ভারত-জার্মানি সেতুবন্ধন
২৮ এপ্রিল ২০১৪চমৎকার কথা বলেন এই বছরের ম্যার্ক-টেগোর পুরস্কারে সম্মানিত অধ্যাপক ডক্টর প্রমোদ তালগেরি৷ ১৯৬৭ সালে, ইউরোপে ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল সময়ে তিনি যান জার্মানির মিউনিখ শহরে জার্মান ভাষায় পিএইচডি করতে৷ সেখানে এক পুরনো বইয়ের দোকানদারের সঙ্গে তাঁর খুব বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল৷ একদিন তিনি হাঁটছেন মিউনিখের রাস্তা দিয়ে, সেই বন্ধু পিছন থেকে ডেকে তাঁকে বললেন, ‘‘তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ গিফট আছে আমার কাছে৷ তোমার দেশের লোকের লেখা বই!'' তারপর তিনি প্রমোদ তালগেরির হাতে তুলে দেন একটা ছোট প্যাকেট৷ সেই প্যাকেট খুলে তিনি দেখেন, সেটি একটি বিখ্যাত বাংলা নাটকের জার্মান অনুবাদ ‘‘পোস্ট আম্ট''৷ বাংলায় ‘‘ডাকঘর''৷ লেখকের নাম অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷
প্রায় অর্ধ শতক আগের সেই বিকেলেই সম্ভবত নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে ভবিষ্যতের কোনো এক দিন, জার্মানি এবং ভারতের সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনের কাজে নিয়োজিত থাকার স্বীকৃতি হিসেবে প্রমোদ তালগেরি এই ম্যার্ক-টেগোর পুরস্কার পাবেন৷ কারণ, জার্মানির এই ম্যার্ক পরিবারই প্রথম জার্মান ভাষায় রবীন্দ্রনাথের লেখার অনুবাদ করেছিলেন সেই ১৯১৪ সালে৷ এলিজাবেথ ম্যার্ক এবং তাঁর প্রকাশক স্বামী কুর্ট ভোল্ফ ১৯১৪ থেকে ১৯২৫ সালের মধ্যে এক এক করে রবীন্দ্র রচনার ২০টি খণ্ড প্রকাশ করেছিলেন, যা প্রায় ১০ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছিল ইউরোপজুড়ে৷ তারই একটি মিউনিখ শহরের ওই পুরনো বইয়ের দোকান ঘুরে পৌঁছেছিল ড. তালগেরির হাতে৷
ভারতে এবং জার্মানিতেও শিক্ষাবিদ এবং জার্মান ভাষাবিদ হিসেবে সুখ্যাতি অধ্যাপক ড. প্রমোদ তালগেরির৷ তবে শুধু জার্মান ভাষাই নয়, জার্মানি দেশটা সম্পর্কে, সেদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন সম্পর্কেও তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য৷ নতুন দিল্লির ‘জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটি' এবং হায়দরাবাদের ‘সেন্ট্রাল ইন্সটিটিউট অফ ইংলিশ অ্যান্ড ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ'-এ জার্মান ভাষার প্রধান অধ্যাপক থাকার পর বর্তমানে ড. তালগেরি ইন্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল মাল্টিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর৷ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বিশেষ আমন্ত্রণে সম্প্রতি তিনি নবগঠিত ‘ইন্দো-জার্মান কনসালটেটিভ গ্রুপ'-এর সদস্য হয়েছেন, যে গোষ্ঠী জার্মানির সঙ্গে ভারত সরকারের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং নীতি নির্ধারনে পরামর্শ দেয়৷
ড. তালগেরির প্রাক্তন ছাত্রী এবং পরবর্তীকালের সহকর্মী অধ্যাপক ড. বিভা সুরানা তাঁর শিক্ষকের পরিচয় করিয়ে দিতে উঠে খুব সুন্দর বললেন যে, ড. তালগেরি অন্তর থেকে প্রকৃত ভারতীয়, কিন্তু ব্যবহারিক আচারে আর মুক্তচিন্তায় একজন আদর্শ ইউরোপীয়৷ তিনি যেমন সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদে বিশ্বাসী, তেমনই এক বিশ্বজনীন একাত্মতাও তাঁর স্বপ্ন৷ এমন একজন পণ্ডিত মানুষকে দ্বিতীয় বছরের ম্যার্ক-টেগোর পুরস্কারে ভূষিত করল জার্মানির বিখ্যাত ওষুধ ও রাসায়নিক প্রস্তুতকারক সংস্থা ম্যার্ক৷ ২০১২ সালে শুরু হওয়া এই দ্বিবার্ষিক পুরস্কার প্রথম বছরে পেয়েছিলেন বিশিষ্ট জার্মান রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ এবং সমাজকর্মী মাটির্ন কেম্পশ্যেন৷ ম্যার্ক সংস্থা এই পুরস্কার দেয় ভারতে জার্মান সংস্কৃতি কেন্দ্র গ্যোটে ইন্সটিটিউট এবং জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রকের সঙ্গে৷ পদক এবং মানপত্র ছাড়া পাঁচ লক্ষ ভারতীয় টাকা এই পুরস্কারের অর্থমূল্য৷
বুধবার সন্ধ্যায় কলকাতার মাক্সমুয়েলার ভবনের এক প্রেক্ষাগৃহে এক অনুষ্ঠানে ড. তালগেরির হাতে এই পুরস্কার তুলে দিলেন ম্যার্ক সংস্থার পরিচালনগোষ্ঠীর চেয়ারম্যান ড. ফ্রাংক স্ট্যাঙ্গেনব্যার্গ হেভারকাম্প৷ উপস্থিত ছিলেন কলকাতার গ্যোটে ইনস্টিটিউটের বর্তমান ডিরেক্টর ফ্রিজো মেকার, প্রাক্তন ডিরেক্টর এবং বর্তমানে মুম্বইয়ের গ্যোটে ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর মার্টিন ভেল্ডে৷