাঙ্ময় হয়ে ওঠে! এমন সতেজ আর সাবলীলভাবে নিজের কথা বলতে শুরু করে৷
পর্দা সরলে দেখা যায়, একটি বাড়ির বসার ঘর৷ সেখানে টেবল-চেয়ারে বসে নিজের মনে খেলছে ঋজু নামের এক কিশোর৷ ওই বয়সের আর পাঁচটা বাচ্চা যেমন মনগড়া একটা দৃশ্য ভেবে নিয়ে, নিজেই একেকবার একেকটি চরিত্র হয়ে উঠে নিজের সঙ্গেই খেলা করে, তেমনই একটা খেলা৷ কলকাতার মনুমেন্টের মাথায় উঠে আটকে পড়ে ‘‘বাঁচাও বাঁচাও'' বলে চিৎকার করছেন এক মহিলা৷
মনুমেন্টের নীচে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের কিশোর নায়ক ঋজু, তবে সে এখন টিভি রিপোর্টার৷ সে ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছে টিভি-র দর্শকদের কাছে, আবার সে-ই মাথায় একটা ওড়না জড়িয়ে বিপন্ন ওই মহিলা সেজে আর্তনাদ করছে৷ পরক্ষণে সে-ই হয়ে যাচ্ছে এক দমকল কর্মী, যে জানাচ্ছে, অত উঁচু থেকে মহিলাকে নামিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট লম্বা মই নেই দমকলের কাছে৷ এমন সময় হাজির হচ্ছে সুপারম্যান, উড়ে গিয়ে মনুমেন্টের মাথা থেকে উদ্ধার করে আনছে মহিলাকে৷ ওই লাল ওড়না পিছনে ক্লোকের মতো বেঁধে ঋজুই তখন সুপারম্যান!
এমন সময় ঘরে ঢোকে ঋজুর ছোট বোন পলা৷ একটা হুইলচেয়ারে চড়ে৷ আহা, বেচারি বোধহয় হাঁটতে পারে না৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই ভুলটা ভাঙে, যখন পলা তিড়িং করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায় হুইলচেয়ার থেকে৷ একটু পরেই বোঝা যায়, আসলে ঋজু হাঁটতে পারে না স্বাভাবিকভাবে৷ কারণ, ‘‘স্পাইনা বিফিডা'' নামে মেরুদণ্ডের একটা কঠিন অসুখ আছে ঋজুর৷ কিন্তু আর যাই হোক, ঋজুকে প্রতিবন্ধী বলা যাবে না, কারণ ক্রাচ বা হুইল চেয়ার ছাড়া হাঁটতে না পারার অক্ষমতা ঋজুকে ‘‘প্রতিবন্ধী'' করে রাখেনি৷ ঋজুর মন চারপাশের অন্য বাচ্চাদের মতো সজীবই শুধু নয়, দুরন্তপনাতেও সে ওদেরও সমান৷ বাড়িতে বোন পলার সঙ্গে সে সমান তালে হুড়োহুড়ি করে৷ এতটাই, যে ওদের মা-ও মাঝেমাঝে বিরক্ত হয়ে যান!
কিন্তু প্রশ্ন হলো, সমাজের বাদবাকিরা ঋজুকে বা ঋজুর মতো মানুষদের কীভাবে দেখে৷ সেই জরুরি প্রশ্নটাই খুঁচিয়ে তোলে ‘আমিও সুপারম্যান'-এর মতো নাটক, চরিত্র এবং উদ্দেশ্যগতভাবে যে নাটক বার্লিনের বিখ্যাত গ্রিপস থিয়েটার-এর সমধর্মী৷ চার দশক আগে জার্মান নাট্যকার-নির্দেশক ফলকার লুডভিগ, শিশু এবং কিশোরদের কথা বলার জন্য এই নাট্যধারার সূচনা করেছিলেন বার্লিন শহরে৷ এই ধরনের নাটককে বলা হতো ‘‘ইমানসিপেটরি থিয়েটার'' বা উত্তরণের নাটক৷
যদিও মূলত কমবয়সি দর্শকদের দেখার উপযোগী এই নাটকে হাসি-মজা থাকে অঢেল, গান থাকে, কিন্তু নিছক বিনোদন নয়, এই গ্রিপস থিয়েটার এক মানসিক উত্তরণের দিশা দেখায়৷ কিছু অত্যন্ত জরুরি প্রশ্ন, সমাজের কাছে তা যতই অস্বস্তিকর হোক, উপস্থিত করে দর্শকদের সামনে৷ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বিচ্যুতিগুলো এবং কোথায় কখন প্রশ্নগুলো তোলা উচিত, তা-ও যেন শিখিয়ে দেয়৷
‘আমিও সুপারম্যান' নাটকে যেমন, ঋজুর তদারকির দায়িত্বে থাকা সুপারভাইজার মহিলা এসে বলেন, ঋজুর যত্ন নেওয়ার জন্য ওকে হোমে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত৷ ঋজুর মা বলেন, না৷ বরং ওঁদের বাড়ির সামনের ফুটপাথটার একটা দিক যদি ঢালু করে দেওয়া হয়, তা হলে উপকার হয়৷ ঋজু তা হলে ইচ্ছেমত বাড়ির বাইরে যেতে পারে, খেলতে অথবা বাড়ির কাজে, হয়ত দোকান-বাজার করতে৷ ঋজুদের আলাদা হোমে পাঠিয়ে একঘরে করে রাখাটাই বরং মস্তবড় ভুল, আমরা, তথাকথিত স্বাভাবিক মানুষেরা সচরাচর যে ভুলটা করে থাকি! আমরা বড় বড় মাল্টিপ্লেক্স বানাই, কিন্তু সেখানে হুইলচেয়ার নিয়ে যাওয়ার কোনও ব্যবস্থা রাখি না৷ কেন, ঋজুদের কি সিনেমা দেখতে যেতে ইচ্ছে করে না!
নির্দেশিকা জয়তি বোস এর আগেও গ্রিপস থিয়েটার ধারার দুটি নাটক, ‘কেয়ার করি না' এবং ‘রোবট কুপোকাত' মঞ্চস্থ করেছেন কলকাতার মাক্সম্যুলার ভবনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে৷ গত সপ্তাহান্তে সেই মাক্সম্যুলার ভবনের প্রেক্ষাগৃহেই মঞ্চস্থ হলো ‘আমিও সুপারম্যান'৷ নাটকটি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ এবং সারা দেশে যতগুলো জায়গায় সম্ভব, যত স্কুলে, যত ক্লাবে পারা যায়, এই নাটকের অভিনয় হওয়া দরকার৷ তথাকথিত প্রতিবন্ধীদের জন্যে নয়, আমাদের মতো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষদের জন্যেও, যারা চোখ খোলা রাখি, অথচ দেখতে পাই না!